বিপর্যয়ের দেশ প্রদেশ

ল্যাডলী মুখোপাধ্যায় 

সারা পৃথিবী জুড়ে এক মারাত্মক অস্থিরতা চলছে পরিবেশ নিয়ে। যে পরিবেশ আক্রান্ত, বিপর্যস্ত, ক্ষতিগ্রস্থ। সন্দেহ করা হচ্ছে শুধু জীব তথা প্রমাণই নয়, এমন বিধ্বংসী অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় এই আপৃথ্বীর ধংস অনিবার্য।তা সেই অরণ্য নদী পাহাড় আর জলাভূমিকে রক্ষা করার জন্য অবিশ্বে সংগঠিত হচ্ছে দুর্নিবার আন্দোলন। মানুষ তার প্রয়োজনে পরিবেশকে তার নিজের মতো করে উপযোগী করে নিয়েছে তা যেমন ঠিক,  তেমনি সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতিতে মানুষ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে , যার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য তো নষ্ট হচ্ছেই প্রাণের অস্তিত্ব ও বেমক্কা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অসচেতনতা এবং অপরিকল্পিত পরিকল্পনা পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটা আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি। তা হলো, রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা, রাজনৈতিক ক্ষমতায় থাকা শাসকদের মুনাফাখোর মনোবৃত্তি। 
এক্ষেত্রে এই মুহূর্তে  ভারতের স্থান এক নম্বরে। যদি রাজ্য হিসেবে কোনো স্থানাংক নির্ধারিত হয় তবে দেখা যাবে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থানও এক নম্বরে। পুরো একটা বিস্রস্ত অবস্থা। বেআইনি নির্মাণ থেকে অপরিকল্পিত পরিকল্পনায় দিশাহারা এ দেশ ও রাজ্য।এখানে তার দুয়েকটি দিক উল্লেখ করছি। 
দুহাজারতেরো সাল। প্রতি বছরের মতো সে বছরেও গ্রীষ্মকালে সারা দেশ থেকে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী ভিড় করেছে উত্তর ভারতে, চার ধাম দর্শনের বাসনায়। সেবার অতিবৃষ্টি হয়েছিল গোটা উত্তর ভারতেই। আর শেষে ষোলোই জুন নেমে এল মেঘভাঙা বৃষ্টি, তার সঙ্গে কেদারনাথের উত্তরে চোরাবালি হিমবাহ ভেঙে মন্দাকিনীর এক উন্মত্ত হড়পা বান ভাসিয়ে দিল কেদার উপত্যকা, রুদ্র প্রয়াগ জেলা, উত্তরাখণ্ডের বিরাট অঞ্চল, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল গ্রামের পর গ্রাম, মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিপুল, আটকে পড়লেন প্রায় সত্তর হাজার যাত্রী। 
এই বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ খুঁজতে গিয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আঙুল তুললেন অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের দিকে। এই অঞ্চলে তৈরি হয়েছে সত্তরটি হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রকল্প। পাহাড়ি নদী ও উপত্যকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য তচনছ করে তৈরি হয়েছে নদী বাঁধ। পাহাড়ে ব্লাস্ট ও টানেল তৈরি করায় বেড়েছে ধ্বসের প্রবণতা। এছাড়াও আছে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অজস্র হোটেল, রিসর্ট। এরই মাশুল দিতে হল প্রাণহানি আর সম্পত্তির ধ্বংসে। 
এই একই সর্বনাশের শিকার উত্তরবঙ্গ ও সিকিমের নদী উপত্যকা। একই রকম ভাবে তিস্তার হাইডেল প্রজেক্টের দৌরাত্ম্যে মুছে গেছে কালিঝোরা। সিকিমের উপজাতিদের নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করতে গিয়ে দেখেছি এই মানে মাত্রাহীন উন্নয়ন নিয়ে মানুষের বিক্ষোভ। তিস্তার উৎসভূমি জঙ্গু পাহাড় ও উপত্যকা কে বাঁচানোর জন্য লেপচা দের লড়াই অনেকটাই সাফল্য পেয়েছে। উল্টোদিকে মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকে অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নের ফলে খরা ও জল কষ্টে ভুগছে গ্রামাঞ্চল। 
পশ্চিমবঙ্গে আমরা দেখছি নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ অরণ্য ধ্বংস করার ফলে একের পর এক সামুদ্রিক ঝড়, আজ আয়লা, কাল আম্পান ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলছে সুন্দরবন।যতক্ষণ না আমরা জরুরি ভিত্তিতে ম্যানগ্রোভ বন গড়ে তুলছি, সুন্দরবন তো ধ্বংস হবেই, বিপন্ন হয়ে পড়বে কলকাতাও। আরও ভয়ংকর সর্বনাশ হবে যদি সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী সুন্দরবনে এয়ার স্ট্রিপ ও পর্যটনকেন্দ্র গড়ে ওঠে। সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ মোহনা, অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বায়োডাইভার্সিটি জোন, তাকে রক্ষা করতে না পারা হবে অমার্জনীয় অপরাধ। 
লোভের আরেক শিকার এ রাজ্যের নদীগুলোও। বালি ও মাটি মাফিয়াদের কল্যাণে নদীখাত হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক গভীরতা, নদীর ইকোসিস্টেম বিনষ্ট করা হচ্ছে নির্বিচারে। এই লিস্টে এখন যোগ হয়েছে দেউচা পাঁচামি। যেসময় আধুনিক পৃথিবী কয়লার মতো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জ্বালানির ব্যবহার থেকে বিরত থাকছে, আমরা খোলা মুখ কয়লাখনি প্রকল্পের জন্য এগারো হাজার দুশো একর জমির অধিবাসীদের (মূলত আদিবাসী) উচ্ছেদ করে, বনাঞ্চল, কৃষিজমি, জলাশয় ধ্বংস করার পরিকল্পনা করছি। এর ফলে পরিবেশের তো ব্যাপক ক্ষতি হবেই, তার সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে জল জঙ্গল, কৃষিজমির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা আদিবাসীদের সংস্কৃতি। এলাকার আদিবাসীরা অভিযোগ করছেন এর মধ্যেই পাথর খাদান ও ক্রাশারের কারণে বাতাসে ধুলোর পরিমাণ শঙ্কা জনক, শ্বাসকষ্টের শিকার হচ্ছেন অনেকেই, বিশেষত শিশুরা। অন্যদিকে জলকষ্ট বেড়েছে ভয়ানক মাত্রায়। উচ্ছেদের মুখে, ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আদিবাসীরা জোট বাঁধছেন লড়াইয়ে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *