ন্যাশনাল হেরাল্ড ও বিজেপির প্রতিহিংসার রাজনীতি

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের মানুষের জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে জন্ম হয়েছিল ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ পত্রিকার। মূলত জহরলাল নেহরুর উদ্যোগেই AJL বা অ্যাসোসিয়েটেড জার্নাল লিমিটেড এর অধীনে ১৯৩৭ সালে এই পত্রিকার যাত্রা শুরু।

স্বাভাবিক ভাবেই, সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’-কে বন্ধ করতে চেয়েছিলো অত্যাচারী ইংরেজ সরকার। আজ ব্রিটিশ চলে যাওয়ার 75 বছর পরেও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী বিজেপি এই পত্রিকা তথা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আবারও চক্রান্তের জাল বুনছে।

বর্ষীয়ান এই পত্রিকার দীর্ঘ পথে বহুবার আর্থিক অনটনের মুখে পড়তে হয়েছিল, একসময় অর্থাভাবে পত্রিকা প্রায় বন্ধ হওয়ার মত অবস্থা ; সেই সময় পত্রিকার জন্য পণ্ডিত জহরলাল নেহরু তাঁর এলাহাবাদের পৈতৃক বাসভবন পর্যন্ত বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তখন কোনোক্রমে সাময়িক সামাল দেওয়া গেলেও ধীরে ধীরে স্বাধীনতা-উত্তর কালে ন্যাশনাল হেরাল্ড প্রভূত আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

অবশেষে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার, এই ঐতিহ্যশালী ঐতিহাসিক পত্রিকা টি ঋণ জর্জরিত অবস্থায় চিরকালের মত বন্ধ হওয়ার উপক্রম, এমন অবস্থায় দেশের গৌরব ও অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীর আশা আকাঙ্খায় গড়া এই পত্রিকা কে বাঁচাতে এগিয়ে আসে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, সাল ২০০২,

২০০২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত প্রায় এক দশক ব্যাপী ১০০ টি কিস্তিতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস চেকের মাধ্যমে (সুতরাং কালো টাকা নয়) ন্যাশনাল হেরাল্ড কে ৯০ কোটি টাকা ঋণ দেয়। এই ৯০ কোটি টাকার মধ্যে ৬৭ কোটি টাকা ন্যাশনাল হেরাল্ড তাদের কর্মচারীদের বেতন ও পরবর্তী সময়ে স্বেচ্ছাবসর প্রকল্পে ব্যয় করে। বাকি টাকা সরকারি ঋণ শোধ করতে খরচ করে-যার মধ্যে বিদ্যুতের বিল, বাড়ির ট্যাক্স,ভাড়া ও বাড়িটির মেরামত ইত্যাদিতে ব্যয় হয় মূল অংশ ।

তবে এ কাজটিও এত সহজ ছিল না,

কারণ, ভারতের আইন অনুযায়ী কংগ্রেস একটি রাজনৈতিক দল হয়ে AJL নামক একটি লিমিটেড কোম্পানি তে সরাসরি টাকা দিতে পারে না । তাই সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, মতিলাল ভোরা প্রমুখ রা তৈরি করলেন ভারতীয় আইন অনুযায়ী ‘সেকশন 25’- এর অন্তর্গত একটি কোম্পানি — যার নাম ‘ইয়ং ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড’ YIPL,

পরবর্তী কালে AJL এর ৯৯% শেয়ার হোল্ডার-রাই, যাঁরা মূলত কংগ্রেসেরই কর্মী স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই এক এক করে তাঁদের অংশ কংগ্রেস এর তৈরি ‘Section 25 কোম্পানি’ YIPL কেই হস্তান্তর করে, এবং ভগ্নপ্রায় পত্রিকাটি আবার গতি লাভ করে।

‘SECTION 25 কোম্পানি’ কি?

‘Section 25 কোম্পানি’ হল, ভারতের ‘Companies Act 1956’, অনুযায়ী গঠিত একরকম অলাভজনক সংস্থা, কোনো সমাজসেবা মূলক কাজ করার জন্য ট্রাস্ট বা সোসাইটি র বিকল্প হল ‘সেকশন 25 কোম্পানি’। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ন হল, এই কোম্পানির লভ্যাংশ অবশ্যই পুনঃ নিয়োগ করতে হয় এই কোম্পানিতেই, অথবা সমাজ কল্যাণের কাজে। অর্থাৎ অন্যান্য কোম্পানির মত এক্ষেত্রে কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার রা এই কোম্পানি থেকে কোনো লাভ নিতে পারবেন না, আরও সহজে বলতে গেলে, ‘সেকশন 25 কোম্পানি’র সম্পত্তি এই কোম্পানির বাইরে বেরোতে পারবে না, মালিকরা কোনো সম্পত্তি বা কোনো টাকাই নিজের ঘরে তুলতে পারবে না। সুতরাং সোনিয়া গান্ধী রাহুল গান্ধী প্রমুখেরা এর দায়িত্ব ভার নিলেও এটি এক সমাজ সেবা মূলক কাজ, একটি নয়া পয়সাও প্রতিদান নেই এ থেকে।

এটাই দেশের আইন, প্রসঙ্গত এই আইনও কংগ্রেসের করা, দেশের মানুষের মধ্যে সেবামূলক কাজের জন্য যে কেউ এমন কোম্পানি বা সংস্থা তৈরি করে সমাজসেবা বা এমনই কোনো ভগ্নপ্রায় সংস্থা কে ও তার কর্মচারীদের পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।

বাস্তবেও তাই হয়েছে, আজ অবধি সোনিয়া গান্ধী বা রাহুল গান্ধী এক নয়া পয়সাও YIPL থেকে নেন নি, মাঝখানে ED অনেক তদন্ত করেও কিছু খুঁজে না পাওয়ায় তদন্ত বন্ধও করে দিয়েছিল ED, সাল ২০১৫, হ্যাঁ বিজেপির শাসনাধীন ২০১৫ সালে ED কোনো সূত্র না পেয়ে এ তদন্ত বন্ধ করতে বাধ্য হয় ।

এমনকি ৯০ কোটি টাকা ঋণের বদলে যে শেয়ার পেয়েছে YIPL । সে প্রসঙ্গেও ৬ই নভেম্বর, ২০১২ তারিখে নির্বাচন কমিশন লিখিত ভাবে জানিয়েছে এই লেনদেন সম্পূর্ণ বৈধ।

এ তো সবই ভালো ভালো কথা, তবে সমস্যা কোথায় ?

সমস্যা বিজেপির প্রতিহিংসার রাজনীতি।

সাল ২০১৮-১৯, কংগ্রেস বিজেপিকে রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ বিধান সভা নির্বাচনে পরাজিত করে, অন্যদিকে নোটবন্দী র মত ভ্রান্ত নীতিতে দেশের অর্থনীতি কয়েক যুগ পিছিয়ে, দেশ ব্যাপী মানুষের অসন্তোষ গজিয়ে উঠছে, বিজেপি জন সমর্থন হারাচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই ED বিজেপি সরকারের এজেন্সি ED একরকম স্বতঃ প্রণোদিত হয়েই এই কেস টি আবার খুললোএবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই, সেই কেসে পরবর্তী কালে পুনরায় সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী কে সমন পাঠানো হয়। “আপ ক্রনলোজি সমঝিয়ে”

এখানে উল্লেখ্য, এসব কিছুই কিন্তু ঘটছে উদয়পুরে কংগ্রেসের নবসংকল্প চিন্তন শিবির অনুষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে, যেখানে কংগ্রেস এক নতুন অঙ্গীকার করেছিল ‘ভারত জোড়ো’ । নোটবন্দী, অপরিকল্পিত GST, ভ্রান্ত কৃষি আইন, মূল্যবৃদ্ধি, করোনা মহামারী মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতা –এই সমস্ত কিছুতে মোদি সরকার ক্রমশ জনসমর্থন হারাচ্ছে। বেকারত্ব বাড়ছে হু হু করে। মানুষের হাতে কাজ নেই – পয়সা নেই। আর এসবের বিরুদ্ধে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ক্রমশই মানুষ এর সমর্থন অর্জন করে চলেছে। তাই চিরকালের মতো এবারও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করেছে ওরা।

এর আগেও আমরা দেখেছি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে মানুষকে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করে নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলো বিজেপি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আদালতের রায়ে প্রমাণ হয়ে গেছে যে কোনো দুর্নীতিই হয়নি। রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে বোফর্স কেলেঙ্কারির অভিযোগও যেমন নাকচ হয়ে গেছে তেমন ড.মনমোহন সিং-এর সরকারের বিরুদ্ধে 2G কেলেঙ্কারির মিথ্যা অভিযোগও দেশের সর্বোচ্চ আদালত নাকচ করে দিয়েছে।

এই যে আমরা দেখলাম দিল্লিতে হাজার হাজার পুলিশ নামিয়ে কংগ্রেসী নেতৃত্ব কে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিল করতে দেওয়া হলো না, কংগ্রেসী নেতাদের আটকে রাখা হলো মাঝরাত পর্যন্ত, তাঁদের উপর অমানবিক নির্যাতন করা হলো , কংগ্রেস সদর দপ্তরে ঝড়ের বেগে পুলিশের অনুপ্রবেশ – এ সবই হল এই বিতর্কটিকে আরো উস্কানি দেওয়ার নির্মম চক্রান্ত।

এই চক্রান্ত কতটা গভীর তা একটা ঘটনাতে সহজেই বোঝা যায়। ২০১৫ সালে এই BJP সরকারের আমলেই বন্ধ হয়ে যাওয়া এই মিথ্যা কেসটি নতুন করে শুরু করেন রাজেশ্বর সিং ইডি’র দায়িত্ব নেবার পরেই। সেই রাজেশ্বর সিং আবার ED থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে গত বিধানসভায় ভোটে দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তে উত্তরপ্রদেশের বিজেপির মন্ত্রী। সাধারণ মানুষ এতটা বোকা নয় মোদি জি।

তবে, ব্যাপারটা কেবল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে চক্রান্ত নয়, লড়াইটা কেবল কংগ্রেসের নয়। যে বা যারা মোদি সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলবে, বিজেপির ভ্রান্ত নীতির প্রতিবাদ করবে তাদের প্রত্যেককেই এই চক্রান্তের শিকার হতে হবে; সে আপনি – আমি যে কেউই হতে পারি।

আজ না হয় কাল।

কিন্তু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এই চক্রান্তের এবং প্রতিহিংসার রাজনীতির বিরুদ্ধে মাথা নত করবে না, এই শপথ নিয়েছে। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আমরা লড়েছি, তাই ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা দেওয়া লোকদের আমরা ভয় করিনা। লড়াই চলবে।

“বিশ্বমাঝে দুইটি সেনা পরস্পরে রাঙায় চোখ

পূণ্য সেনা নিজেরে কর, পাপের সেনা শত্রু হোক”

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *