শহিদ ভগৎ সিং ও সহযোদ্ধাদের প্রাণদণ্ড রদ করবার জন্য মহাত্মা গান্ধির প্রচেষ্টা 

শান্তনু দত্ত চৌধুরী

শহিদ ভগৎ সিং ,রাজগুরু ও শুকদেবের প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয় ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ। এই শহিদদের প্রাণদণ্ড রদ করবার জন্য ওই সময় মহাত্মা গান্ধি আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি সফল হন নি। ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোদ্ধাদের প্রাণদণ্ডের ঘটনায় জনমনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। প্রাণদণ্ডের কয়েকদিন পর করাচিতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে কিছু যুবক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।গান্ধিজি বলেছিলেন তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ওই অধিবেশনে ভগৎ সিংয়ের বাবা সর্দার কিষাণ সিং উপস্থিত হয়ে বলেন তাঁর পুত্র তাঁকে বলে গিয়েছেন মহাত্মাজীর নেতৃত্বে আজাদির লড়াই সম্পূর্ণ করতে। 

           সম্প্ৰতি কিছুদিন হল একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের আইটি সেল -এর পক্ষ থেকে এই বিপ্লবীদের ফাঁসি সম্পর্কে  গান্ধিজির বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এইসব সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক ছিলনা। এদের পূর্বপুরুষরা শহিদ ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোদ্ধাদের মুক্তির জন্য সেইসময় কোনও চেষ্টাই করেন নি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ এই শক্তির বংশধরদের এই মিথ্যা প্রচার সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। 

            ভগৎ সিং ও সহবন্দীদের প্রাণদণ্ড রদ করাবার জন্য মহাত্মা গান্ধির প্রচেষ্টা সম্পর্কে নেতাজি সুভাষ কী লিখেছেন দেখা যেতে পারে।

৫ মার্চ,১৯৩১ এ স্বাক্ষরিত গান্ধি — আরউইন চুক্তি অনুযায়ী সুভাষচন্দ্র  ৮ মার্চ মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি বোম্বাই আসেন গান্ধিজির সঙ্গে দেখা ও আলোচনা করতে।সেখান থেকে তাঁরা একসঙ্গে দিল্লি আসেন। সুভাষ চন্দ্র লিখেছেন :–

 “বোম্বে থেকে মহাত্মা দিল্লি রওয়ানা হলেন এবং ওই একই ট্রেনে তাঁর সঙ্গে আমিও গেলাম।ফলে বোম্বের আলোচনাকে সম্পূর্ণ করবার আরো একটি সুযোগই কেবল নয় , উপরন্তু এই চুক্তিটি দ্বারা জনগণের মধ্যে কিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা লক্ষ্য করার সুযোগও আমি লাভ করেছিলাম । সর্বত্র তিনি যে সম্বর্ধনা লাভ করেছিলেন তা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হল যে, তাঁর জনপ্রিয়তা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে।এমন কি ১৯২১ সালের ইতিহাসকেও তা অতিক্রম করেছে।দিল্লীতে পৌঁছেই আমরা নিদারুণ বিস্ময়ে এই সংবাদ পেলাম যে , লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার সরদার ভগৎ সিং ও তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে দুজনকে গভর্নমেন্ট ফাঁসি দেবেন বলে স্থির করেছেন।এই যুবকদের প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করবার জন্য মহাত্মাকে চাপ দেওয়া হল এবং একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে তিনি তাঁর পক্ষে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন।….লর্ড আরউইন সে সময়ে মহাত্মাকে বলেছিলেন তিনি বহু লোকের স্বাক্ষরিত একটি দরখাস্ত পেয়েছেন যাতে লাহোরের ওই তিনজন বন্দীকে প্রাণদণ্ডের পরিবর্তে লঘু দণ্ড দেবার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে।তিনি সাময়িকভাবে তাঁদের ফাঁসি স্থগিত রেখে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা  করে দেখার প্রতিশ্রুতি দিলেন।বড়লাটের এই মনোভাব দেখে মহাত্মা এবং প্রত্যেকেই সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে,শেষ পর্যন্ত ফাঁসি রদ করা হবে এবং সারা দেশব্যাপী বিশেষত: বাংলায় যেখানে কয়েকজন বিপ্লবী বন্দীর ফাঁসি হতে চলেছিল সেখানেও আনন্দোল্লাস দেখা গেল ।

               ঘটনার প্রায় দশদিন পরে করাচিতে কংগ্রেস অধিবেশন হওয়ার কথা।সকলেরই প্রত্যাশা ছিল যে,ফাঁসি রদ করা হবে ;  সুতরাং ২৪ মার্চ তারিখে কলকাতা থেকে করাচি যাবার পথে যখন আমরা সংবাদ পেলাম যে, আগের রাতে সর্দার ভগৎ সিং ও তাঁর সঙ্গীদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তখন তা অতীব বেদনাদায়ক ও অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো “।

{ভারতের মুক্তি সংগ্রাম, (Indian Struggle )নেতাজির সমগ্র রচনাবলী,২য় খন্ড, পৃ–১১৯ -আনন্দ পাবলিশার্স }

              গান্ধিজি সকল রকম হিংসা এমনকী আইনের দ্বারা অনুমোদিত রাষ্ট্রীয় হিংসা যথা কারাবাস,কারাদণ্ড এবং প্রাণদণ্ডের বিরোধী ছিলেন।ভগৎ সিং ও সহযোদ্ধাদের বিচার শুরু হওয়ার আগেই ১৯৩০ এর ৪ মে লর্ড আরউইন (ভাইসরয়)কে তিনি চিঠি দিয়ে বিচারের জন্য স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিরোধিতা করে এই  ট্রাইব্যুনাল গঠনকে ‘মার্শাল ল’ জারির সঙ্গে তুলনা করেন।ট্রাইব্যুনালে এঁদের ফাঁসির আদেশের পর ১৯৩১ এর ৩১ জানুয়ারি  গান্ধীজি বলেন ‘যাঁদের প্রাণদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে তাঁদের ফাঁসি দেওয়া উচিত তো নয়ই, তাঁদের কারাগারেও বন্দি রাখা উচিত নয়।যদিও এটি আমার ব্যক্তিগত মত এবং এটিকে আমি শর্ত হিসাবে আরোপ করতে চাইনা’ (Collected works of Mahatma Gandhi , Vol XLV, p 133 )।             

       ১১ ফেব্রুয়ারি প্রিভি কাউন্সিলে ভগৎ সিংদের স্পেশাল লিভ পিটিশন বাতিল হয়ে যাওয়ার পর এটা বোঝা যায় যে একমাত্র  ভাইসরয় এই বিপ্লবীদের প্রাণদণ্ডাদেশ স্থগিত করতে পারেন। গান্ধিজি এই বিষয়ে লর্ড আরউইনের সঙ্গে ১৮ ফেব্রুয়ারি  সাক্ষাৎ করে আলোচনায় বলেন
‘ বর্তমান সময় ও পরিবেশটিকে আপনি যদি আরো অনুকূল করতে চান তাহলে আপনার উচিৎ ভগৎ সিং ও সহযোদ্ধাদের প্রাণদণ্ড স্থগিত রাখা’। আরউইন বুঝতে পেরেছিলেন  প্রিভি কাউন্সিলের রায়ের পর ওই সময় প্রাণদণ্ডাদেশ রদ করা সম্ভব না হলেও তা স্থগিত রাখা যেতে পারে।গান্ধিজিকে  তিনি একথা বলেওছিলেন(ন্যাশানাল আর্কাইভ,হোম পল ফাইল 33/1 এবং KW1931)।   গান্ধিজির আশা ছিল প্রাণদণ্ড স্থগিত করাতে পারলে উপযুক্ত সময় তা রদ করার জন্য চেষ্টা করবেন।

            গান্ধিজি ১৯ মার্চ পুনরায় আরউইনের সঙ্গে দেখা করে ভগৎ সিং ও সহযোদ্ধাদের প্রাণদণ্ডাদেশ স্থগিত রাখার কথা বলেন।আরউইন তাঁর কার্য বিবরণীতে এই আলোচনা নথিবদ্ধ করেছিলেন। গান্ধিজি ২০ মার্চ হোম সেক্রেটারি হারবার্ট এমার্সনের সঙ্গে দেখা করে প্রাণদণ্ড স্থগিত করার বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন।
গান্ধিজি যে শেষ চেষ্টা করেন তার আর একটি পদক্ষেপ ছিল  কংগ্রেস নেতা আসফ আলিকে ,যিনি ছিলেন এই বিপ্লবীদের আইনজীবী, তাঁদের কাছে পাঠিয়ে  এই মর্মে একটি বিবৃতি সংগ্রহ করা, যাতে তাঁরা বলবেন যে ,মুক্তি পেলে তাঁরা হিংসাত্মক পথ ত‍্যাগ করবেন। এই ধরণের ঘোষণা গান্ধিজির প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করবে।কিন্তু পরবর্তী সময়ে আসফ আলি ২৭ মার্চ ‘ ভবিষ্য ‘ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে জানান বহু চেষ্টা করেও তিনি ভগৎ সিং -এর সঙ্গে দেখা করতে পারেন নি। এর ১৮ বছর পর যখন আসফ আলী উড়িষ্যার রাজ্যপাল তখনও তিনি তাঁর এই অসফল মিশনের কথা জানান।

           ইতিমধ্যে কংগ্রেস দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারা দেশ থেকে
 ভগৎ সিং ও সহযোদ্ধাদের প্রাণদণ্ডাদেশ মকুব করার জন্য লর্ড আরউইনের কাছে বার্তা আসতে থাকে।লর্ড আরউইন ছিলেন চরম দ্বিধাগ্ৰস্ত। গান্ধিজি এটা বুঝতে পারেন।তাই তিনি করাচি যাওয়া পিছিয়ে দিয়ে দিল্লিতে থেকে যান ও আরউইনের ওপর মানসিক চাপ আরো বৃদ্ধি করেন। লন্ডনের ‘ নিউ ক্রনিকল ‘- এর সাংবাদিক রবার্ট বারনেস তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন ‘ আজ ২১ মার্চ গান্ধিজি  আরউইনের সঙ্গে দেখা করে আবারও বিপ্লবীদের প্রাণদণ্ডাদেশ মকুব করার জন্য অনুরোধ করেন।

( সাংবাদিক রবার্ট বারনেস এর ডায়েরি প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে, যা থেকে ওই সময়ের প্রধান ঘটনাবলী, বিভিন্ন নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বিবরণ , উচ্চপদস্থ  ব্রিটিশ অফিসারদের বক্তব‍্য জানা যায়। খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান )।

              পরের দিন ২২ মার্চ গান্ধিজি আবার আরউইনের সঙ্গে দেখা করে প্রাণদণ্ডাদেশ স্থগিত রাখার জন্য অনুরোধ জানান (CWMG ,  Vol – XLV , p – 320, এটি হচ্ছে গান্ধি জীবনের  ১৯১৫ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত বিস্তৃত দিনলিপি)। আরউইন গান্ধিজিকে প্রতিশ্রুতি দেন তাঁর অনুরোধ তিনি অবশ‍্যই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন (অরুণা আসফ আলির নির্বাচিত রচনা ও বক্তৃতা, প্যাট্রিয়ট প্রকাশন,পৃ – ১০২)।

              গান্ধিজি আশার আলো দেখতে পান। ২৩ মার্চ সকালে তিনি আরউইনকে  ব্যক্তিগত চিঠি দেন।এই চিঠিতে প্রাণদণ্ড দেওয়া যে একটি অমানবিক অপরাধ সেকথা উল্লেখ করে গান্ধীজি এর বিরুদ্ধে জনমনে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া,দেশে শান্তি স্থাপন, বিচারের ক্ষেত্রে ভুলের সম্ভাবনা(Possibility of Judicial error) এবং আরউইনের খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি আবেগের কথা উল্লেখ করেন।কিন্তু তাঁর সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।২৩ মার্চ সন্ধ্যায় এই তিন বীর বিপ্লবীর ফাঁসি হয়ে যায়।এই খবর যখন গান্ধিজীর কাছে পৌঁছায় তিনি দৃশ্যত আবেগাপ্লুত ও শোকাহত হয়ে পড়েন ।

             উপরের ঘটনাগুলি থেকে দেখা যায় , গান্ধিজির পক্ষ থেকে প্রাণদন্ড রদের সব চেষ্টা সত্ত্বেও এই বিপ্লবীদের প্রানদণ্ডের  ঘটনা যতটা না ছিল গান্ধীজির ব্যর্থতা তার চেয়েও বেশি ছিল আরউইনের ওপর পাঞ্জাব প্রশাসনের ইউরোপীয় I.C.S ও I.P অফিসারদের প্রবল চাপের জয়।শেষ পর্যন্ত দোলাচলে দুলতে থাকা আরউইন পাঞ্জাব গভর্নর জিওফ্রে মন্টমোরেন্সি ও ইউরোপীয় অফিসারদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন। বিপ্লবীদের আইনজীবী আসফ আলী এবং ওই সময়ের সাংবাদিকরা যথা ক্রান্তি কুমার,রবার্ট  বার্নেস ,সি.এস.ভেনু ওই পদত্যাগের হুমকির কথা বলেছেন ও লিখেছেন। ‘ফ্রি প্রেস’ এর টেলিগ্রামেও  লেখে ‘Free Press has come to know from reliable sources that, almost all the English Officers of the Punjab Government have threatened Lord Irwin that if he commute the death sentence they will resign en mass’.(ভবিষ্য ,৯ এপ্রিল ,১৯৩১).

              এই ইউরোপীয় অফিসাররা মৃত্যুদণ্ডাদেশ স্থগিত রাখা যে অবশেষে প্রানদণ্ডাদেশ রদের দিকে যাবে এটা বুঝতে পেরে ভগৎ সিং – এর সঙ্গে আসফ আলিকে দেখা করতে দেয় নি ও তা বানচাল করে দেয়। শুধু তাই নয়, করাচি কংগ্রেস অধিবেশনের আগেই এই তিন বিপ্লবীকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য পাঞ্জাব গভর্নরের দাবি কার্যকর করা ছিল ওই ইউরোপীয় কোর্টের একটি মাস্টার স্ট্রোক।

         প্রথিতযশা ঐতিহাসিক  ভি.এন.দত্ত , গান্ধি – আরউইন চিঠিপত্র বিনিময় , সম -সাময়িক নথিপত্র ,সংবাদ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে লিখেছেন গান্ধিজি আন্তরিক ও গভীরভাবে এই প্রাণদন্ড স্থগিত ও অবশেষে রদ করার জন্য  চেষ্টা করেন। তাঁর এই প্রচেষ্টাকে সমসাময়িক পরিস্থিতি, জনমতের চাপ, আরউইনের ভূমিকা , ব্রিটিশ ব্যুরোক্রেসির কাজের ধারা, ব্রিটিশ প্রশাসন ও পদ্ধতির আলোকে দেখতে হবে।

 (২০০৭ এর সেপ্টেম্বরে চন্ডীগড়ে ICHR  ও  ইনস্টিটিউট অফ পাঞ্জাব স্টাডিজ – এর উদ্যোগে
” ভগৎ সিং ও তাঁর সময় ”  বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ঐতিহাসিক ভি এন দত্ত প্রদত্ত Key note address  এর  শিরোনাম ছিল ” ভগৎ সিং এর বিচার  ও তাঁর ফাঁসি : যা রদ করার জন্য গান্ধিজি সব রকম চেষ্টা করেছিলেন ।” )

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *