সাল ১৯৪৬, নভেম্বর মাস। তখন খাল-বিলে পরিপূর্ণ পূর্ববাংলাতে নভেম্বর মাসেই রীতিমতো শীত। হাড় কাঁপানো উত্তুরে হাওয়া…তার মাঝেই আট হাতি ধুতি পরে, প্রায় অর্ধ উলঙ্গ একটা মানুষ মেঠোপথ, খাল-বিল পেরিয়ে চলেছেন নোয়াখালির পথে পথে…
একটাই লক্ষ তাঁর, একটাই পণ…নেভাতে হবেই ধর্মীয় দাঙ্গার আগুন; বাঁচাতে হবে মানবতাকে। ২৯ অক্টোবর, ১৯৪৬ কোলকাতা হয়ে ৬ নভেম্বর মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেন।
চারমাস নোয়াখালিতে ছিলেন তিনি। হেঁটে ছিলেন শান্তির জন্য। সে পথ ছিলো খুব কঠিন। কটুক্তি থেকে ইঁট-পাথর সবই ধেয়ে এসেছিলো তাঁর উদ্দেশে। তবু শান্তি প্রতিষ্ঠায় স্থির প্রতিজ্ঞ গান্ধীজি জানিয়েছিলেন…”… প্রয়োজনে নোয়াখালিতে প্রাণ ত্যাগ করতে দ্বিধা বোধ করিব না, তবু নোয়াখালি ত্যাগ করিব না…”
নোয়াখালিতে অনেকেই ছিলেন তাঁর সাথে; তবে উল্লেখযোগ্য ভাবে সুশীলা নায়ার, নির্মল বসু, কমলা দাসগুপ্ত, শামসুদ্দীন আহমেদ, কে নসরুল্লা, প্যারেলাল, মৃদুলা সারাভাই, দেবচন্দ্র ঝা, আব্দুর রশিদের নাম করতেই হয়।২০ নভেম্বর ‘৪৬ ; কাজিরখিল গ্রামে গেলেন। দিনটা তাঁর মৌন দিবস। তাই লিখলেন… ” Personally I do not think that the extent of evil is so great… “
এই প্রত্যয়ই গান্ধীজিকে নোয়াখালি শান্তি দৌত্যে শেষ পর্যন্ত লড়ার প্রেরণা জুগিয়েছিল। কাজিরখিল,শ্রীরামপুর, নয়াখোলার, সোনাচক,গোমাতিল, নন্দীগ্রাম, দত্তপাড়া, সাহাপুর বাজার….মহাত্মা হেঁটে চলেছেন দাঙ্গায় দীর্ণ – দগ্ধ এলাকার মধ্যে দিয়ে, আর দাঙ্গার অন্ধকার থেকে উঠে আসা শ্রান্ত, সব হারানো মানুষগুলোর চোখ মুখ হয়ে উঠছে উজ্জ্বল।
নোয়াখালি-দাঙ্গার ধ্বংসস্তূপের মাঝে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। সে জাগরণ ধর্মান্ধতা এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অন্ধকার চিরে এনে দিয়েছিলো ভোর…একটা ঘটনা উল্লেখ না করলে,ইতিহাসের অপলাপ হবে….
পঞ্জাবী মুসলিম নারী, মিস আমতুস সেলাম। শিবগী গ্রামে একই উদ্দেশে মহাত্মার সঙ্গে মিলিত হলেন তিনি। দাঙ্গার সময় একটি হিন্দু মন্দিরে বিগ্রহ মূর্তি র হাতে থাকা তিনটি অস্ত্র লুঠ হয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে অনশন করছিলেন আমতুস সেলাম। অনশনের পরে দুটি অস্ত্র ফিরত পাওয়া গেলেও, আর একটি পাওয়া যায়নি।
আমতুসের অনশন গান্ধীজিকে অভিভূত করেছিলো;গান্ধীজি কমলালেবুর রস খাইয়ে তাঁর অনশন ভাঙালেন। তারপর আবার পাশের গ্রাম…হেঁটেই চললেন মহাত্মা…হাতে শান্তির আলোকবর্তিকা তাঁর।
আজ ৭৫ বছর হয়ে গেলো তারপর থেকে, আজও হেঁটে চলেছেন গান্ধীজি। আটহাতি ধুতি পরে,অর্ধ উলঙ্গ, নিরাভিমানী, নিরহংকারী, জীবন সত্যের আহ্বায়ক গান্ধী… ওই দেখুন…অঙ্গুরীমালেরা উন্মত্ত আজ, নতুন করে দাঙ্গার বীজ পুঁতছে একটা শ্রেণি, ভারতের ভাগ্যাকাশে চিল-শকুন…তারই মাঝে আজও গান্ধী… রক্তভেজা পায়ে হেঁটে চলেছেন,যদি দু একটা প্রাাণের বীজ ভিজে ওঠে, সে আশায়…েে
ওই দেখুন ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ চলছে প্রেম-অহিংসা-মৈত্রী’র বারতা নিয়ে। পথ হাঁটছেন আর এক গান্ধী… রাহুল গান্ধী।
ওই দেখুন। উত্তরের হিমালয় আনত মস্তকে তাঁর বিরাটত্বের সামনে ঝুঁকে আছে, দক্ষিণ আর পশ্চিমে সমুদ্র তাঁর পা ধুইয়ে দিচ্ছে, পুবে শস্য শ্যামলা বসুন্ধরা তাঁকে নবপল্লবে বরণ করে নিচ্ছে…
কেবল আমরাই কি কেবল ছুঁয়ে দেখছি না তাঁকে! চলুন না, নিজের মতো করে ছুঁয়ে দেখি ওই মহীরুহকে…যা আশ্রয় দেয়,ছায়া দেয়,শান্তির ছাতায় ঢেকে রাখে…ভারত জোড়ো যাত্রা।
(ছবিঃ গুগল থেকে সংগৃহীত)