আজকের আতঙ্কের ভারতবর্ষ —
সৌমিত্র দস্তিদার:
(*বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র নির্মাতা*)
শৈবাল মিত্র একটি ছবি করেছেন। নামটা ইংরেজি। হোলি কন্সপিরেসি। সোজা বাংলায় পবিত্র ষড়যন্ত্র। আদ্যন্ত রাজনৈতিক এই ছবিটি প্রথম ঘরোয়া ভাবে দেখি, বেশ কয়েক মাস আগে। হলে চেনা জানা পঞ্চাশ ষাটজন দর্শক। এখনও মনে আছে ছবিটি দেখতে দেখতে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে যাচ্ছিল মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে।
শৈবাল অনেক দিন ধরেই চমৎকার সব ছবি করেছে। একাধিক প্রাইজটাইজ পেয়েওছে।কিন্তু ওর এবারের ছবি নির্মাণ, বিষয়বস্তু সবদিক দিয়ে নিশ্চিত আগামীদিনে ওকে গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা করিয়েদের সঙ্গে এক আসনে বসিয়ে দেবে। আমি অন্তত মনে করতে পারছিনা যে শেষ কবে এমন শক্তিশালী বাংলা ছবি দেখেছি।
ছবির কাহিনী নিয়ে এক লাইন লিখব না। ফর্ম নিয়েও না। সোজা কথা এখানে সোজা সাপটা বলেছেন পরিচালক। এমন সোজাসাপ্টা যা দেখতে দেখতে আজকের ভারত আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে। যে ভারতে আজ ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। যেখানে মিথ্যে অজুহাতে মানুষের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। যেখানে স্ট্যান স্বামীর মতো সর্বজনশ্রদ্ধেয় সমাজকর্মী কেও ইচ্ছে করে জেলের মধ্যে মেরে ফেলা হয়। যে দেশে দলিত, আদিবাসী সংখ্যা লঘু দের প্রতিনিয়ত খুন হতে দেখি আমরা। যে দেশে বহুত্ববাদী চিন্তার বদলে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সংঘ পরিবারের এক মাত্রিক হিন্দুত্ববাদ, যেখানে ইতিহাস কে বদলে দেওয়া আজকের রেওয়াজ, সেই ভারত উঠে আসে শৈবালের ছবিতে। যতটুকু মনে হয় শৈবালের এ ছবির সূত্র বোধহয় ১৯২৫এ আমেরিকার এক ছোট্ট শহরের ঘটনা। যা এক সময় সারা দুনিয়ায় আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। এক খৃষ্টান শিক্ষক সেখানে পৃথিবীর বিবর্তন নিয়ে ডারউইন তত্ত্ব ক্লাসে পড়ানোর ” অপরাধে”তাকে অ্যারেস্ট করা হয়। ফলে বিষয়টি নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে সেই সময়ে তুমুল হৈচৈ হয়েছিল আমেরিকায় তো বটেই, সারা বিশ্বেই। দীর্ঘ শুনানি হয়েছিল কোর্টে। যা আজও মাঙ্কি ট্রায়াল বলে খ্যাত।
মনে রাখতে হবে সেসময় আমেরিকার রাজনীতির এক কলঙ্ক জনক অধ্যায়। কুখ্যাত ম্যাককার্থি ডালেসের যুগ।
সে আমলে চার্লি চ্যাপলিনের মতো বিশ্ববিখ্যাত সিনেমা ব্যাক্তিত্বের ওপরেও নেমে এসেছিল সরকারের রোষানল। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন চ্যাপলিন। সেই অন্ধকার সময়ের সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্য আজকের ভারতের। শৈবালের ছবিতে নানা শেড। বহু মাত্রা। জোর জবরদস্তি করে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়া তো আছেই। এছাড়াও এদেশের আদিবাসী, দলিত মুসলমানদের কিভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে তোলা হচ্ছে তারও স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। ইঙ্গিত কিন্তু কোন রাখঢাক নেই পরিচালকের বক্তব্যে। সিনেমার আর এক বিশেষত্ব যে এখানে কোন শ্লোগান নেই। নীরবতাও কেমন প্রতি বাদের ভাষা হতে পারে শৈবাল তা করে দেখিয়েছেন। সেলুলয়েডে শৈবাল কখনো কখনো বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত বা সমর সেনের কবিতা যেন আমাদের নতুন করে মনে করিয়ে দিলেন। হোলি কন্সপিরেসি আসলেই এক আনহোলি অ্যালায়েন্সের কথা বলে।
যেখানে চরম দক্ষিণ পন্থী রাজনীতি, সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদ আর দুনিয়ার মৌলবাদ একাকার হয়ে গিয়ে এক নতুন ফ্যাসিবাদের কথা বলে। ছবির শেষ কিন্তু আশাবাদ দিয়ে। এটাতো ঠিক যে নিকষ অন্ধকার কখনো কোথাও শেষ পরিনতি নয়। জীবনে এবং সভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার পথে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)