–অশোক ভট্টাচার্য (রাজা):
৩০ শে জুন ‘ ১৯৫৯, ভারতের মাটিতে পা দিয়েছিলেন তিনি।
বিপ্লব তো কেবল আগুন খেকো হয় না ; বরং আগুনে সমাহিত হয়ে নতুন স্বপ্নের চারা রোপণ করে সে। তা জন্ম দ্যায় উদারতার, জন্ম দ্যায় বহুত্ববাদী নির্যাসের সম্মাননা। তাই তো সম্পূর্ণ বিপরীত রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও দর্শনকে কাঁধে বহন করেও মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ নীতি ও দর্শনের প্রতি তাঁর সেই চওড়া কাঁধ বিনয়ে ঝুঁকে পড়েছিলো।
তিনি ১৪ দিনের সফরে ভারতে এসেছিলেন।
সবেমাত্র আমেরিকার মদদপুষ্ট একটা ক্যারেবিয়ান স্বৈরাচারী সরকারকে পর্যদুস্ত করে ফিদেল- চে’ দের নেতৃত্বে সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী ক্ষমতা দখল করার পরপরই ; মাত্র বারো বছর হলো স্বাধীন হয়েছে এমন একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর বুকে সেই ধক ছিলো যা প্রতিভাত হয়, বিশ্বের তাবৎ দেশগুলোকে পিছনে ফেলে এদেশের মাটিতে সদ্য স্বাধীন ফিদেল- চে ‘ র কিউবার প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রণ ও স্বাগত জানানোর ভিতর দিয়ে।
একটা ব্যাপার খুব অবাক করে ভারতের কমিউনিস্ট দলগুলোর তদানীন্তন সময়ে চে ‘র ভারত সফর নিয়ে তেমন কোন উচ্ছাস ও উন্মাদনা চোখে পড়েনি; কিম্বা ইতিহাসের মহাফেজখানায় এমন কোনো দলিল-দস্তাবেজেও চোখে পড়ে না।
হয়ত ভারত সফরে নিজের সাক্ষাৎকারে চে রাশিয়ার সমাজতন্ত্র নিয়ে আশ্চর্যজনক ভাবে নিশ্চুপ ছিলেন, তাই এদেশের কমিউনিস্টরা চে’ র ভারত সফর নিয়ে সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত তেমন উদ্বেল নন…!
চে গুভ্যেরার দিল্লি সফর চলাকালীন অল ইন্ডিয়া রেডিও তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলো। সাংবাদিক কে পি ভানুমতির কমিউনিজম নিয়ে গুয়েভারা কে করা একটি প্রশ্ন যথেষ্ট আলোচিত হয়েছিল।
“আপনি কমিউনিজমে বিশ্বাসী কিন্তু কমিউনিস্টরা বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাস রাখে না, কেন?”– এই ছিল ভানুমতির সেদিন এর প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের জবাবে ইচ্ছে করেই বিনয়ের সঙ্গে চে জানিয়েছিলেন তিনি একজন সোশালিস্ট অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক তিনি কমিউনিস্ট নয়। সমাজতন্ত্র সমাজে সমানাধিকারে বিশ্বাস রাখে। সেই প্রসঙ্গে তিনি গান্ধীর অহিংস আন্দোলন কেও ভারতের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান হিসেবেও উল্লেখ করেছিলেন। উল্লেখ্য, গোটা সাক্ষাৎকার পর্বেই তাঁর হাতে জ্বলছিল চিরাচরিত হাভানা সিগার।
চিরকাল লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে নিজের জীবন অতিবাহিত করার পরও ভারতের স্বাধীনতা মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন ও সত্যাগ্রহের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা শোনা গিয়েছিল বিদ্রোহী নেতার কন্ঠে। যা থেকে তার বৃহৎ মানসিকতা এবং ভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে শ্রদ্ধা জানানোর নৈতিক গুণ সম্পর্কে পরিচয় পাওয়া যায়।
“ভারতীয়রা কখনোই যুদ্ধ এবং হিংসায় বিশ্বাসী নয়, এমনকি যুদ্ধ-লড়াই শব্দটা তাদের মস্তিষ্কে কখনোই আসেনি। এমনকি যখন তাঁরা জাতির সবথেকে দুর্বিষহ পরিস্থিতি অর্থাৎ গত দেড়শ বছর ধরে যখন তারা ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম মধ্যে বিরাজমান ছিলেন”‘।
পরবর্তীকালে কিউবাতে ফিরে গিয়ে তাঁর স্পেশাল রিপোর্টে এই কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
