১৯ শে জুলাই : ভারতে ব্যাংক জাতীয়করণের দিন

শুভাশিস মজুমদারের প্রতিবেদনঃ

ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি ‘ব্যাংকিং কোম্পানিজ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯’ জারি করে তৎকালীন ১৪ টি সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ব ঘোষণা করেন। ১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই মধ্যরাত্রি থেকে তা কার্যকর হয়। উল্লেখ করা যায়, ভারতের মোট আমানতের ৮৫ শতাংশ এই ১৪ টি ব্যাংকে গচ্ছিত ছিল।

বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ চলছে দেশ জুড়ে। প্রতিবাদ জানিয়ে গত ১৫ ও ১৬ মার্চ দু’দিনের সারা ভারত জুড়ে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করেছিলেন প্রায় দশ লাখ সর্বস্তরের ব্যাংক কর্মচারী। বিভিন্ন ব্যাংকের শাখার সামনে বা কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিবাদস্থলে আন্দোলনকারীরা সমবেত হয়ে ভাষণদান ও স্লোগানের মাধ্যমে সমস্যার কথা তুলে ধরেন। অভূতপূর্বভাবে প্রতিবাদস্থলে এসে সহমর্মিতা ও সমর্থন জানিয়ে যান ছাত্র যুবা, সমাজকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলা কর্মী থেকে সাধারণ মানুষ। তাই এই প্রতিবাদটা সকলের হয়ে ওঠে। এই ইস্যুতে দেশজুড়ে তীব্র আওয়াজ ওঠে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। সরকারের সমর্থনে থাকা কর্পোরেট টিভি চ্যানেলগুলি এই আন্দোলনের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রচার না করায় সমালোচিত হয়েছে। এই প্রতিবাদের গুরুত্ব বুঝতে গেলে কোন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক ভারতে স্থাপন করা হয়েছিল তা বোঝা জরুরি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থা পরিচালিত ৩৬১ টি ব্যাঙ্ক দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ায় সাধারণ ভারতবাসীর সঞ্চিত অর্থ জলে যায়। ১৯৬৯ সালে কর্পোরেট পরিচালিত ব্যাঙ্কগুলিতে অনুৎপাদক সম্পদের পরিমান ছিল ২৪৩২ কোটি টাকা। যার মধ্যে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা এই ব্যাঙ্কগুলির ডাইরেক্টরদের নিজস্ব কোম্পানির নামে অনাদায়ী ঋণ হিসেবে ছিল। তখন সারা ভারতে ব্যাঙ্কের ৮২৬২ টি শাখা ছিল, যার মধ্যে মাত্র ১৮৩৩ টি গ্রামাঞ্চলে ও ৩৩৪২ টি শহরতলিতে অবস্থিত ছিল। অর্থাৎ গ্রামীন ভারত ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সুফল পেত না। মুনাফালোভী কর্পোরেটরা গ্রামাঞ্চলে ব্যাঙ্ক খোলায় উৎসাহী ছিল না। এই অবস্থায় আর্থিক উন্নয়ন ও বিকেন্দ্রীকরণের স্বার্থে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক স্থাপন করেন। সারা ভারত জুড়ে স্থাপিত হয় প্রায় দেড় লক্ষ শাখা। যার মধ্যে ৫১,৬৪৬ টি গ্রামাঞ্চলে ও প্রায় ৪১,০০০ টি শহরতলি অঞ্চলে। শহরগুলিতে তৈরি হয় প্রায় ২৮,০০০ শাখা। এর সুফল পায় আপামর জনসাধারণ। সরকারি ব্যাংক থেকে নামমাত্র সুদে ঋণ পাওয়ায় গরিব কৃষকেরা মুক্তি পায় মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নেওয়া থেকে। ব্যাংকের ঋণে কৃষকের হাতে আসে জল সেচের পাম্প, যার ফলে পূর্বের বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল একফসলি জমিতে শুরু হয় বহু ফসলের চাষ। সাফল্য আসে সবুজ বিপ্লবের। গ্রামাঞ্চলে কৃষকরা আর্থিক ভাবে সম্পন্ন হন। ক্ষেত মজুরদের অধিক কর্মসংস্থান হয়। ভারত খাদ্যে স্বনির্ভর হয়। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের ঋণে পুরুষ ও মহিলারা ঘরে ঘরে গড়ে তোলেন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। ক্রমশ তাঁদের প্রয়োজন হয় আরও কর্মীর, ফলে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়। ছোটবেলায় হাবরার (বর্তমানে উত্তর ২৪ পরগনা জেলায়) গ্রামাঞ্চলে বসবাস করায় এই প্রতিবেদক প্রত্যক্ষ করেছে, বাণিপুর অঞ্চলে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের ঋণে সেলাই মেশিন কিনে ঘরে ঘরে গড়ে ওঠে পোশাক তৈরির কারখানা। ধীরে ধীরে কর্মসংস্থান হয় প্রচুর কর্মীর। আজ সেই অঞ্চল কয়েক হাজার মানুষের রুটি রুজির ব্যবস্থা করা একটি সম্পন্ন স্থান। এমন অনেক উদাহরণ এই বাংলাতেই পাওয়া যাবে।বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক তার উল্টোপথে হাঁটছে। আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, বিজেপি সরকার যে কোন সময়ে সরকারের হাতে ব্যাংকের ন্যূনতম ৫১% সম্পদ থাকার ১৯৭০ সালের আইন (একুইজিসন এন্ড ট্রান্সফার অব আন্ডারটেকিং সেকশন ৩ পার্ট ২বি (সি)) অর্থ বিলের সাহায্যে সংসদে বদলে ফেলতে পারে। বেসরকারি ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন, যেখানে সরকারি ব্যাংক ব্যবসা করলেও ভারতের নাগরিকদের আর্থিক ও সামাজিক (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্ম প্রভৃতি) সেবা ও উন্নতিতে নিয়োজিত। সরকারের জনকল্যানকারী সমস্ত যোজনায় রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকই সঙ্গ দেয়। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকে উচ্চহারে ন্যূনতম ব্যালান্স রাখতে ও যে কোন সার্ভিসের জন্য মোটা অর্থ ব্যয় করতে হয়। সাম্প্রতিক কালে বেসরকারি পিএমসি, ইয়েস ব্যাংক, লক্ষ্মীবিলাস ব্যাংক প্রভৃতিতে চরম আর্থিক দুর্নীতি দেখা যায়। প্রচুর গ্রাহক দুর্দশায় পড়েন। আইসিআইসিআই ব্যাংকের প্রাক্তন কর্মকর্তা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত। সরকারি সংস্থা এল আই সি ও এস বি আই এগিয়ে এসেছে ইয়েস ব্যাংককে বাঁচাতে। কিছুদিন আগেই পি কে মোহান্তির নেতৃত্বে গঠিত রিজার্ভ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কমিটি ইচ্ছুক বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে ব্যাঙ্ক তৈরির লাইসেন্স দেবার জন্য সুপারিশ করেছে। এই সুপারিশের তীব্র সমালোচনা করে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন এবং ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য বলেছেন, এতে ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাই সম্পুর্ন নষ্ট হয়ে যাবে। কারন, যে কর্পোরেট সংস্থার প্রচুর ঋণের বোঝা এবং রাজনৈতিক প্রভাব আছে, অথচ ন্যূনতম পুঁজি আছে, তারাই চেষ্টা করবে ব্যাঙ্কিং লাইসেন্স নেওয়ার। কর্পোরেট সংস্থা নিজেরাই ব্যাঙ্ক চালালে কার্যত কোনো নজরদারি ছাড়াই সহজেই নিজেদের গোষ্ঠীর কোম্পানির জন্য যথেচ্ছ ঋণ নিতে পারবে। বিজেপি সরকারের বেসরকারিকরণের থাবা বীমা ক্ষেত্রেও পড়েছে। অর্থবিল ২০২১ এ ১৯৫৬ সালের জীবনবিমা নিগম আইনের পরিবর্তন করে সরকারি বীমা ক্ষেত্রেও বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ সর্বাধিক ৪৯% থেকে বাড়িয়ে ৭৪% প্রস্তাবিত হয়েছে। এর প্রতিবাদে বীমা ক্ষেত্রের কর্মীরা গত ১৭ ও ১৮ মার্চ সারা ভারতে ধর্মঘট ডেকেছিলেন। তাঁরা বলছেন, গ্রাহকদের স্বার্থ, বিমাক্ষেত্রের ৫৪ হাজার কর্মী ও ১লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার সম্পদের সুরক্ষায় তাঁদের এই আন্দোলন।কংগ্রেস ও বেশকিছু বিজেপি-বিরোধী দল বেসরকারিকরণের তীব্র বিরোধিতা করে বলেছে, নরেন্দ্র মোদী একাজ করছেন তাঁর গুটিকয় শিল্পপতির হাতেই দেশের সম্পদ তুলে দেওয়ার জন্য। ‘এসেট মনিটাইজেশনে’র নামে চলছে দেদার সরকারি সম্পদ বিক্রি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *