‘ অগ্নিপথ ‘ প্রকল্প: আমাদের সেনাবাহিনীর মহান ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা

অমিতাভ সিংহ

রোম যখন জ্বলছিল তখন সম্রাট নিরো বেহালা বাজাচ্ছিলেন। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ট্রেন, বাস,পুলিশ স্টেশন যখন জ্বলছে, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন মহিশুর রাজপ্রাসাদে সপার্ষদ যোগ দিবস পালন করে তার ছবি মিডিয়াতে ছাপানোর ব্যবস্থা করছেন। একই সঙ্গে মহারাষ্ট্রে মহারাষ্ট্র আগাড়ি জোট সরকার ফেলার জন্য একেকজন বিধায়ককে কোটি টাকায় কেনার পরিকল্পনাসহ তাদের সুরাট বা গুয়াহাটিতে পাচার করার ব্যবস্থা করেছেন।

ভারতীয় সেনাবাহিনীতে অগ্নিপথ নামে যে ঠিকা সৈনিক প্রকল্প গত ১৪ জুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ঘোষণা করেছেন তার বিরুদ্ধে সারা দেশের প্রায় সমস্ত রাজ্যে যুবসমাজ চরম বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, যা অভূতপূর্ব বললেও কম বলা হয়।যদিও এই বিক্ষোভ বহু জায়গায় হিংসাত্মক রূপ নিয়েছে যা সমর্থনযোগ্য নয়।কিন্তু কোনও রাজনৈতিক প্ররোচনা ছাড়াই যখন এই বিক্ষোভ চলছে তাতে দেশের যুবসমাজ যে বিজেপির গত আট বছরের শাসনে কতটা হতাশ হয়ে এই পথ বেছে নিয়েছে সেই ব্যাপারেও আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। বিহার,উত্তরপ্রদেশ,হরিয়ানা, পাঞ্জাব, ঝাড়খন্ড, উত্তরাখণ্ড, দিল্লী,ওডিশা,তেলেঙ্গানা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এই রেলগাড়ি, বাস,পুলিশের ওপর আক্রমণ। প্রতিদিন কয়েকশ করে ট্রেন বাতিল,বিহারে তো দিনের বেলা রেল চলাচল একেবারেই বন্ধ। আজ ২২ জুন, এখনও বিহারের ওপর দিয়ে কোনো ট্রেন চলছে না।

জাত পাত ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে কোনও একটা সামাজিক সমস্যার বিষয়ে এমন স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদ বিক্ষোভ ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে প্রবল জনবিক্ষোভের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।ক্ষুব্ধ যুবকদের হাতে জাতীয় পতাকা ,কন্ঠে স্লোগান ‘ভর্তি কর অথবা শ্মশানে পাঠাও’।একাধিক যুবক আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদি সরকার উচ্চনাদে বাগাড়ম্বরের আড়ালে একের পর এক প্রবল জনবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করে এসেছে।মোদি সরকার প্রথমেই কংগ্রেস সরকার প্রণীত কৃষক স্বার্থের জমি অধিগ্রহণ আইন বাতিল করে কর্পোরেটদের স্বার্থে জমি অধিগ্রহণের অর্ডিন্যান্স জারি করে। কিন্তু ওই অর্ডিনান্সটি তারা আইনে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়।নোটবন্দী, জিএসটি ইত্যাদি চালু করা হয়েছিল কোনও হোমওয়ার্ক না করে।এর ফলে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও ব্যবসা গভীর সংকটে পড়েছে।কোনও প্রস্তুতি ছাড়া চার ঘন্টার নোটিশে লকডাউন ঘোষণার ফলে কয়েক কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন ,বাড়ি ফিরতে গিয়ে ঘোর বিপদে পড়েছেন। মোদি গায়ের জোরে অপরিণামদর্শী তিন কৃষি আইন পাস করিয়ে একবছরের বেশী সময় পর কৃষকদের আন্দোলনের ফলে বাধ্য হয়েছেন তা প্রত্যাহার করতে।প্রতিটি ক্ষেত্রে অসংখ্য মানুষ মারা গিয়েছেন।সাধারণ মানুষের ওপর সরকার উৎপীড়ন কম করে নি।দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি সরকারের কোন দায় দায়িত্ব নেই। তাদের যত দায় বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজিপতিদের প্রতি। তার মধ্যেও আবার অতি অনুগৃহিতরাও আছেন। রাহুল গান্ধি বলেছেন ‘ হাম দো হামারে দো ‘। এরা দেশের মানুষকে সর্বদা ধর্মের লাইনে বিভক্ত করার হীন কার্যক্রম নিয়ে প্রচার চালাচ্ছে। সংখ্যাগুরুবাদ যা হচ্ছে মুসোলিনি ও হিটলারের ভয়ঙ্কর ফ্যাসিস্ত মতাদর্শ তারই ভারতীয় সংস্করণ হচ্ছে এদের নীতি। এদের অনুসৃত পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভয়ঙ্কর সংকটের দায়ভার এরা চাপিয়ে দেয় সাধারণ মানুষের প্রতি। তারই সর্বশেষ উদাহরণ ‘অগ্নিপথ’ নামক ঠিকা সৈনিক প্রকল্প।নরেন্দ্র মোদির আর একটি স্টান্ট। কবি হরিবংশ রাই বচ্চন বহু বছর আগে ‘অগ্নিপথ’ নামে একটি কবিতা লেখেন।এই নামেই ১৯৯০ সালে কবিপুত্র অমিতাভ বচ্চন অভিনীত একটি সিনেমা তৈরি হয়। এবার মোদি ঐ নামে চালু করলেন ঠিকা সৈনিক প্রকল্প।

একটু দেখে নেওয়া যাক কি এই অগ্নিপথ প্রকল্প।

★ চারবছরের জন্য সেনাবাহিনীর তিন শাখাতেই ১৭ থেকে ২১ বছরের যুবকদের নিয়োগ করা হবে,তাদের বলা হবে ‘ অগ্নিবীর ‘।

★ এরজন্য বিশেষ নিয়োগ পর্ষদ গঠন করা হবে।

★ দ্বাদশশ্রেণী পাস করা যুবকদের নিয়োগ করা হবে।

★ সেনাবাহিনী জানিয়েছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে তিন বাহিনীতে নিয়োগ করা হবে ও আগের পদ্ধতিতে নিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে।

★ এই নিয়োগ চার বছরের জন্য হবে। পরে এর থেকে ২৫% পর্যন্ত অগ্নিবীরকে সেনাবাহিনীর স্থায়ী কমিশনে রাখা যেতে পারে যদি তারা যোগ্যতামান পেরোতে পারে।

★ প্রথম তিন বছরে তারা মাসে ৩০ হাজার টাকা ও শেষ বছরে মাসে ৪০ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পাবে। প্রতি মাসে তাদের এই টাকা থেকে ৯ (নয়) হাজার টাকা করে কেটে নেওয়া হবে।

★ চার বছর পর তাদের ১১ লক্ষ টাকা করে দিয়ে বিদায় করা হবে। তাঁদের কোনো পেনশন থাকবেনা। কোনো ফ্রি মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টের সুযোগ থাকবে না।

★যুদ্ধ করতে গিয়ে তাদের মৃত্যু হলে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। সম্পূর্ণভাবে অক্ষম হলে ৪৪ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হবে।

বিহারসহ বেশ কিছু রাজ্যের নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের যুবকেরা সেনাবাহিনীর পরীক্ষার জন্য প্রতি বছর নিজেদের তৈরী করার চেষ্টা করেন।তাই সেইসব রাজ্যে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে এতটা বিক্ষোভ।মাত্র চার বছর ঠিকা শ্রমিকের কাজ স্বাভাবিক ভাবেই তাদের পছন্দ হওয়ার কথা নয়। সেনাবাহিনীতে নিয়োগের নূন্যতম বয়স ১৭ বছর।এই প্রকল্পে না আছে পেনশন, চার বছর পর না আছে গ্রাচুইটি,না আছে স্বাস্থ্য সম্পর্কে কোন সুবিধা। চার বছর পর এই অগ্নিবীরেরা কোথায় কিভাবে কাজ পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।২১ বছর বয়সে তাদের অবসর জীবন শুরু হয়ে যাবে? কী আশ্চর্য !

এমন কোনো সার্ভিস কেন্দ্রীয় বা কোনো রাজ্য সরকারে আছে , যেখানে প্রচন্ড প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে নির্বাচিত হওয়ার চার বছরের মধ্যে চাকরি শেষ হয়ে যায়? কোনো পেনশন থাকে না ? মজার ব্যাপার হল প্রকল্প ঘোষণার চারদিনের মধ্যে সর্বোচ্চ বয়স দুবছর বাড়িয়ে ২৩ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগ ও বলিদানকে পুঁজি করে যে হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘ পরিবার বারবার নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়। যেমন ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে পুলওয়ামার ৪৬ জন সিআরপি জওয়ানের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুকে তারা Encash করেছিল। সেই সংঘ পরিবার এখন নবীন সেনা জওয়ানদের চাকরি ৪ (চার ) বছরের মধ্যে খতম করে দিতে চাইছে , কোনও পেনশন , গ্রাচুইটি , মেডিক্যাল বেনিফিট ছাড়া।

বছরে দুই কোটি চাকুরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছিল তা যে বিরাট জুমলা ছিল তা এখন পরিষ্কার।১৪ জুন মোদি বললেন ১০ লাখ লোককে চাকরি দেবো , আর রাজনাথ সিং বললেন প্রতিরক্ষায় ৪৬ হাজার। বাকি ৯ লাখ ৫৪ হাজার চাকরি কোথায় হবে ? কোনো উত্তর নেই আর ওই ৪৬ হাজারের ৭৫% অর্থাৎ ৩৫ হাজার তো ৪ বছর পর চাকরি হারাবে। বেকারত্বের হার গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। করোনাকালে দেশে চোদ্দ কোটি মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছেন।এর মানে একটাই, দেশের প্রায় ৫৬ কোটি মানুষ এদের শাসনে নতুন করে আজ সংকটে পড়েছেন।একজনের পরিবারে চারজন সদস্য ধরলে হিসাবটা তাই দাঁড়ায়।

সেনাবাহিনীতে ১৪ লক্ষ মানুষ চাকুরি করেন। প্রতিবছর ৬০ হাজার সেনা অবসর নেন।৫০ হাজার করে নিয়োগ হয়।গত দুবছর সেনাবাহিনীতে নিয়োগ বন্ধ। ২০১৯ সালে যারা সবরকম কঠোর পরীক্ষা দিয়ে চূড়ান্ত নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের ওই Selectionও বাতিলের মুখে। রাজনাথ সিং বলেছেন ৪৬ হাজার অগ্নিবীর নিয়োগ করা হবে। অর্থাৎ ১.৫০ লাখের জায়গায় ৪৬ হাজার। সরকারের হটকারী সিদ্ধান্তের ফলে সেনার গরিমা,পরম্পরা ও অনুশাসন যে ভেঙে পরবে তা প্রাক্তন সেনা অফিসারদের মত।এর ফলে তাঁদের মনোবল ভাঙবে। যেখানে সেনাদের প্রশিক্ষণের জন্য ৪৯ সপ্তাহ ধার্য করা আছে ও একজন পরিপূর্ণ সৈন্য তৈরি হতে ৬ বছর সময় লাগে সেখানে অগ্নিবীরদের ৬ মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কিভাবে বর্তমান সেনাদের মতন দক্ষতা ও Combat করার মতন মানসিক জোর তাদের মধ্যে তৈরি করা যাবে ? এই বিষয়ে সেনাকর্তারা সন্দীহান হলেও তিন বাহিনীর সেনাপ্রধানরা কেন প্রতিবাদের বদলে সরকারের প্রস্তাবে সায় দিচ্ছেন তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।তারা তাদের চাকুরিজীবনের শেষপ্রান্তে এসে চিফ অব দ্য ডিফেন্স স্টাফ হওয়ার স্বপ্ন তো দেখছেনই।তার সঙ্গে আছে উচ্চহারে পেনশন ও অন্যান্য বহু আকর্ষনীয় সুযোগসুবিধা। তাছাড়া আছে বিভিন্ন কমিশনে আকর্ষনীয় বেতন ও ভাতায় নিয়োগ।

এই বিষয়ে একটা ব্যাপার উল্লেখ করা যাক, প্রাক্তন চিফ অব দ্য ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত এই ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী ছিলেন।তিনি মনে করতেন এর ফলে সেনাবাহিনীর মূল কাঠামোটাই নড়বড়ে হয়ে যাবে।সেনাবাহিনী একাত্ম হয়ে দেশকে রক্ষার জন্য আত্মবলিদানের উদ্দেশ্যে হাতিয়ার তুলে নেন।চার বছরের জন্য নিয়োজিত অগ্নিবীরেরা কিভাবে নিজেদের অনুপ্রাণিত করে দেশরক্ষা করার শপথ গ্রহণ করবেন। যদি তার একাংশও নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেনও তাহলে তাদের কোন সামাজিক নিরাপত্তা থাকবে না? তাছাড়া কি এই ব্যবস্থার ফলে সেনাবাহিনী আগামীদিনে একটা রক্ষী সরবরাহ করার এজেন্সিতে পরিণিত হবে বিজেপির ইচ্ছায়? তাই আজ একথা বলতেই হবে যে গত ৭৫ বছর ধরে দেশের সেনাবাহিনী যে ধর্মনিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক চরিত্র কংগ্রেস শাসনে অব্যাহত রেখেছিল তা আজ চ্যালেঞ্জের মুখে।

কৃষি আইন প্রত্যাহারের সময় বা নোটবন্দী ও জিএসটি চালুর সময় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের প্রতি মোদির বাণী যা ছিল এবারেও তা একইরকম।তিনি এবারেও বলেছেন ” এটা দেশের দুর্ভাগ্য যে ভাল উদ্দেশ্যে আনা অনেক ভাল জিনিস রাজনৈতিক রঙে আটকা পড়ে যায়।টিআরপির বাধ্যবাধকতায় সংবাদমাধ্যমও তাতে জড়িয়ে পড়ে।” কি আশ্চর্য গোদি মিডিয়াও তাহলে তার মতে একই দোষে দোষী!!

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *