শুভাশিস মজুমদার
দেশভাগের আবেগকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ডাকে বিজেপি গতবছর থেকে ১৪ আগস্টকে ‘বিভাজন-বিভীষিকা স্মরণ দিবস’ হিসেবে পালন করা শুরু করেছে।
এই বছরে, এদিন দেশভাগের জন্য কংগ্রেস এবং ভারতীয় কমিউনিস্টদের দোষারোপ করে বিজেপি একটি ৭ মিনিটের ভিডিও প্রকাশ করেছে। এছাড়া, স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তি নিয়ে প্রচারিত কর্ণাটক সরকারের একটি বিজ্ঞাপন থেকে জওহরলাল নেহরুর ছবিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এনিয়ে কংগ্রেস নেতারা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। দেশভাগের সময় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদেরকে অসম্মান করার এবং ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহরুর প্রতি অন্তহীন ঘৃণা পোষণ করার অভিযোগ আনা হয়েছে বিজেপির বিরুদ্ধে। ভিডিওটিতে বিশেষ মিউজিক এবং আর্কাইভাল ফুটেজ ব্যবহার করে, কংগ্রেসকে দোষারোপ করা হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে অনেকবার নেহরু এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি দেখানো হয়েছে। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ ট্যুইটারে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে অভিযোগ করেন, “প্রধানমন্ত্রীর ১৪ আগস্টকে দেশভাগের ভয়াবহ স্মরণ দিবস হিসাবে চিহ্নিত করার আসল উদ্দেশ্য, সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঐতিহাসিক ঘটনাগুলিকে তাঁর রাজনৈতিক খোরাক হিসাবে ব্যবহার করা। লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের আত্মত্যাগকে ভুলে যাওয়া বা অসম্মান করা উচিত নয়।”
জয়রাম রমেশ বলেন যে আসল সত্যটি ছিল হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শী বিনায়ক দামোদর সাভারকর দ্বি-জাতি তত্ত্বের উদ্ভাবন করেছিলেন এবং জিন্নাহ এটিকে পরিপূর্ণতা দিয়েছিলেন। কংগ্রেস নেতা যোগ করেছেন, “সর্দার প্যাটেল লিখেছেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমরা যদি দেশভাগকে মেনে না নিই, তাহলে ভারত টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এবং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে।”
জয়রাম রমেশ আরো বলেন, “ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গান্ধি, নেহেরু, প্যাটেল এবং আরও অনেকের উত্তরাধিকারকে সমুন্নত রাখবে, যাঁরা সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। ঘৃণার রাজনীতি পরাজিত হবেই।”
দেশের সুপ্রাচীন দল কংগ্রেস দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজেপি এবং তার আদর্শগত পরামর্শদাতা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। বিজেপির শেয়ার করা ভিডিওতে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কংগ্রেস নেতা এবং ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল বলেছেন, “দ্বি-জাতি তত্ত্বটি সাভারকার প্রস্তাব করেছিলেন এবং জিন্নাহ সমর্থন করেছিলেন।”
“এই ব্যক্তিরা বিভেদকামী। দেশের স্বাধীনতায় এঁদের ভূমিকা কী ছিল?” তিনি গৈরিক দলের উপর আক্রমণ করে বলেন। বাঘেল আরো বলেন, “১৯২৫ সালে আরএসএস গঠিত হয়েছিল… তারা এখনও ব্রিটিশদের সমালোচনা করে না, বরং গান্ধির সমালোচনা করে।”
কংগ্রেস নেতা পবন খেরা টুইট করেছেন, “আমি এমন একটি পরিবার থেকে এসেছি যারা দেশভাগের সময় এক ডজনেরও বেশি সদস্যকে হারিয়েছে। সঙ্ঘ-লীগের যুগলবন্দী এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছিল যার ফলে এই ঘটনাগুলি ঘটে। তাঁর আদর্শ পূর্বপুরুষদের অপকর্মের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা চেয়ে নেওয়াই ভালো।”
এদিকে, কংগ্রেস কর্ণাটক সরকারের একটি বিজ্ঞাপনে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে যা পন্ডিত নেহরুকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান তুলে ধরে এই রাজ্যে তথ্য দপ্তরের মাধ্যমে সরকার বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে যা ছাপা হয়েছে।এতে জাতীয় নেতা হিসেবে মহাত্মা গান্ধি, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, ভগত সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ এবং সাভারকর সহ ১২ জন এবং কর্ণাটকের ১৬ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর ছবি ও নাম আছে। কিন্তু পন্ডিত নেহরুর ছবি ও নাম নেই।এ নিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং কংগ্রেস নেতা সিদ্দারামাইয়া ট্যুইট করেছেন,”আজকের সরকারি বিজ্ঞাপনে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তালিকায় পন্ডিত জওহরলাল নেহরুকে অন্তর্ভুক্ত না করা দেখায় যে একজন মুখ্যমন্ত্রী তাঁর চেয়ার বাঁচাতে কতটা নিচে নামতে পারেন।” তিনি একের পর এক ট্যুইট বার্তায় লিখেছেন, “পন্ডিত নেহরুকে অপমান করার জন্য কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী বাসভরাজ বোম্মাইয়ের গোটা জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। ভারত এবং কর্ণাটকের জনগণ তাঁদের দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে অপমানিত করা কখনোই মেনে নেবেন না। সাভারকর, যিনি ব্রিটিশ অফিসারদের (কাছে) নিজেকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, তিনি সামনের সারিতে স্থান পান। কিন্তু, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর হয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা বাবা সাহেবকে শেষ পংক্তিতে রাখা হয়েছে।”কর্ণাটকের রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি ডি কে শিবকুমারও “প্রতিহিংসার প্রচারে” জনসাধারণের অর্থের অপব্যবহার করার জন্য বিজেপিকে আক্রমণ করেছেন। তিনি যোগ করেছেন, “স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য জওহরলাল নেহেরুকে নয়বার ব্রিটিশরা গ্রেপ্তার করেছিল এবং ৩,২৫৯ দিন তাঁকে জেলে রাখা হয়েছিল। এটা অমার্জনীয় যে রাজনৈতিক বিদ্বেষের কারণে নেহরুর নাম বিজ্ঞাপন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।”কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ রণদীপ সিং সুরজেওয়ালা ট্যুইট করেছেন, “ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও জাতি নির্মাতা পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর প্রতি অবিরাম ঘৃণা বর্ষণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। বোম্মাই সরকার তাঁর (পন্ডিত নেহরুর) অস্তিত্বকে অস্বীকার করে সর্বনিম্ন স্তরে চলে গেছে। স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে, এটি বর্তমান সময়ের শাসকদের চরিত্র এবং দুষ্ট চিন্তার প্রক্রিয়াকে প্রতিফলিত করে।” on Android