অশোক ভট্টাচার্য ( রাজা)
একটা প্রায় ঘোষিত ‘ইতিহাস আশ্রিত’ সিনেমায় ইতিহাস থেকে বিচ্যুত হওয়া কেবল ভুল নয়, অপরাধ। ফলতঃ প্রশ্ন উঠলে তখন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি হয়েছে ; শিল্পের দোহাই দিয়ে ‘বিধান রায়’ নয় সিনেমার চরিত্র ‘বিমান রায়’-কেই দেখতে হবে–এমন যুক্তি নেহাৎই জোলো। এই গৌরচন্দ্রিকার উপস্থাপন এই কারণেই যে, এই প্রতিবেদনের পরপরই একটা অংশ সিনেমা ও ইতিহাসের তফাৎ কিম্বা শিল্পীর কল্পনার সঙ্গে বাস্তব ইতিহাসের ফারাক নিয়ে তত্ত্বগর্ভ কথা বলবেন। তাঁদের উদ্দেশে প্রথমেই বলে রাখি যে, আগে ঠিক করে নিন অনীক দত্তের ‘অপরাজিত’ নিছক সিনেমা? নাকি ইতিহাস আশ্রিত একটা দলিলের চিত্রায়ণ? কোনটা? প্রথম প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হলে কোনো কথা নেই ; সেক্ষেত্রে ‘বিমান রায়’-কেই মেনে নিতে হবে। কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে তীব্র প্রশ্নবান আছে।
বিধান রায়ের কাছে সত্যজিত রায় গেলে সুকুমার-পুত্রের সিনেমা যাতে পয়সার জন্য না আটকায় তার জন্য নড়েচড়ে বসেন বিধান বাবু। কিন্তু সরকারতো এভাবে কোনো ছবি করার জন্য সরাসরি পয়সা দিতে পারেনা। বিধান বাবু তখন সত্যজিত-কে বলেন, ছবির শেষ দিকটা বদলে দিয়ে সরকারের গ্রাম-উন্নয়ণের ব্যাপারে প্রচারমূলক চিত্রনাট্য জুড়ে দিতে। সত্যজিৎ তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানান। বিধান বাবু তাঁর সচিবকে ডেকে পাঠালে তিনিও আইনগত কারণে সরকারের অপারগতার কথা উল্লেখ করেন। এরপর বিধান রায় তাঁর সচিবকে বলেন, “কেমন আই.এস হয়েছ হে? আইন যেমন আছে তেমন আইনের ফাঁকও আছে..।” এই বলে সত্যজিৎ-কে বিধান রায় বলেন, তিনি ‘জাজ’ করছিলেন সত্যজিৎ-কে। শেষ পর্যন্ত চিত্রনাট্যে কিছু বদলাতে হয় না, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গ্রামোন্নায়ণ মন্ত্রকের তহবিল থেকে ছবি তৈরির অর্থানুকূল্য মেলে ‘পথের পাঁচালী’ র জন্য। এই হলো ইতিহাস।
কিন্তু এই অংশে অনীক দত্তের ছবির চিত্রনাট্যটা এই রকম…
সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রে অপরাজিত রায় বিমান রায় (বিধান) এর কাছে এসেছেন , সিনেমার জন্য সরকারি টাকা চাইতে, আলাপ করাচ্ছেন সচিব (বোধহয়)।অপরাজিত রায় বিমান রায় কে গল্প টি বললেন, ব্যস্ত বিমান বাবু কাজের ফাঁকেই শুনছিলেন, শেষ টা শুনে তিনি বললেন
বিমান – সেকি গ্রাম ছেড়ে বেনারস কেন যাবে ? কলকাতা কেন না?
অপরাজিত – উনি যজমানি করতেন, তাই ….
বিমান – ও বটে ! তা শেষ টা কেমন ট্র্যাজেডি, এক কাজ করুন আমাদের সরকার ডেভলপমেন্ট এর অনেক কাজ করছে, গ্রামের উন্নয়ন, হরিহর কে বরং ব্যাংক লোন এ একটা ট্রাক্টর পাইয়ে দিয়ে গ্রামেই রেখে দিন, (প্রসঙ্গত বিধান বাবু র সময় তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ ছিল না, যার জন্য সিনেমা ফান্ডিং এর দপ্তর সেভাবে ছিল না, উনি বোধহয় তখন কৃষি দপ্তরের বা গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক থেকে কিছু বরাদ্দ করিয়েছিলেন টাকা)
অপরাজিত – না, মানে এটা তো বিভূতি বাবু এরকমই লিখেছেন
বিমান – আরে মশাই, আমার নাম করে বলুন পাল্টে দিতে শেষ টা
এর পর অপরাজিত র সহায়িকা একজন ভদ্রমহিলা – না , বিভূতি বাবু তো চলে গেছেন
বিমান – চলে গেছেন ? তা ফিরলে বলবেন পাল্টে দিতে
ভদ্রমহিলা – চলে গেছেন মানে উনি এ ছেড়ে চলে গেছেন
বিমান – ওহ! দেখেছেন এই সব কাজে এসব সাহিত্যের কথা খেয়ালই থাকেনা
অপরাজিত – তাহলে সিনেমার ফান্ডিং এর ব্যাপারটা
সচিব – সিনেমার নামে যখন পথ আছে …
বিমান – হ্যাঁ সড়ক নির্মাণ দপ্তর থেকে যদি কিছু করা যায়, PWD থেকে দেখুন যদি কিছু ফান্ড এর ব্যবস্থা করা যায়…
–মোদ্দা কথা দাঁড়ালো এই যে পরিচালকের চিত্রনাট্য অনুযায়ী, বিভূতিভূষণ যে তখন মৃত তা নাকি বিধান রায় জানতেনই না, সাহিত্য সংস্কৃতি বিধান রায় বুঝতেনই না এবং পরান বন্দোপাধ্যায়ের অভিনয়ে বিধান রায় হয়ে উঠলেন একজন সিরিও কমিক চরিত্র! অথচ প্রকৃত ইতিহাস তা নয়।
বিধান রায়ের হাস্যরস ছিলো অনেক বুদ্ধিদীপ্ত সম্পূর্ণ বা ‘উইট’-এ ভরা। তখন অধ্যাপনার চাকরিতেও পুলিশ ভেরিফিকেশনের চল ছিলো। বিপদে পড়লেন বামপন্থী কবি, অধ্যাপনার চাকুরী প্রার্থী তরুণ সান্যাল। বাম আন্দোলন করার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় অভিযোগ। বাম অধ্যাপক নেতা দিলীপ চক্রবর্তী তরুণ বাবুকে নিয়ে বিধান রায়ের কাছে গেলেন। সব শুনে তদানীন্তন শিক্ষা অধিকর্তা ডি.এন.সেন( ধীরেন সেন)-কে ডেকে বিধান রায় বললেন, “এই সব বামপন্থী লোকজন বাইরে থাকলেই বেশি বিপদ, বরং এরা কলেজের ভিতরেই থাক..”। এই ছিলো বিধান রায়ের ‘উইট’; এখন এর মানে কি –বিধান রায় অধ্যাপনা কিম্বা প্রশাসন কোনোটাই বুঝতেন না?
একবার প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের জন্য ফাংশন হবে, সব তাবড় শিল্পীরা পারফর্ম করবেন। বিধান রায় গায়ক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকেও আমন্ত্রণ জানালে ধনঞ্জয় বেঁকে বসে বললেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান সুতরাং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নেহরু না বললে তিনি গাইবেন না। বিধান রায় সব শুনে ধনঞ্জয়ের উদ্দেশে মন্তব্য করেছিলেন, ” এ ছেলের গাটস আছে..”। এবং বিধান বাবু ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে দিয়ে গান গাওয়ানোর জন্য নেহরুর লিখিত আবেদন আনালেনও।
সত্যজিত রায়ের ওই চিত্রনাট্য না বদলানোর কথাতেও বিধান চন্দ্র রায় সেই ‘গাটস’ খুঁজে পেয়েছিলেন। তার পরের টা ইতিহাস। বিধান রায় না এগিয়ে আসলে একটা ‘পথের পাঁচালী’ বাস্তবায়িত হতো না।
মোদ্দা কথা। সরকারি অর্থ ওভাবে দেওয়া যায় না। তাই ছবির চিত্রনাট্য বদলানোর কথা বলেছিলেন বিধান রায়, তাও সত্যজিত রায়কে বাজিয়ে দ্যাখার জন্য। বিভূতিভূষণকে গল্প বদলাতে বলেননি বিধান বাবু। বিভূতি বাবু তখন ইহলোকে নেই এটা প্রখর স্মৃতি শক্তি ও মেধা সম্পন্ন বিধান রায়ের মনে ছিলোনা –এটা কি আদেও বিশ্বাসযোগ্য? আসলে এমন কোনো কথাই বিধান রায় বলেননি। বলেছিলেন সম্পূর্ণ অন্য কথা।
এগুলোর কোনোটাই অনীক দত্তের অজানা, এমন বলা ও ভাবাটা মুর্খামি হবে। তা’লে?
হতেই পারে পরিচালক তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক ও জীবন দর্শনের অনুগামী হয়ে বিধান রায়-কে দ্যাখাতে চেয়েছেন। সে স্বাধীনতা তাঁর আছে। পাল্টা প্রকৃত ইতিহাস মানুষের কাছে তুলে ধরার কাজ, সেটাও আমাদের দায়বদ্ধতা।
শেষ করার আগে বলি। সব থেকে বড় পাওনা দেবজ্যোতি মিশ্রের মিউজিক কম্পোজিশন। অনীক দত্তের ক্রিয়েশন ভাবনাও দুর্দান্ত। পাশাপাশি আপত্তি, প্রতিবাদ সেটাও রইলো। কারণ ইতিহাস দর্শনের অনুগত নয়; কালের মন্দিরা আপন নিয়মেই বেজে ওঠে।
(লেখকের মতামত ব্যক্তিগত)
(ছবি- গুগল থেকে সংগৃহীত)