ব্যাংক জাতীয়করণের পিছনে নেপথ্য কাহিনী।

অভিষেক ব্যানার্জীর বিশেষ প্রতিবেদনঃ

আচ্ছা আপনারা 1956 সালে মুক্তি পাওয়া “শংকর নারায়ণ ব্যাংক ” দেখেছেন ? 1967 এর “জীবন মৃত্যু ” তো নিশ্চই দেখেছেন ? যেটা পরে 1970 এ হিন্দি তে remake হয় #Dharmendra এবং #waheeda জি কে নিয়ে !

আচ্ছা বলুন তো – এই সিনেমা দুটোর মিল কোথায় ? না, দুটোতেই মুখ্য ভূমিকায় উত্তম কুমার অভিনয় করেছিলেন বললে উত্তর টি আংশিক ঠিক হবে !কারণ শংকর নারায়ণ ব্যাংক এ মহানায়ক থাকলেও মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন ছবি বিশ্বাস ।এই সিনেমা দুটির মিল এদের গল্পের প্রেক্ষিতে — “ব্যাংক ফেল ” করা !হ্যাঁ ! ঠিক পড়েছেন -ব্যাংক ফেল !

যার সূচনা উনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে ! এর মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য সম্ভবত 1840 সালে ইস্ট ইন্ডিয়া ট্রেডিং কোম্পানির মূলধনে তৈরি হওয়া প্রেসিডেন্সি ব্যাংক অফ বম্বের 1867 সালে ফেল করা !

নিন্দুকেরা বলে – ব্যক্তিগত মূলধনে তৈরি হওয়া এই ব্যাংকের প্রমোটার এবং পশ্চিম ভারতের কিছু অসাধু তুলো ব্যবসায়ী সিপাহি বিদ্রোহের আবহকে কাজে লাগিয়ে টাকা সরাতে থাকে এবং নিজেদের পেটোয়া লোকেদের ঋণ দিতে থাকে – ফল ঋণখেলাপি – অনাদায়ী ঋণ এবং ব্যাংকের গণেশ উল্টানো –ঠিক আজকের #pnbbank এবং #niravmodi বা #MehulChoksiএর ঘটনা ।

এরপর বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে এই ব্যাংক ফেল করাটা মহামারির আকার নেয় ।স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাকি সব কিছুর মতো স্বদেশী ব্যাংক গজিয়ে উঠতে থাকে – 1913 এর হিসেব বলছে — ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় 451 খানা ব্যাংক ।আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ব্যাংক পরিচালনা তে যতটা আবেগ ছিলো অভিজ্ঞতা বা অর্থনৈতিক শৃংখলা বা প্রোমোটারদের সততা ততটা ছিলো না -তাই অবশ্যম্ভাবী ফল ব্যাংক ফেল এবং আমানতকারিদের ভরা ডুবি ।

এই যেমন ইন্ডিয়ান স্পেসি ব্যাংক; 1913 তে যখন ব্যাংক বন্ধ হয় — তখন তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায় – নেপথ্যে একজন মুক্তো ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকের তদানীন্তন কর্মীদের অসাধু যোগ সাযশ ! আজকের দিনে মুক্তোর বদলে অসাধু হীরে ব্যবসায়ীরা সেই স্থানটা নিয়েছে ।শুধু 1913-14 অর্থবর্ষে 54 টি ব্যাংক বন্ধ হয় যার সিংহ ভাগ পাঞ্জাবে – ঘটনাচক্রে এদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বড় কৃষক নয়তো জমিদার ।

আবার 1913-1966 পর্যন্ত কমবেশী 1800 ব্যাংক এর পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয় — যার সিংহ ভাগ হয় কেরালা(25℅) বাংলা (21%)এবং মাদ্রাজ (20%) এ !

এর ভিতর বিখ্যাত ‘ট্রাভানকোর এন্ড কুইলোন ‘ ব্যাংক আছে -1938 সালে যা বন্ধ হয়ে যায় !এই ক্রমাগত ব্যাংক ফেলের সুবাদে সব থেকে বিপদে পড়ছিল সাধারণ আমানতকারিরা ! শুধু সাধারণ আমানতকারিই বা বলি কি করে – যেখানে স্বয়ং রবি ঠাকুর এই ব্যাংক ফেলের ভিকটিম !

1938 সালের 30 শে জানুয়ারি বিশ্বভারতীর তদানীন্তন কর্মসচিব রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি চিঠি তে লেখেন — ‘পাতিসর কৃষি ব্যাংক ‘ এ গচ্ছিত 133571-4-6(টাকা -আনা -পয়সা ) এবং সুদ বাবদ 59657-0-4(টাকা -আনা -পয়সা ) ব্যাংক দিতে অপারগ ! প্রসংগত এই অর্থের অধিকাংশই ছিলো কবিগুরুর নোবেল প্রাইজের পুরষ্কার মূল্য ( কবিগুরুর নোবেলের গেরো চিরকালীন ) !

এই ক্রমবর্ধমান ব্যাংক ফেল এর ফলে জনমানসে শুধু যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছিলো তাই নয় দেশের অর্থনীতির ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাচ্ছিলো সাধারণ মানুষের !যার জাজ্বল্যমান প্রমাণ সেইসময়ের সিনেমা বা সাহিত্য – সময়ের নির্মম দলিল হয়ে ।

ব্যোমকেশের চিত্রচোর ও কিন্তু ব্যাংক জালিয়াতির ওপর আধারিত ।

এই সময়ে দাড়িয়ে দরকার ছিলো প্রতিকারের — system এর ওপর ভরসা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন ছিলো সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ! যার সূচনা 1949 সালে গঠিত ব্যাংকিং রেগুলেশন আইন দিয়ে , 1962 সালে আমানত বীমা স্কিম এর হাত ধরে 1969 সালে ব্যাংক জাতীয়তা করণের মাধ্যমে তা পূর্ণতা পায় ।

না তার পরেও হর্ষদ মেহতা থেকে আজকের বিজয় মালিয়া , নীরব মোদি , মেহুল চোস্কি দের সুবাদে ব্যাংক দুর্নীতি হয়েছে কিন্তু তা নিছকই ব্যতিক্রম ।

মোটের ওপর দেশের মানুষ আজ ও ব্যাংক এ তার কষ্টার্জিত টাকা জমা রাখা সুরক্ষিত মনে করে – অবশ্য কতদিন করবে তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে !সৌজন্যে -বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি — কর্ম হ্রাসমান সুদের হার তো ছিলোই তার সাথে যুক্ত হয়েছে NRBA -যেখানে অনেক আইনের একটি আইন – ব্যাংকে যত টাকাই জমা থাক – ব্যাংক ফেল করলে আমানতকারী মাত্র 5লাখ টাকা পাবেন !যাই হোক — আজ ব্যাংক জাতীয়করণের বর্ষপূর্তিতে বেশ কিছু স্বঘোষিত অর্থনীতিবিদ ব্যাংক জাতীয়করণের কুফল নিয়ে whatsapp university লব্ধ তথ্য সহযোগে খেউড় করতে ব্যস্ত! গোয়েবলসীয় নীতিতে মিথ্যাচার কে সত্যি করতে রত — তখন ইতিহাসের পাতা ঘেটে ভারতবর্ষের ব্যাংক জাতীয়করণের নেপথ্য কাহিনী আজকের উপজীব্য ।

পরিশেষে একটা ছোট পরিসংখ্যান – গত 50 বছরে ব্যাংক ফেল নিয়ে সাহিত্য বা সিনেমা বা কোন webseries (একমাত্র উদাহরণ বোধহয় scam1992যা আদতে stock market scam এবং পক্ষান্তরে কিঞ্চিত ব্যাংক জালিয়াতির প্রসংগ উল্লেখ )এমনকি রেমেক ও হয় নি ! কারণ আজকের দর্শক বিশ্বাসই করে না ব্যাংক ফেল করতে পারে ।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *