এই ভাইরাস হলো ঘৃণা ও প্রতিকুলতার । এটা আরো বেশি গভীর অবিশ্বাস সৃষ্টি করে । শ্বাসরোধকারী বিতর্ক সৃষ্টি করে জাতি ও মানবতার ক্ষতি করে ।
লেখিকা- সোনিয়া গান্ধী
সভানেত্রী, সর্ব ভারতীয় কংগ্রেস কমিটি।
ভারতবর্ষে কি স্থায়ী মেরুকরণ দরকার? আজকের শাসক দল নিজেদের স্বার্থে ভারতের নাগরিকদের স্পষ্টভাবে এটাই বিশ্বাস করাতে চাইছে । পোষাক, খাদ্য, বিশ্বাস, উৎসব কিংবা ভাষা, প্রতিটি বিষয়ে ভারতীয়দের নিজেদের মধ্যে লড়াই লাগানোর জন্য গোপনে এবং প্রকাশ্যে সবরকম ইন্ধন জোগানো হচ্ছে । প্রাচীন ও সমসাময়িক ইতিহাসকে বিকৃত করে এমনভাবে অনুবাদ করা হয়েছে যাতে করে কুসংস্কার, হিংসা, প্রতিশোধ ছড়িয়ে পড়ে । আমরা এমনই দুর্ভাগা যে, আমাদের দেশের সম্পদ ব্যবহার করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সৃষ্টি করার চেষ্টা না করে যেখানে যুবশক্তিকে পুরোপুরি ভাবে ব্যবহার করে নতুন ভবিষ্যতের পরিবর্তে পুরানো জিনিস গুলো একটা নতুন মোড়কে মুড়ে কাল্পনিক অতীতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে ।
আমাদের দেশের বহুরকম বৈচিত্র্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বহুরকম কথা বলতে শোনা যায় কিন্তু প্রকৃত বাস্তব হলো এই যে ওই সমস্ত বৈচিত্র্য যেগুলি আবহমান ধারায় আমাদের সমাজকে কয়েক শতাব্দী ধরে সমৃদ্ধ করে এসেছে, সেগুলিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করে আমাদের সমাজকে বিভক্ত করা হচ্ছে, আরো বেশি করে খারাপদিকগুলো এবং ভুল গুলোকেই দৃঢ়ভাবে শক্তিশালী করা হচ্ছে ।
আমাদের দেশের বহুরকম বৈচিত্র্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বহুরকম কথা বলতে শোনা যায় কিন্তু প্রকৃত বাস্তব হলো এই যে ওই সমস্ত বৈচিত্র্য যেগুলি আবহমান ধারায় আমাদের সমাজকে কয়েক শতাব্দী ধরে সমৃদ্ধ করে এসেছে, সেগুলিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করে আমাদের সমাজকে বিভক্ত করা হচ্ছে, আরো বেশি করে খারাপদিকগুলো এবং ভুল গুলোকেই দৃঢ়ভাবে শক্তিশালী করা হচ্ছে ।
এ বিষয়টি সার্বিক ভাবে গ্রহণযোগ্য যে আমাদের উচ্চ অর্থনৈতিক বৃদ্ধি শক্তিশালী করার জন্য সম্পদ তৈরি করা এবং তা পুনর্বিতরন করা এবং জীবনযাপনের মান উন্নত করা ও রাজস্ব আদায় করে সমাজ সেবা মুলক কাজকর্ম ও যুবকদের জন্য পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন।কিন্তু এই ভুল উদারনীতি ও ধর্মান্ধতা আমাদের সমাজকে খারাপ করার জন্য অর্থনীতির ভিত নড়িয়ে দিয়েছে । আমরা অবাক হইনা যে কিছু কর্পোরেট কর্তাব্যক্তি কর্ণাটকের ঘটনার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন । এই সাহসী প্রতিবাদের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক ভাবেই সোশাল মিডিয়ায় তুলোধোনা করা হয়েছিল । কিন্তু উদ্বেগ প্রকাশ করার মধ্যে ভুল কিছু নেই। এবং বিস্তীর্ন ভাবে প্রচারিতও হয়েছে ।এটাও আর গোপন নেই যে বিগত কয়েক বছরে অনেক ব্যবসায়ী তাদেরকে অনাবাসী ভারতীয় হিসাবেও দাবি করেছেন।
ঘৃণার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি , সর্বসমক্ষে গণ্ডগোল করার জন্য প্ররোচনা দেওয়া এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধ আমাদের সমাজকে সংক্রামিত করে তুলেছে । বিভিন্ন বৈচিত্র্যমূলক উৎসব উদযাপনকে ভাগ করে নেওয়া, বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যের সম্পর্ক, চলচ্চিত্র-শিল্প এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পারস্পরিক এহেন ‘দিবে আর নিবে/ মিলাবে মিলিবে’র হাজারো দৃষ্টান্ত বহু শতাব্দী ধরে আমাদের সমৃদ্ধ করে এসেছে । শুধুমাত্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক লাভের জন্য এগুলির অবমূল্যায়ন করার মানে ভারতীয় সমাজ ও জাতিসত্তা র যৌগিক ও বহুত্ববাদী ভিত্তিকেই অবমূল্যায়ন করা ।
