দেবপ্রসাদ রায়
সুভাষ ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসেই ইংল্যান্ড থেকে দেশবন্ধুকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল, যদিও আই.সি.এস পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে চতুর্থ স্থান দখল করে উত্তীর্ণ হয়েছে,তাঁর বৃটিশের গোলামী করার আদৌ কোন ইচ্ছে নেই, সে দেশে ফিরে এমন কোন কাজে নিযুক্ত হতে চায়, যা’ দেশের ও দশের স্বার্থরক্ষার অনুকূল হবে । তবে নিজের ইচ্ছে যে জাতীয় কলেজে অধ্যাপনা করার- সে কথাও জানাতে ভোলেনি । একুশ সালের নভেম্বরে ফিরে এলেন দেশের মাটিতে । গান্ধী, তখন বম্বেতে । দেখা হলো দু জনের । তিনটি প্রশ্ন নিয়ে গিয়েছিলেন, গান্ধীর উত্তর তাঁকে দিশা দেখাতে পারেনি । কোলকাতায় এসে দেশবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ হোল । দেখা একবার আগেও হয়েছিল, ‘১৬ সালে- প্রেসিডেন্সী কলেজে ওটেন কান্ডের পর সুভাষ চিত্তরঞ্জনের কাছেই প্রথম এসেছিলেন-সেই প্রথম গুরু শিষ্যের একে অপরের সাথে পরিচয় ।
এবার সুভাষ অন্য মানুষটিকে দেখলেন । সেই আগের বৈভবের প্রতিমূর্ত্তি বদলে গিয়ে এক সাধকের চেহারা নিয়েছে । সুভাষ তখনই ভেবে নিলেন, এই মানুষটিই হবেন তাঁর ভবিষ্যত জীবনের কান্ডারী-পথপ্রদর্শক ।
এদিকে মহাত্মার নেতৃত্বে খিলাফৎ আন্দোলন তাঁর গতি হারিয়েছে তুরস্কে গাজী আব্দাল কামাল পাশা নিজেই যখন খলিফার পদ বিলুপ্তিকরণের ঘোষণা করে দিয়েছে । দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে এক শুন্যতা বিরাজ করছে । বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি চিত্তরঞ্জন ঘোষণা করলেন প্রিন্স অব অয়েলস-এর কোলকাতা আগমন বয়কট করা হবে । শুরু হলো আইন অমান্য । প্রথম দিকটায় আন্দোলন তেমন গতি পায় নি । দেশবন্ধু দেখলেন, এ আন্দোলনকে সর্বাত্মক চেহারা দিতে হলে লড়াইটাকে নিজের কাঁধে তুলে নিতে হবে । প্রথমে পুত্র চিররঞ্জন ও পরে বাসন্তী দেবী কারাবরণ করাতে রাতারাতি এ আন্দোলন গণ আন্দোলনের চেহারা নিয়ে নিল ।এই দিনগুলোতে সুভাষ সর্বক্ষণ দেশবন্ধুর পাশে, কি কারাগারের বাইরে কি কারাগারের অভ্যন্তরে ।
‘২২শে, গয়া কংগ্রেসে দেশবন্ধু জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি । যদিও অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ভাষায় কাউন্সিলে অংশগ্রহনের পক্ষে তাঁর সভাপতির ভাষণে সওয়াল করলেন – প্রস্তাব ভোটাভূটিতে পরাস্ত হলো, কারণ গান্ধী কাউন্সিলে প্রবেশের বিপক্ষে । মোতিলাল নেহরু ও দেশবন্ধু কংপ্রেস থেকে বেরিয়ে স্বরাজ্য দল গঠন করলেন । ‘২৩শে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পদে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, তাঁর মধ্যস্থতায় দুই দলের ভেতর সমঝোতা হলো, স্বরাজ্য দল কংগ্রসেরই মনোনীত সংস্থা হিসেবে কাজ করবে ।
‘২৩শে স্বরাজ্যদল কাউন্সিল নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য পেল । দেশবন্ধু বঙ্গীয় প্রাদেশিক সংসদে আর মোতিলাল জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়ে এলেন । তারপরই কোলকাতা করপোরেশনের নির্বাচনেও একই সাফল্যের পূনরাবৃত্তি হল । দেশবন্ধু মেয়র পদে নির্বাচিত হলেন, সুভাষ সিইও। ‘২৪শে ১৮১৮ সালের regulation(III) আইনে সুভাষকে গ্রেপ্তার করা হল । প্রথম এক বছর দেশে, বহরমপুর জেলে, পরের তিন বছর কাটলো বার্মার মান্দালয় ও ইনসিন কারাগারে। ‘২৭শে মূক্তি পেয়ে যোগ দিলেন মাদ্রাজ কংগ্রেসে । রক্ষণশীল নেতাদের বিরুদ্ধে দুই তরুন তুর্কী জহরলাল ও সুভাষ, নিজেদের অবস্থান ষ্পষ্ট করতে গড়ে তুললেন, ইনডিপেডেন্স ফর ইন্ডিয়া লীগ ।
সুভাষ কখনো কংগ্রেসে, স্বছন্দ বোধ করেন নি। ‘২৮শে কোলকাতা কংগ্রেস । সুভাষ সামরিক কায়দায় জি.ও.সির ভূমিকায় কংগ্রেস সভাপতি মোতিলাল নেহরুকে হাওড়া থেকে নিয়ে এলেন অশ্ব বাহিত শকটে বসিয়ে । তা্ঁর এই উদ্যোগ গান্ধী খোলামনে নিতে পারলেন না। তাঁর এই শোভাযাত্রাকে পার্কসার্কাসের সার্কাস বলে কটাক্ষ, নিশ্চয়ই সুভাষকে ব্যথিত করেছিল। অথচ কেবল শ্বেতাঙ্গখচিত সাইমন কমিশনের আগমনের প্রতিবাদে সে বছরই কোলকাতায় সুভাষের নেতৃত্বে বয়কট আন্দোলন এতটাই সফল হয়েছিল যে জহরলাল অন্যান্য রাজ্যগুলোকে বাংলার উদাহরণ দিয়ে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন।
‘২৮শে মোতিলাল নেহরুর রিপোর্ট গ্রহণ করা নিয়ে বিতর্ক হলে নেহরুও ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের’ প্রস্তাবের বিরুদ্ধ বক্তৃতা করে বলেন যে, অষ্ট্রেলিয়া শ্বেতাঙ্গ কলোনী । যাঁরা শাসক ও যাঁরা শাসিত, তাঁরা একই জনগোষ্ঠীর লোক । তাঁদের সাথে ভারতের তুলনা চলেনা । কিন্তু সুভাষ যখন ভোট চাইলেন, তখন জহরলাল ভোটদান থেকে বিরত রইলেন । সুভাষের সংশোধনী ৯৫০ – ১৩৫০ ভোটের ব্যবধানে বাতিল হল।
অবশেষে ‘২৯শের লাহোর কংগ্রেসে পূর্ণ স্বরাজের দাবী গৃহীত হল । ওয়ার্কিং কমিটি গঠন হলে সুভাষ দেখলেন, তিনি তাঁর এক সহযোগী বাদ পড়েছেন। সুভাষ ভোট চাইলেন ও উপেক্ষিত হলেন । ‘৩০ শের ১লা জানুয়ারী ‘ডেমক্রেটিক কংগ্রেস পার্টি’ নামে নুতন দল ঘোষণা করলেন। ‘৩০শে আবার কারাবাস । এবং জেল থেকেই কোলকাতা করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচিত হলেন । মূক্তি পেলেন সেপ্টেম্বরে । বেশীদিন বাইরে থাকা হলো না, ‘৩২শেই আবার গ্রেপ্তার । এবার গোপনে তাঁকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হল। কিন্তু সুভাষ বসে থাকেনি । ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনে নিজেকে নিয়োজিত করলেন । ১৯৩৩ শে লন্ডনে তৃতীয় ভারতীয় রাজনৈতিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি স্বাধীনতত্তোর ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে সওয়াল করে তাঁর নিজের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করে দেন। ১৯৩৪-এ ভিয়েনা থেকে শুরু হল ‘ফ্রী ইন্ডিয়া সেন্টার’ পরিচালনা । এখানে অবস্থানকালীন লিখতে শুরু করেন ‘দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ । স্টেনোগ্রাফারের প্রয়োজনে এখানেই পরিচয় এমিলিয়ের সাথে । ‘৩৬শে দেশে ফিরে আবার গ্রেপ্তার । অবশেষে, ‘৩৭শে অসুস্থতার কারণে মূক্তি পেলেন ।
১৯৩৫শে ঘোষিত ‘গভর্ণমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’ -অনুসারে দেশে নির্বাচন করানোর সিদ্ধান্ত হলে, কংগ্রেস তা’তে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হল । সুভাষ জেলে । নেহরুই কংগ্রেস সভাপতি ও নির্বাচনী প্রচারের প্রধান কান্ডারী। ‘৩৭শের নির্বাচনে ১১টি রাজ্যের ভেতর ৮টি রাজ্যে কংগ্রেসের সরকার হল । সুভাষ তখন বিদেশে । ‘৩৮শে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হলেন । হরিপুরা কংগ্রেসে তিনি গঠন করলেন ‘ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি’ । জহরলাল চেয়ারম্যান । ‘৩৯শে গান্ধীর মতের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দিতা করে জয়লাভ । গান্ধী তাঁর অসন্তোষ গোপন করলেন না । তিনি প্রকাশ্যেই বল্লেন, ‘পট্টভীর পরাজয়, আমার পরাজয়’ । গোবিন্দ বল্লভ পন্থ ২২শে ফেব্রয়ারী ওয়ার্ধায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সভায় প্রস্তাব পাশ করলেন, দেশের এই সঙ্কটে গান্ধীকে বাইরে রেখে কোন আন্দোলন হতে পারেনা,তাই ওনার মনোনীত ব্যাক্তিদের নিয়েই সুভাষকে সি.ডব্লু.সি তৈরি করতে,হবে । ডাক্তারের নিষেধ সত্বেও অসুস্থ সুভাষ ওয়ার্ধা গিয়ে গান্ধীর আশীর্বাদ চেয়েও ব্যর্থ হলেন । অবশ্য তার আগে একবার ফেব্রুয়ারীতেই শান্তিনিকেতনে নেহরু ও সুভাষের মধ্যে সমস্যা মেটানোর চেষ্টায় মিটিং হয়েছিল। এবং পন্থ প্রস্তাব অনুযায়ী বারোজন সদস্য পদত্যাগ করলেও জহর ও শরত বোস এর বাইরে ছিলেন।
পরিস্থিতি সুভাষকে আলাদা দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে, এবং ‘৪০শে রামগড়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনের পাশেই সুভাষ সভা করে ফরোয়ার্ড ব্লক গঠনের কথা ঘোষণা করেন।
১৯৪১-শের সেপ্টেম্বরে মহানিষ্ক্রমণ ও তারপর আর এক ইতিহাস! আজাদ হিন্দ বাহিনী ময়রাংয়ে এসে থমকে যায় । সুভাষের মহাকাব্যও এখানে এসে অসম্পূর্ণ রয়ে যায় । কিন্তু কেন ? এ মহাকাব্যের এই পরিনতিই কি অবধারিত ছিল?
১৯৩৪শে সুভাষ যখন ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল লিখছেন, তখন তাঁর নিজের উক্তি, ‘কংগ্রেসে একটা শক্তিশালী বাম প্রতিপক্ষ আছে এবং আমি নিজেকে তাঁদেরই একজন বলে মনে করি’। ঘটনাচক্রে ১৯৩৪ সালেই কম্যুনিষ্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় । তাঁরা সদলবলে কংগ্রেসে আশ্রয়গ্রহণ করে। সুভাষ কি তাঁদের ভরসাতেই গান্ধীর অমতেও ত্রিপুরীতে প্রতিদ্বন্দিতা করেছিলেন ? তাঁরা সেদিন পাশে না দাঁড়ালে তো পদত্যাগ করতে হতো, না দেশ ছাড়তে হতো।
গান্ধী মহাপুরুষ ছিলেন । পান্নালাল দাশগুপ্ত তাঁর “গান্ধী গবেষনা”য় ‘গান্ধীই ভারত, ভারতই গান্ধী’ লিখতেও দ্বিধা বোধ করেন নি । কিন্তু সে গান্ধীকে সুভাষ পায় নি । ১৯২৫শেই চিত্তরঞ্জনের অকাল প্রয়াণের পর সুভাষকে বঞ্চিত করে, যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি, কোলকাতা করপোরেশনের মেয়র ও স্বরাজ্য পার্টির নেতা নিযুক্ত করে সুভাষকে কি বার্তা দেওয়া হয়েছিল, তুমি এ দলে বাঞ্ছিত নও !
‘২৮শের কোলকাতা অধিবেশনে সুভাষের সংশোধনী প্রত্যাখ্যাত হয়, পরে জানা যায়, গান্ধী বলে রেখেছিলেন সুভাষের সংশোধনী গৃহীত হলে আমি রাজনীতি থেকে অবসর নেবো । কাজেই কেবল ত্রিপুরী নয়, সুভাষের কংগ্রেস পরিক্রমা বার বার ব্যাহত হয়েছে গান্ধীর অসহযোগিতায়। গান্ধী বম্বের প্রথম সাক্ষাতেই বুঝে গিয়েছিলেন এই ‘বিদ্রোহী সন্তান’ নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, তাই তিনি মাঝে মাঝেই তাঁর প্রতি নিষ্ঠুর । সুভাষও কি প্রথম দর্শনেই ভেবে নিয়েছিলেন, আমি যা্কে খুঁজে ফিরছি ইনি সে নন !
১৯৩৪শে সুভাষ ‘ইন্ডিয়ান স্ট্রাগলে’ লিখছেন, ‘……আমার একটি প্রশ্নের জবাব উনি দিতে পারলেও বাকী দুটি প্রশ্নের কোন সদুত্তর পেলাম না । আমার পরিষ্কার মনে হল, ওনার আন্দোলনের ভবিষ্যত রূপরেখা নিয়ে, ওনার নিজেরই বিভ্রান্তি আছে এবং উনি নিজেই জানেন না উনি কোথায় যেতে চাইছেন । একই সাথে লিখছেন, “হঠাৎ মনে পরে গেল, একজন তো আছেন, যিনি প্রয়োজনে নিজের সব বিলিয়ে দিতে পারেন আবার প্রয়োজনে অন্যের সব কিছুও দাবী করতে পারেন । তাঁর উপর ভরসা করা যায়, নবীনত্ব তাঁর হৃদয়ের কাছের, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেল্লাম তাঁর নেতৃত্বেই নিজেকে সঁপে দেবো”।
দেশবন্ধুর প্রতি সুভাষের শ্রদ্ধার গভীরতা আরও বেশী মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর মহাপ্রয়াণের অব্যবহিত পরেই (২৫/৬/২৫) মান্দালয় জেল থেকে বন্ধুবর দিলীপ রায়কে লেখা চিঠিতেঃ ….. “তুমি জানো আজকের দিনে কি সে আমার মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে।আমার বিশ্বাস আমাদের সকলেরই একই চিন্তা–সে হচ্ছে মহাত্মা দেশবন্ধুর দেহত্যাগ । কাগজে যখন এই দারুণ সংবাদ দেখি তখন এ দুটো চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু হায়! সংবাদটা নিতান্তই নির্মম সত্য । আমরা–সমগ্র জাতিটাই –যেন নিতান্ত হতভাগ্য বলে মনে হচ্ছে।…….”আমি শুধু এই কথাটা বলতে চাই যে সমগ্র দেশের ক্ষতি যদি অপূরণীয় হয়ে থাকে, বাংলার যুবকদের পক্ষে এ একটা সব চেয়ে বড় সর্বনাশ–সত্যই এটা আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। …….”আজকের এই দিনে এত বিচলিত ও শোকাচ্ছন্ন হয়েছি এবং সেই সঙ্গে মনোজগতে সেই স্বর্গীয় মহাত্মার এত কাছাকাছি নিজেকে অনুভব করছি যে, তাঁর গুনাবলী বিশ্লেষন করে তাঁর সম্বন্ধে কিছু লেখা মোটেই সম্ভব নয়। আমি তাঁর অত্যন্ত কাছ থেকে নিতান্ত অসতর্ক মুহুর্তগুলিতে তাঁর যে ছবি দেখেছিলাম, সময় এলে জগতের সামনে তার কথন্চিৎ আভাস দিতে পারবো আশা করি।তাঁর সম্বন্ধে আমার মতই যাঁরা অনেক কথাই জানেন, তাঁরা পারলেও আজ কিছু বলতে সাহস করছেন না, আশঙ্কা হয়, তার মহত্তের সম্পূর্ণ পরিচয় দিতে না পেরে পাছে তাকে ছোট করে ফেলেন।”
আপাত বিরোধিতা সত্বেও গান্ধীর প্রতি শেষ প্রনাম জানাতে গিয়ে যে সন্মান সুভাষ দেখিয়েছিল, পরবর্তীতে গোটা দেশ গান্ধীকে সেই পরিচয়েই চিনেছে । ১৯৪৪ শের ৬ই জুলাই সুভাষ মনিপুর সীমান্তে এসে বেতার ভাষনে বল্লেন, “বাপু, তুমি জাতির পিতা। আশীর্বাদ করো আমি যেন এ যুদ্ধে জয়ী হই। আর গান্ধী বল্লেন’, “আমার একটা ছেলে, আমার থেকে আলাদা হয়ে গেল”!
জহরলাল বড় ভাইয়ের স্নেহে সুভাষকে নিয়ে চলতে চেয়েছে, কিন্তু সুভাষ মাঝে মাঝেই জহরের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ‘২৭শে ইনডিপেডেন্স ফর ইন্ডিয়া লীগের কমিটি গঠন নিয়ে মত পার্থক্য, ‘২৮শে সুভাষের সংশোধনীতে ভোট দানে বিরত থাকা ও পরবর্তীতে ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির সচিব এইচ.ভি.কামাথের আচরণ নিয়ে মত পার্থক্য- সম্পর্কটাকে সহজ হতে দেয়নি। নিয়তিও খানিকটা বিরূপ ছিল, তাই দুজনের কেউই নিজের সভাপতিত্বের কালে অপরকে পা’ননি । জহর যখন সভাপতি, সুভাষ তখন জেলে । সুভাষ যখন সভাপতি, তখন জহর ইউরোপে ।
সুভাষ আর এমিলিয়ের পরিচয় ১৯৩৪ সালে । প্রথম যখন দেশ জানলো সুভাষের বিদেশে পরিবার আছে, তখন প্রচার ছিল, ১৯৪১শে তাঁরা পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন । পরবর্তীতে এমিলিয়ে জানিয়েছেন, তাঁরা বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন ১৯৩৭শের ২৬ ডিসেম্বর । আরও জানান, তাঁরা ঠিক করেছিলেন যে, এই সম্পর্কটা গোপন রাখবেন । এই গোপনীয়তাও কি সুভাষের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে কোন অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল? আত্মজীবনী, “ভারত পথিক” শেষ করে যেতে পারেন নি। তাঁর ভারত জয়ও ময়রাংয়ে এসে থমকে গেছে, আর তাই “তরুণের স্বপ্ন” ও অধরা থেকে গেছে ।
ছাত্রাবস্থায় প্রতি বছর ২৩শে জানুয়ারী দেওয়ালে পোষ্টার দেখতাম, নেতাজীর ছবি আর তার নীচে লেখা ‘তোমার আসন শুন্য আজি হে বীর পূর্ণ করো’ । আজ সবাই জেনে গিয়েছে এ আসন আর পূর্ণ হবে না। তবে জলপাইগুড়ির হনুমান মন্দিরে ইতিমধ্যেই রাম, সীতা হনুমানের সাথে সুভাষও পূজিত হতে শুরু হয়েছে অনেক দিন। কাজেই কোন আসনে তিনি আসীন হবেন, এই অখ্যাত মন্দিরটি সে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে।