ইন্দিরা গান্ধি,বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট

শান্তনু দত্ত চৌধুরী

কয়েক বছর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সংক্রান্ত মহাফেজখানায় রাখা ১৯৬৯–১৯৭২ সাল পর্যন্ত নথিগুলি Declassify করা হয়েছে।এগুলি এখন দেখা যায়।এই সব নথি’র ওপর ভিত্তি করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়েছে।এর মধ্যে ‘নিক্সন, ইন্দিরা এন্ড ইন্ডিয়া— পলিটিক্স এন্ড বেয়ন্ড’ বইটির লেখক কল্যাণী শঙ্কর।বইটিতে ৬ ডিসেম্বর,১৯৭১-এ প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও মার্কিন পররাস্ট্র সচিব কিসিঞ্জার এর মধ্যে আলোচনার পূর্ন বিবরণ আছে।এই সময়ে ওখানে মার্কিন সেনাধক্ষ হল্ডারম্যানও উপস্থিত ছিলেন।ওই আলোচনার সময় নিক্সন বারবার ইন্দিরা গান্ধিকে শুয়োর, ডাইনি ইত্যাদি বলে উল্লেখ করে তাঁকে উচিৎ শিক্ষা দেবেন বলে হুমকি দিচ্ছিলেন। ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়।এর একমাস আগে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইন্দিরাজি নিউইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনে তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাক সেনাবাহিনীর বর্বর অত্যাচার ও হত্যালীলার বিবরণ দেন।ওই সময় ভারত ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়।আমেরিকা প্রায় সরাসরি এই গণহত্যাকে সমর্থন করছিল।

নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন এসে ইন্দিরা গান্ধি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাৎ করেন।দিনটা ছিল ৯ নভেম্বর, ১৯৭১।নিক্সন ইচ্ছাকৃতভাবে ৪৫ মিনিট দেরিতে আলোচনায় এসে বলেন পাকিস্তান ভেঙে যায় এরকম কিছু করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।তিনি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কথা বলে দেখবেন কী করা যায়।তবে ভারত যেন পাকিস্তানকে আক্রমণ না করে।তা করলে আমেরিকা চুপ করে বসে থাকবেনা।কিসিঞ্জারের পর্যবেক্ষণ, ইন্দিরা গান্ধি নির্লিপ্ত উদাসীনতার সঙ্গে নিক্সনের কথা শোনেন।এরপর ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে ও ভারত অগ্রসর হচ্ছে শুনে নিক্সন তর্জন গর্জন শুরু করেন।বলেন ‘এই মহিলা আমাদের প্রতারিত করেছেন’।নিক্সনের নির্দেশে ৬ ডিসেম্বর কিসিঞ্জার ইন্দিরা গান্ধিকে ফোন করে সেনা প্ৰত্যাহার করতে বললে তিনি বলেন ‘এই বিষয়ে কারও উপদেশ দেওয়ার দরকার নেই’।কিসিঞ্জারের বক্তব্য এই বিবরণ শুনে নিক্সন আর কোনও কথা বলতে পারেননি ও তোতলাতে থাকেন।

দ্বিতীয় বইটি ‘দি ব্লাড টেলিগ্রাম, নিক্সন, কিসিঞ্জার এন্ড এ জেনোসাইড’ বইটির লেখক প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক গ্যারি জে ব্যাস।এই বইটিতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ও তারপর ঢাকায় নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্চার ব্লাড তার সরকারের কাছে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন তার পূর্ণপাঠ আছে।আছে বাংলাদেশের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন-পাক-চীন আঁতাতের বিবরণ।এই রাষ্ট্রদূত ব্লাডের রিপোর্টে খান সেনাদের গণহত্যার বিবরণ আছে।অধ্যাপক গ্যারি লিখেছেন বাংলাদেশের ঘটনায় আমেরিকা ও ভারত,এই দুই গণতান্ত্রিক দেশ দুই রকম ভূমিকা নিয়েছিল।আমেরিকা পাক গণহত্যাকে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিল,আর ভারত তার অবসান ঘটিয়েছিল।অবশ্যই ইন্দিরা গান্ধির বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। ইন্দিরা গান্ধির ওপর কেন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দেশি বিদেশি অনুচররা ক্রুদ্ধ হয়েছিল তা না বোঝার কারণ নেই।

গত ৩ সেপ্টেম্বর , নিউ ইয়র্ক টাইমস অধ্যাপক গ্যারি ব্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।গ্যারি ব্যাস এর আগে তাঁর লেখা’ দি ব্লাড টেলিগ্রাম ‘ – শীর্ষক বইতে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ ওয়ার ডিপ্লোম্যাসি ‘ সম্পর্কে বিস্তৃত লিখেছেন।সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্টের আর্কাইভ থেকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিক্সন – এর কথোপকথনের কিছু টেপ রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে।গ্যারি ব্যাস লিখেছেন, এতে শোনা যাচ্ছে নিক্সন বিভিন্ন সময়ে বলছেন পৃথিবীর মধ্যে ভারতীয় মহিলারা ভীষণ ভাবে অনাকর্ষণীয় , তাদের কোনও যৌণ আবেদন নেই এবং তারা অত্যন্ত বিরক্তিকর।নিক্সন সম্পর্কে এটাও জানা গিয়েছে যে লোকটি অত্যন্ত ইহুদি বিদ্বেষী ছিলেন।তাঁর বিদেশ সচিব হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন একজন ইহুদী।নাৎসিদের ইহুদী নিধনের সময় তাঁরা ছিলেন চরম অত্যাচারিত।বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা বাংলাদেশে পাকিস্তানের নারকীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে যখন লড়াই করছিল, ইন্দিরা গান্ধি তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তার ওপর নিক্সন ও কিসিঞ্জার জুটি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়।

ভারত ও ভারতীয়দের সম্পর্কে এই দুই ক্ষমতাবান মার্কিনীর যে বিদ্বেষ তার পিছনে ব্যক্তিগত রসায়ন থাকতে পারে বলে গ্যারি ব্যাস অনুমান করেছেন। সাধারণভাবে ভারতীয়দের ও বিশেষভাবে ভারতীয় মহিলাদের সম্পর্কে নিক্সনের যে বিদ্বেষ তার কারণ তাঁর ইন্দিরা গান্ধির প্রতি বিদ্বেষ।ইন্দিরার নেতৃত্বে ভারতের সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক ও বাংলাদেশের ঘটনায় পাকিস্তানের বিরোধীতা ছিল নিক্সনের বিদেশনীতির পরিপন্থী। গ্যারি ব্যাস একটি অসাধারণ কাহিনীর কথা বলেছেন।১৯৬০ সালে নিক্সন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে জন.এফ.কেনেডির বিরুদ্ধে Contest করে হেরে যান।তারপর নিক্সন ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর পদে দাঁড়িয়েও হারেন।আবার ভাগ্য পরীক্ষার আগে তিনি ভারতে আসেন ও সদ্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে দেখা করেন।মিনিট কুড়ির সাক্ষাৎকারে কিছুক্ষন পরেই ইন্দিরা গান্ধি বিরক্ত হন ও আগ্রহ হারান। তিনি তাঁর এক সচিবকে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করেন এই বিরক্তিকর সাক্ষাৎ কখন শেষ হবে।গ্যারি ব্যাসের মতে একদম ঠিক মানে বুঝতে না পারলেও,নিক্সন প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠস্বরের মর্মার্থ বুঝতে পেরেছিলেন।বাংলাদেশে পাক সেনাবাহিনীর নারকীয় হত্যালীলার বিরুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের প্রতিবাদ নিক্সনকে ক্ষুব্ধ করে।পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন সমর্থন , ইয়াহিয়া খান ও হেনরি কিসিঞ্জারের দৌত্য মার্কিন – চিন আঁতাতের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।১৯৭১ এর ডিসেম্বরের প্ৰথম সপ্তাহে পাক – ভারত যুদ্ধ শুরুহয় । মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গপোসাগরের দিকে এগোতে থাকলে ২০ টি রুশ রণতরী তার পিছু নেয়।এর পরই সপ্তম নৌবহর তাদের গতিমুখ ঘুরিয়ে নেয়।১৬ ডিসেম্বর,১৯৭১ পাক সেনাবাহিনীর কমান্ডার নিয়াজি ঢাকায় ভারতীয় কমান্ডার লে.জে. জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

আজ ৩১ অক্টোবর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন ও দেশি বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের মহান নেত্রী ইন্দিরা গান্ধির আত্মবলিদানের দিন। তিনি সম্মুখে চরম বিপদ জেনেও তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষীদের পরিবর্তন করেন নি। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি দায়বদ্ধতা ও অসীম সাহস। দুই কাপুরুষ তাঁকে হত্যা করে। এর পিছনে দেশি বিদেশি প্রতিক্রিয়ার গভীর চক্রান্ত ছিল।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *