শান্তনু দত্ত চৌধুরী
দেশ জুড়ে নিদারুণ মূল্যবৃদ্ধি , ভয়াবহ বেকারি , কালো টাকার প্রাদুর্ভাব , ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘ পরিবার নব উদ্যমে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ঘটানোর জন্য আবারও মন্দির – মসজিদ বিতর্ক শুরু করেছে।
উত্তর প্রদেশের একটি আদালত, ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগকে একজন হিন্দু আবেদনকারীর দাবি যে বারাণসীতে জ্ঞানবাপি মসজিদ একটি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে তৈরি করা হয়েছিল , সে বিষয়ে তদন্ত করতে বলেছে।কাশি বিশ্বনাথ মন্দির ও জ্ঞানবাপি মসজিদের ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষ্য রয়েছে। সাড়ে তিনশ বছরের বেশি এই দুই উপাসনাস্থল পাশাপাশি অবস্থান করছে। আজ একটি উপাসনাস্থল অপসারণ করতে হবে ?
আরেকটি আদালত মথুরার শাহী ঈদগা মসজিদটি কৃষ্ণের জন্মস্থান বলে , দাবিকারীদের কাছে হস্তান্তর করার, একটি আবেদন গ্রহণ করেছে।যদিও ওই মন্দিরের ও মসজিদের ম্যানেজমেন্ট কমিটি বারংবার বলেছে এই বিবাদ ও বিতর্কের সঙ্গে তাঁদের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। তাঁরা ১৯৬৮ সালে সকলে মিলে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তাঁরা সদ্ভাবের সঙ্গে পাশাপাশি অবস্থান করবেন।
দিল্লিতে ‘ কুতুব মিনার ‘ কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য কথিতভাবে ধ্বংস করা মন্দিরগুলি হস্তান্তরের দাবিতে আরেকটি আদালত একটি মামলা গ্রহণ করেছে।যদিও ওই আদালতে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে ঐ সৌধের চরিত্রে কোনো পরিবর্তন আনা হবেনা। একই সঙ্গে ওই সৌধে কোনো হিন্দু ও জৈন মূর্তি প্রতিষ্ঠায় ASI তীব্র আপত্তি জানিয়েছে।তাঁদের আইনজীবী বলেছেন ওখানে পুজোপাঠ করা কারও মৌলিক অধিকার হতে পারেনা, কেননা যে আইনে ও যখন ওই সৌধ অধিগ্রহণ করা হয়, তখন ওখানে কেউ পুজোপাঠও করতো না , নামাজও আদায় করত না। ওই সৌধ ও তার জমির চরিত্র পরিবর্তন করে কারো মৌলিক অধিকার রক্ষা করা সম্ভব নয়। কুতুব মিনারে খোদিত লিপি থেকেই জানা যায় প্রাচীন মন্দিরের কিছু ধ্বংসাবশেষ এই সৌধের নির্মাণে ব্যবহার করা হয় , কিন্তু কোনো মন্দির ভাঙা ভাঙ্গি করে ওই বিশাল সৌধ নির্মিত হয়েছিল এরকম কোন প্রমাণ নেই।আবেদনকারীও স্বীকার করেছেন গত ৮০০ বছর ধরে ‘ কুতুব মিনার ‘ একই ভাবে রয়েছে। বিচারক প্রশ্ন করেন তাহলে এখন হঠাৎ ওখানে পুজো করার দাবি কি করে মৌলিক অধিকারে পরিণত হয় ?
এই সমস্ত দাবি অন্তহীন নতুন সাম্প্রদায়িক যুদ্ধের হুমকি দেয় যা উপাসনাস্থান আইন, ১৯৯১ এর পরিপন্থী।ওই আইন প্রণয়নের সঙ্গেই সব বিতর্ক শেষ হওয়ার কথা ছিল। যাতে বলা হয়েছে আগস্ট, ১৯৪৭ পর্যন্ত সমস্ত উপাসনাস্থল , যেটি যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় থাকবে। তা আর পরিবর্তন করা যাবে না। দেখা যাচ্ছে এই হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি দেশকে এক মধ্যযুগীয় বর্বরতার দিকে নিয়ে চলেছে।
বাবরি মসজিদ – রাম মন্দির বিতর্কের রায়ে, সুপ্রিম কোর্ট এই আইনের প্রশংসা করেছে এবং বলেছে “অ-পশ্চাদপসরণ হল মৌলিক সাংবিধানিক নীতিগুলির একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য, যার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি মূল উপাদান।” আইন এবং সুপ্রিম কোর্টের ভাষা ছিল দ্ব্যর্থহীন। তবুও নিম্ন আদালতগুলি আইন এবং সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে আবেদনগুলি স্বীকার করছে।
আইনটি ধর্মীয় দখলের চেষ্টাকে অপরাধী করে তোলে। যৌক্তিকভাবে, নতুন মামলায় হিন্দু পিটিশনকারীদের বিচার হওয়া উচিত। পরিবর্তে নিম্ন আদালতের বিচারকরা যদি এই ধরনের মামলা স্বীকার করেন, তাহলে তারা কি আইনকে উপেক্ষা করে সুপ্রিম কোর্টের অবমাননা করছেন না ?
কিছু উদারপন্থী হতাশ যে সুপ্রিম কোর্ট আর ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করে না এবং হিন্দুত্বপন্থী। এটি একটি স্থূল অতিরঞ্জন। উদারপন্থীদের উচিৎ উত্তরপ্রদেশের ভুল বিচারকদের ভর্ৎসনা করতে এবং ১৯৯১ আইনের পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা।
কেউ অস্বীকার করবে না যে প্রাচীন ও মধ্য যুগের ইতিহাসে এরকম উদাহরণ বহু আছে যেখানে দেখা গিয়েছে যে বিজয়ীরা পরাজিত পক্ষের উপাসনালয় লুট ও ধ্বংস করেছে। বলা হচ্ছে আওরঙ্গজেব বারাণসীতে জ্ঞানবাপী মসজিদ নির্মাণের জন্য একটি মন্দির ধ্বংস করেন। রিচার্ড ইটনের মতো ঐতিহাসিকরা রেকর্ড করেছেন যে হিন্দু রাজারা অন্য হিন্দু রাজাদের জয় করে তাদের মন্দিরও লুট করেছিল, শুধুমাত্র অর্থের জন্য নয় বরং জোর দিয়েছিল যে পুরানো আদেশ নতুন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ৬৭২ খ্রিস্টাব্দে, পল্লব রাজা নরসিংহবর্মণ চালুক্যদের পরাজিত করে তাদের রাজকীয় মন্দির লুটপাট ও ধ্বংস করেছিলেন।আবার পল্লব রাজাদের নির্মিত মহাবলিপুরমের বিখ্যাত মন্দিরসমূহের ওপর চালুক্য রাজারাও আক্রমণ চালিয়েছিল। পুষ্যমিত্র শুঙ্গ ( খ্রিষ্ট পূর্ব ১৮৫ – ১৪৯ ) অসংখ্য বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্র ধ্বংস করেছিলেন।
আমাদের বাংলায় পাল রাজাদের শাসনকালে ( অষ্টম –দ্বাদশ শতাব্দী) জৈন ধর্ম খুবই বিস্তার লাভ করে। বর্ধমান , বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলা ছিল একদা জৈন ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখনও বহু জৈন মন্দিরের ধংসাবশেষ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে।এর মধ্যে খুবই উল্লেখযোগ্য পুরুলিয়ার পাকবিররা ও তেলকুপি। এখানে প্রায় সব জৈন মন্দিরগুলি হিন্দু মন্দিরে পরিণত করা হয়েছে।
একই ঘটনা ঘটেছে রাজস্থানের ওশিয়াতে। ওখানে প্রায় সব জৈন মন্দিরগুলি পরিণত হয়েছে হিন্দু মন্দিরে। সর্বত্রই জৈন তীর্থঙ্করদের দিগম্বর মুর্তিগুলিতে সিঁদুর লেপে সেগুলিকে বিষ্ণু বা শিব মূর্তিজ্ঞানে পুজো করা হচ্ছে।
এখন কি এইসব ধর্মস্থানগুলি পুনরায় উদ্ধার করতে দেওয়া হবে ? না কি যাওয়া উচিত পুনরুদ্ধার করতে ?
একটি নতুন ধর্মের অনুসারী কিছু বিজয়ী, কখনও কখনও তাদের নতুন ধর্মের জন্য একটি উপাসনালয় নির্মাণ করে, বিদ্যমান মন্দিরটি ধ্বংস করার পরে, ধ্বংসাবশেষ থেকে পাথর এবং স্তম্ভগুলিকে পুনরায় ব্যবহার করে। কখনও কখনও একটি উপাসনালয়কে নতুন ধর্মের জন্য রূপান্তরিত করা হয়েছিল। সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল ইস্তাম্বুলের হাজিয়া সোফিয়া, একটি দুর্দান্ত বাইজেন্টাইন গির্জা যা অটোমান বিজয়ীদের দ্বারা মসজিদে রূপান্তরিত হয়েছিল। বহুশত বছর পর তুরস্কের জননায়ক কামাল আতাতুর্ক ওই মসজিদটিকে একটি মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করেন। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় সম্প্রতি তুরস্কের বর্তমান শাসক এরদোগান এই মিউজিয়ামটিকে আবার মসজিদে পরিণত করেছেন।
কিন্তু বিপরীত দিকে রূপান্তরও সাধারণ ঘটনা ছিল। স্পেনের কর্ডোবায় গ্র্যান্ড মসজিদটি ঐ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। খ্রিস্টানদের পুনঃবিজয়ের পরে এটি ধ্বংস হয়নি, তবে ১৩ শতকে এর কেন্দ্রীয় অংশটি ক্যাথেড্রালে রূপান্তরিত হয়েছিল। একটি উইকিপিডিয়া অনুসন্ধান প্রকাশ করে , ১৬ টি স্প্যানিশ মসজিদ গির্জায় রূপান্তরিত হয়েছে। পর্তুগালে এরকম তিনটি ধর্মান্তর রয়েছে, বিশেষ করে মেরতোলার আলজামা মসজিদ। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ধর্মান্তরগুলির মধ্যে রয়েছে গ্রিসের ইব্রাহিম পাশা মসজিদ, বুলগেরিয়ার কালো মসজিদ এবং হাঙ্গেরির পাশা আসিম মসজিদ। ইসরায়েলের তিনটি মসজিদ সিনাগগে পরিণত হয়েছে।
ইতিহাস বিজয়ের দ্বারা উপাসনালয়গুলির চরিত্র পরিবর্তন করে। তবে উত্তরটি প্রতিটি ঐতিহাসিক যুদ্ধে পুনরায় লড়াই করা যাবে না – যা চিরন্তন ধর্মীয় সংঘাতকে উসকে দেবে। ভারতীয় সংবিধানের শব্দ এবং চেতনা ধর্মনিরপেক্ষতার শপথ করে, যা প্রতিটি প্রাচীন ঝগড়াকে পুনরায় লড়াই করে ধ্বংস করা হবে।
অনেকেই জানেন না যে ভারতের বেশ কয়েকটি মসজিদকে মন্দিরে রূপান্তরিত করা হয়েছিল, প্রধানত ভারত ভাগের অর্ধ-ভরা ক্রোধে। হরিয়ানার সোনিপাতের জামে মসজিদকে দুর্গা মন্দিরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এটিতে ধ্রুপদী মুসলিম গম্বুজ এবং খনিজ রয়েছে, তাই এটির ধর্মীয় চরিত্র পরিবর্তিত হয়েছে তা দেখানোর জন্য কোন প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই।
হিন্দুত্ববাদীদের অভিযোগ অনুযায়ী ঔরঙ্গজেব কাশিতে একটি বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করে জ্ঞানব্যাপি মসজিদ নির্মাণ করে ছিলেন। কাশির বহু মানুষের অভিযোগ , নরেন্দ্র মোদি বিশ্বনাথ করিডোর নির্মাণের জন্য কাশির ১৪৩ টি মন্দির ধ্বংস করেছেন। কাশির গঙ্গা – যমুনা সংস্কৃতিকে (গঙ্গা – যমুনা তেহজীব ) ধ্বংস করার জন্য আবার মন্দির – মসজিদ বিতর্ক শুরু করেছেন। ইতিহাসকে বিকৃত করাই এদের প্রধান কাজ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে মুছে ফেলার জন্য ইনি দিল্লির ইন্ডিয়া গেটের অমর জওয়ান জ্যোতি সরিয়ে ফেলেছেন।