এ সমস্ত তথ্য নতুন করে সামনে আনার কৃতিত্ব যাঁর, সেই মানুষটার নাম রানা প্রতাপ সেন। আপাদমস্তক গান্ধীবাদী এই মানুষটার নিরলস প্রচেষ্টায় চে’ র ভারত সফরের তথ্যাবলী নতুন করে আজ আমাদের সামনে এসেছে।
দিল্লির কাছে পিলানা গ্রামে সরকারি ‘ কমিউনিটি ডেভলপমেন্ট ‘ প্রজেক্ট দ্যাখার জন্য চে গেলে, তাঁকে মাথায় প্রতীকী গান্ধী টুপি পরিহিত একজনকে সম্বর্ধিত করা হয়। এই ঘটনা এবং প্রতীক বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিলো।
চে গুভ্যেরা কে আবেগের কুলুঙ্গিতে বন্দী রেখে, তাঁর নামাঙ্কিত টি শার্ট, তাঁর ছবি আঁকা ট্যাটুতে এদেশের বুকে চে কে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং চে’ র ভারত সফর শুধুমাত্র একটা চে চর্চার বিষয় হয়ে উঠতে পারে ; যা এদেশের বুকে আমরা করে উঠতে পারিনি। সেই কাজে সামান্য হলেও এগুতে পেরেছিলেন এদেশের বুকে একজন, তাঁর নাম জহরলাল নেহরু।
ভারত সফরের চতুর্থদিনে অর্থাৎ ৪ জুলাই ১৯৫৯, চে’র নেতৃত্বে কিউবার প্রতিনিধি দলটি কৃষি ও খাদ্য দফতরের তৎকালীন মন্ত্রী এ. পি. জৈন- এর সাথে সাক্ষাৎ করেন ৷ বাণিজ্যমন্ত্রী নিত্যানন্দ কানুনগোর সাথে যেদিন সাক্ষাৎ করেন চে, অর্থাৎ ১ জুলাই ১৯৫৯, সেদিনই ভারত-কিউবা যৌথ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপটি ফেলা হয়ে গিয়েছিল ৷
প্রথমদিন থেকেই ভারত সফর নিয়ে অত্যন্ত ইতিবাচক ভাবে আশাবাদী ছিলেন চে।
সুযোগ সময় পেলেই চে তাঁর ডায়েরীতে, মাথায় আসা প্রস্তাবনা গুলো লিখে রাখতেন ৷ পরে দেখা যায় তিনি ডায়েরীতে এই দ্বিতীয় মিটিং এর লক্ষ্য হিসেবে ভারত-কিউবা বাণিজ্যিক সম্পর্কে রপ্তানি ও আমদানি যোগ্য কয়েকটি পণ্যের তালিকা করে যান ৷
যেমন ভারত থেকে আমদানি করার জন্য, চে, লিখে রেখেছিলেন —-
১) কয়লা
২) তাঁতবস্ত্র
৩) পাটজাত সম্ভার
৪) ভোজ্যতেল
৫) চা
৬) কাঁচা ফিল্ম
৭) ট্রেণিং করাবার জন্য ব্যবহৃত এরোপ্লেন
ভারতে রপ্তানি করার জন্য —-
১) তামা
২) টায়ারে ব্যবহৃত রেয়ণ
৩) কোকো
৪) চিনি
সামান্য সময়ের আন্তর্জাতিক এই বৈঠক এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে,
চে তাঁর রিপোর্টে লিখেছিলেন —
”’দ্বিপাক্ষিকব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে ঐকমত্য স্থাপন করতে, ভারতের বাণিজ্য দপ্তরের সেক্রেটারীর সাথে আমার মিটিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল ৷ ভারতের ৩৮ কোটি জনসংখ্যার ‘স্ট্যাণ্ডার্ড অফ লিভিং’ এতোই বাড়ছে দিনদিন, যে, খুব শিগ্গীর তাদের চিনির চাহিদাও তরতর করে বাড়বে ৷ সেই চাহিদা যোগান দিতে গিয়ে আমরাও ভারতের নতুন ও বিশাল বাজার ধরতে পারবো ৷’
‘সাধে কি আর ফিদেল, তাঁর থেকে মাত্র দুবছরের ছোটো বন্ধুটির সম্বন্ধে বলেছিলেন — ‘বন্দুকপ্রিয় এই ডাক্তারটাকে আমি যে কাজই দি না কেন, ও সেই বিষয়ে এক্সপার্ট হয়েই ছাড়বে !
‘চে নেহরুকে এক বাক্স হাভানা চুরুট উপহার দিয়েছিলেন কিম্বা চে এবং নেহরু উভয়েই আবেগে গদগদ হয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করেছিলেন ; ইতিহাস চর্চায় এসবের মূল্য খুব ক্ষীণ। বরং চে ‘ র দিক থেকে ভারত আত্মার উপলব্ধি, ভারতের কৃষক-চটকল মজুরদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উপলব্ধি ; উল্টোদিকে চে ‘ র সঙ্গে গভীর আলোচনা, বহুত্ববাদী নির্যাসমিশ্রিত নেহরুর আধুনিক ভারত নির্মাণে চে’ র প্রেরণা ; এগুলো আলোচনার আলোকবৃত্তে কখনো আসলোই না।
আজ তাঁর জন্মদিনে সেই ট্রাজেডি বারবার সামনে আসে।
★তথ্য ঋণঃ রানাপ্রতাপ সেন★