আরো বড়ো ক্ষতিকর দিক হলো জাঁকজমকভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিভাজনের কৌশল এবং ভারতবর্ষে স্থায়ী উন্মত্ততা তৈরি করা।শাসকের মতাদর্শের বিরুদ্ধে সমস্ত মতামত এবং ভিন্নমতকে সবসময় নির্দয় ভাবে কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চলছে ।রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নিশানা করে তাঁদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে ব্যবহার করা হচ্ছে । প্রতিবাদীদের সবসময় ভয় দেখিয়ে চুপ করানোর চেষ্টা চলছে । সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে মিথ্যা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর উদ্দেশে ।ভয়ের পরিবেশ,প্রতারণা , ভয় দেখানো এইটাই হলো ‘Maximum governance’- Minimum government’-এর কৌশল ।নরেন্দ্র মোদি সরকার ২৬ শে নভেম্বর সংবিধান দিবস পালন করছে; কারণ ১৯৪৮ সালের ওইদিন সংবিধান সভাতে আমাদের সংবিধানকে গ্রহণ ও অর্পণ করা হয়েছিলো। একদিকে সংবিধানকে শ্রদ্ধা জানানোর কর্মসূচী অন্যদিকে একইসঙ্গে পাশাপাশি প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান গুলোকে পদ্ধতি গত ভাবে দুর্বল করা হচ্ছে । এটা একধরনের দ্বিচারিতা এবং কপটতা ।
সারা বিশ্বের কাছে আমরা কিভাবে প্রতিভাত হচ্ছি, বিশ্ব আমাদের কিভাবে দেখছে তা পুরোটাই নির্ভর করে আমরা নিজেদের মধ্যে কতটা কাজের মাধ্যমে সঙ্ঘবদ্ধ , কোনো প্রচারের মাধ্যমে নয়। কিসের বাধায় এবং কেন প্রধানমন্ত্রী কেন সর্বসমক্ষে যে কোন ঘৃণা ছড়ানো-মন্তব্য ও পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পরিস্কার ভাবে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাতে পারছেন না? বারবার অপরাধ করার পরেও ওইসব ঘৃণার বিষ ছড়ানো গোষ্ঠী ও ব্যক্তিরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়া তারা উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখে সারা দেশে আগুন ছড়াচ্ছে । নিশ্চয়ই তারা কোনো না কোনোভাবে সরকারের সমর্থন ও প্রশ্রয় পেয়ে থাকে আর সেইজন্যই অসাংবিধানিক ও আইন বিরুদ্ধ মন্তব্য করেও ছাড় পেয়ে থাকে ।
জোরদার বিতর্ক, আলোচনা, ভিন্নমত পোষণ এগুলো এখন অতীত হয়ে গেছে; ধীরে ধীরে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি । বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের নতুন ধরণের চিন্তার প্রকাশের জন্য সম্মানিত হতো, তারাই বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধির সাথে আলোচনা আদান-প্রদানের জন্য আজ রাষ্ট্রশক্তির সন্দেহের তালিকায় চলে এসেছে । কোনো ধর্ম বা গোষ্ঠী দের সমালোচনা করা যেন একটা নিয়ম হয়ে গেছে এবং বিভেদ সৃষ্টির রাজনীতি ধীরে ধীরে কর্মক্ষেত্রে , প্রতিবেশীদের মধ্যে এমনকি ঘরের মধ্যেও ঢুকে পড়েছে । আমরা আগে কখনোই এই ধরনের ঘৃণার পরিবেশ করা দেখি নি ।
আমাদের এত সুন্দর দেশ যেখানে ভিন্নতা, বৈচিত্র্য এবং বহুত্ববাদী পরিবেশেই প্রচুর সৃষ্টিশীল মানুষের জন্ম হয়েছে, যাঁরা তাঁদের সৃষ্টির জন্য জগৎ বিখ্যাত ।এগুলো সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র উদার পরিবেশ ও সহনশীলতার জন্য । শুধুমাত্র ক্ষুদ্র মনের যারা তারা কখনোই একটা সমাজকে নতুন চিন্তা ও উদ্ভাবনী পথ দেখাতে পারে না । ভ্রূকুঞ্চিত মন কখনোই উর্বর ও উদ্ভাবনী প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে না।
হিংসা, ধর্মান্ধতা, অসহিষ্ণুতা, ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা’র ডালি আজ আমাদের দেশকে গিলে খেয়েছে ।এখনো যদি এগুলোকে বন্ধ না করা যায় তাহলে আর কোনোদিনই ঠিক করা যাবে না । আমরা এই অনৈতিক – অমানবিক কাজের অনুমতি দিতে পারি না। ‘মিথ্যা-জাতীয়তাবাদের’ কাছে শান্তি ও বহুত্ববাদের যে আদর্শ তার বলিদান হয়ে যাচ্ছে! এ জিনিস আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পারিনা।
আমাদের পূর্বপুরুষদের কষ্ট করে তৈরি করা এই আবহমান ভারতবর্ষ, যাকে ঘৃণার বাতাবরণ দিয়ে নষ্ট করার অপপ্রয়াস চলছে। সেই কারণে আজও সমানভাবে প্রযোজ্য এক শতক আগে কবিগুরু রচিত সেই কবিতা… “চিত্ত যেথা ভয়শুন্য উচ্চ যেথা শির”
( অনুলেখনঃ অশোক ভট্টাচার্য)