কিউবার বিপ্লব , পন্ডিত নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধি: নেহরুর আমন্ত্রণে কাস্ত্রো ভারতে পাঠিয়েছিলেন চে গেভারাকে 

শান্তনু দত্ত চৌধুরী

 

১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে ফিদেল কাস্ত্রো ,চে গুয়েভারা ও সহযোদ্ধা বিপ্লবীরা কিউবার সামরিক একনায়ক ফুলজেন্সিও বাতিস্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেন। ১৯৫৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটে।ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর দেশে প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী  সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্ৰহণ করেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ শুরু করে। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি কিউবাকে কুটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়।এর বাইরে যে দেশ প্রথম মার্কিন ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করে কিউবাকে কুটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়  সেই দেশ হচ্ছে পন্ডিত নেহরুর নেতৃত্বে ভারত। 

         বিপ্লবের ৬ মাসের মধ্যে ১৯৫৯ সালের জুন মাসে কাস্ত্রো তাঁর মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে ভারতে পাঠান।তিনি প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।নেহেরুজি তাঁকে হাতির দাঁতের হাতলযুক্ত একটি সুন্দর কুকরি সুদৃশ্য খাপে ভরে উপহার দেন।এই উপহারটি এখন হাভানায় চে গুয়েভারা মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।চে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশ নীতি, পরিকল্পনা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন।চে তাঁর স্মৃতিচারণে বলে গিয়েছেন যে পন্ডিত নেহরু যেন বৃহৎ পরিবারের স্নেহশীল দাদু।এছাড়াও চে আলোচনা করেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন ও সামরিক কর্তাদের সঙ্গে ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে। পরিদর্শন করেন ওখলা শিল্প তালুক ও এখানেই তিনি প্রথম লেদ মেশিন দেখেন।

দিল্লির উপকণ্ঠে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে মিলিত হন। নেহেরুজির পরামর্শে তিনি কলকাতায় আসেন ও ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউটে  প্রখ্যাত রাশিবিজ্ঞানি প্রশান্ত চন্দ্র মহলানাবিশের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। চে তাঁর ডায়েরিতে মহাত্মা গান্ধি , তাঁর নেতৃত্বে কোটি কোটি মানুষের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরূদ্ধে অহিংস গণ সংগ্রাম ও গান্ধিজির অহিংসার দর্শন  সম্পর্কে গভীর শ্রদ্ধা ব্যক্ত করেছেন।তিনি লিখেছেন ভারতে থাকার সময়

‘ কৃষ্ণ’ নামে এক ব্যক্তি তার সঙ্গে গান্ধিজি ও অহিংসা সম্পর্কে বিশদে অবহিত করেন যা Thought provoking.কিন্তু এই ‘কৃষ্ণ’ নামে ব্যক্তিটি কে জানা যায় নি।

    ১৯৬০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত কিউবায় দূতাবাস স্থাপন করে।এরপর কিউবাও ভারতে দূতাবাস খোলে।

           ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছেন :-

১৯৬০ সালের গোড়ায় তিনি নিউইয়র্কে যান রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে।ঐ দেশে কিউবার কোনো দূতাবাস ছিল না।মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ চলছে।কাস্ত্রোর থাকার কোনও ব্যবস্থা ইউ.এন.ও করেনি।ওই দেশে বসবাসকারী কিছু কিউবানের ব্যবস্থাপনায়  নিউইয়র্ক শহরের উপকণ্ঠে এক সাধারণ মানের হোটেলে কাস্ত্রো গিয়ে উঠেছেন।পরদিন সকালে তিনি শুনলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহরু এই হোটেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। তিনি বিস্মিত হলেন এই ভেবে যে নেহরুর মতো খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব তার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন!কাস্ত্রো বলেছেন তার তখন মাত্র ৩৪ বছর বয়স, নেহরু বর্ষীয়ান ব্যক্তি।তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকার কাস্ত্রো পরবর্তী কালে সর্বদা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতেন। পন্ডিত নেহরুও তাঁকে উৎসাহিত করেন ও বলেন ‘ ডোন্ট গেট নার্ভাস ‘। সমগ্ৰ বিশ্বে ঔপনিবেশীকতা ও বর্ণবিদ্বেষবাদের অবসান , অপর দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ না করা, দুই শক্তিজোটের বাইরে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির নিজস্ব স্বাধীন বৈদেশিক  নীতি নির্ধারণ ও স্বনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা ইত্যাদি নীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রধান স্তম্ভ ছিলেন পন্ডিত নেহরু।তাঁর পর ইন্দিরা গান্ধি এই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করে তোলেন।কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবা এই আন্দোলনে যোগ দেয়।

      কাস্ত্রো দীর্ঘ জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন।শোনা যায় ১৯৬১ সালে যুগোশ্লাভিয়ার বেলগ্রেডে NAM এর রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলন।নেহেরুজি  বিদেশ দপ্তরের প্রস্তুত করা সফরসূচি দেখে বিদেশ সচিবকে বলেন  ‘ তাঁর ফেরাটা একদিন পিছিয়ে দিতে , কেননা কাস্ত্রো আসবে বেলগ্রেডে ও আমি ওর দীর্ঘ ভাষণ শুনবো, ফলে নির্দিষ্ট দিনের ফ্লাইট ধরতে পারবো না।’

         কাস্ত্রো ১৯৭৩ ও ১৯৮৩ সাল দুবার ভারতে এসেছেন।দুবারই ইন্দিরা গান্ধি ক্ষমতায় ছিলেন। প্রথমবার সফরের সময় কাস্ত্রো ‘ র সম্মানে রাষ্ট্রপতি ভবনে আয়োজিত নৈশভোজের সময় ইন্দিরা গান্ধি কাস্ত্রোকে খবর দেন চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আলেন্দে ও কবি পাবলো নেরুদা বর্বর সামরিক জুন্টার হাতে নিহত হয়েছেন।কাস্ত্রো বলেছেন ‘ আমি তখনই শ্রীমতী গান্ধিকে বলেছিলাম আমাদের হত্যা করার জন্য গুপ্ত ঘাতক নিয়োজিত আছে।’  

         ১৯৮৩ সালে দিল্লীতে 

জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।ওই সম্মেলনেই কাস্ত্রো NAM এর সভাপতির দায়িত্বভার ইন্দিরা গান্ধির হাতে তুলে দেন।

          ভারত ও কিউবার বন্ধুত্ত্ব কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।এর স্থপতি পন্ডিত নেহরু।তিনি স্বাধীনতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ কিউবান জনসাধারণের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।তারপর থেকে ভারত সর্বদা কিউবার ওপর মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধের বিরোধিতা করেছে ও কিউবার পাশে থেকেছে। ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধি কিউবায় যান। তিনি নিহত হলে কাস্ত্রো গভীর ভাবে শোকাভিভুত হন।

১৯৯২ সালে কিউবা অবরোধের জন্য গভীর খাদ্য সঙ্কটে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের পথে । তখন পি ভি নরসিংহ রাওয়ের সরকার কিউবায় ১০ হাজার M টন গম ও ১০ হাজার M টন চাল পাঠায়। কাস্ত্রো বলেছিলেন এই সহায়তা আমাদের কাছে ‘ বন্ধুত্বের রুটি ‘। আবারও ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহ ও ২০১২ সালে উপ রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারী কিউবায় যান ও পারস্পরিক সহায়তার ধারা বজায় রাখেন।

         ভারত কিউবার সম্পর্কের ইতিহাসটি তুলে ধরলাম। সেই কিউবা যে ছোট  দেশটিকে ধংস করার সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন পন্ডিত নেহরু।এর মধ্যে  ধান্দাবাজি আবিস্কার সত্যই উর্বর মস্তিষ্কের পরিচয়।

            চে গুয়েভারার ভারত সফর ও তাঁর সঙ্গে পণ্ডিত নেহরুর ছবিটি একটি সময়ের ইতিহাস তুলে ধরেছে। পন্ডিত নেহরুর বিরুদ্ধে নিকৃষ্ট মানের সমালোচনা গত কয়েক দশক ধরে  হিন্দুত্ববাদী কমিউনাল ফোর্স  করে আসছে। সেটা আরও তীব্র হয়েছে ২০১৪ সালের পর মোদির নির্দেশে আই. টি সেলের দৌলতে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *