ধাপ্পাবাজি, তর্জনগর্জন ও মিথ্যাচার–

ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকায় প্রকাশিত জনাব জাফর আগার প্রতিবেদন।( বাংলায় তর্জমা করেছেন সৌরভ কুন্ডু)ঃ

যেখানে আয়কর বিভাগ AJLএর সমস্ত সম্পত্তির মূল্যায়ন করেছেন প্রায় ৩০০ কোটি টাকা, যা নিয়ে আদালতে অভিযোগও জানানো হয়েছে, কিন্তু মিথ্যা প্রচারের দৌড় এতটাই যে সম্পত্তির কাল্পনিক ও মিথ্যা মূল্যায়ন যে ২০০০ কোটি টাকা দেখানো হচ্ছে, সেটিই মানুষের স্মৃতিতে অপরিবর্তিত ভাবে থেকে যাবে।

সরকার, মিডিয়ার একাংশ ও বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল হেরাল্ড, প্রকাশনা সংস্থা দ্য এসোসিএটেড জার্নাল ও হোল্ডিং কোম্পানি ইয়ং ইন্ডিয়ান এর উপর ক্রমান্বয়ে অভিযোগ করে চলেছেন। আর, এই অভিযোগগুলি যেভাবে নির্লজ্জভাবে প্রায়শই বিজেপির মুখপাত্রদের দিয়ে বারবার রীতিমতো আত্মবিশ্বাসের সাথে টিভি চ্যানেল গুলিতে পরিবেশিত ও প্রচার করা হচ্ছে, তাতে করে মনে হতে পারে কোনো তথ্যানুসন্ধান কি আদৌ জরুরি ?

অবশ্যই ভারত সরকারের কাছে এসোসিএটেড জার্নাল এবং ইয়ং ইন্ডিয়ানের সমস্ত নথি, আয়কর জমার তথ্য ও অর্থনৈতিক লেনদেনের নথি আছে। লেনদেনের সমস্ত নথি তাঁরা স্বচ্ছন্দে পরীক্ষা করে দেখতেই পারেন। কিন্তু, এই ধরনের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কারো বিরুদ্ধে কোনো FIR করা হয় নি – এসোসিএটেড জার্নালের বিরুদ্ধে নয়, ইয়ং ইন্ডিয়ানের বিরুদ্ধে নয়, সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে নয়, এমনকি রাহুল গান্ধী বা অন্য কোন শেয়ারহোল্ডার বা ALJ কিংবা ইয়ং ইন্ডিয়ানের ডাইরেক্টর দের বিরুদ্ধেও নয়।

কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা বা মিডিয়ার একাংশ পরিকল্পনা করে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী ও নেতা রাহুল গান্ধীকে ক্ষতিকারক ভাবে অপদস্থ করার জন্য তিনটি ভিত্তিহীন বিষয় নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছেন। যেখানে রাহুল গান্ধী কে ED ডেকে পাঠিয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য, তবুও বিজেপির মুখপাত্ররা ও বন্ধু মিডিয়ার লোকজন দিনরাত এক করে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি প্রমান করার উদায়স্ত পরিশ্রম করছেন :

১) ইয়ং ইন্ডিয়ান, একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান, যেভাবেই হোক ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এসোসিএটেড জার্নাল নামক সংস্থাটির সমস্ত সম্পত্তি অধিগ্রহণ করেছে।

২) সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী যাঁরা এখন ইয়ং ইন্ডিয়ানের শেয়ারহোল্ডার (যদিও আরো অনেকেই আছেন), তাঁরা নাকি এসোসিএটেড জার্নালের মালিক।

৩) AJL এর কাছ থেকে ইয়ং ইন্ডিয়ানের কাছে যেভাবে টাকার অবৈধ লেনদেন ও অর্থপাচার করা হয়েছে ED তা’ নিয়েই অনুসন্ধান করছেন। এছাড়াও, বিজেপি সরকার ২০১৫ সালে আয়কর আইন সংক্রান্ত যে সকল সংশোধনী এনেছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে ইয়ং ইন্ডিয়ান ২০১৬ সালে আয়কর ছাড় সংক্রান্ত যে সকল নথি সরকারের কাছে জমা করেছিল, তা’ নিয়েও অনেক বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। ইয়ং ইন্ডিয়ান সেই সকল নিবন্ধনগুলি জমা করে দিয়েছিল এই কারণে যে তাদের কাছে দানধ্যান করার মত উদবৃত্ত অর্থই ছিল না।

দিল্লিতে এই যে বৃহত্তম সুরক্ষাবলয় তৈরি করা, কংগ্রেসী নেতৃত্ব কে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিল করতে না দেওয়া, কংগ্রেসী নেতাদের আটকে রাখা বা তাদের গ্রেপ্তার করা, তাদের উপর অমানবিক নির্যাতন করা, বুধবারে কংগ্রেস সদর দপ্তরে ঝড়ের বেগে পুলিশের অনুপ্রবেশ – এ সবই হল এই বিতর্কটিকে আরো উস্কানি দেওয়ার নির্মম ষড়যন্ত্র।

তাই, এটি অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে জানিয়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয় যে :

১) এসোসিএটেড জার্নাল আজও সমস্ত সম্পত্তি তাদের নিজেদের অধিকারেই রেখেছে। ইয়ং ইন্ডিয়ান, AJLএর কোনো সম্পত্তি অধিগ্রহণও করে নি, বা নিয়ন্ত্রণও করে না।

২) বিজেপি যেভাবে মিথ্যা তথ্য পরিবেশিত করে বলছে যে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও ইয়ং ইন্ডিয়ানের একজন শেয়ারহোল্ডার বা ডাইরেক্টর, তাও সর্বৈব মিথ্যা। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী মোটেই ইয়ং ইন্ডিয়ান বা এসোসিএটেড জার্নালের শেয়ারহোল্ডার বা ডাইরেক্টর নন।

৩) কোনো শেয়ারহোল্ডার বা ডাইরেক্টর ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত AJL বা ইয়ং ইন্ডিয়ান থেকে বেতন, ভাতা, কোনোপ্রকার খরচ, ভাড়া, অনুদান, ডিভিডেন্ড, অস্থাবর সম্পত্তির হস্তান্তর বা অন্য কোন উপায়ে কোনো প্রকারের অর্থকরী লেনদেন করেন নি।

৪) ইয়ং ইন্ডিয়ান যেহেতু ধারা-২৫ অনুযায়ী একটি দাতব্য ও অলাভজনক সংস্থা, সেহেতু বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বা গুটিয়ে ফেললেও অন্য আর একটি কোন ধারা-২৫ এর অন্তর্ভুক্ত দাতব্য ও অলাভজনক সংস্থা ছাড়া কাউকেই তাদের স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারবে না।

যেহেতু AJLও এসোসিএটেড জার্নালের মধ্যে কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন হয় নি বা যেহেতু কোনো শেয়ারহোল্ডার বা ডাইরেক্টর কাউকেই কোনো ডিভিডেন্ড বা অন্য কোন ধরনের অর্থকরী সুবিধা দেওয়া হয় নি, তাই অর্থপাচারের অভিযোগও ধোপে টেকে না।

প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শ্রী পি চিদাম্বরম যেমন বর্ণনা করেছেন, “অর্থপাচার করতে গেলে অর্থ থাকাটা অত্যন্ত আবশ্যক। তাই সোনিয়া গান্ধী বা রাহুল গান্ধী “২০০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক প্রতারণা করেছেন”, তা’ সর্বৈব মিথ্যা, বুনিয়াদহীন ও মানহানিকর।

এটা সত্যি, যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ২০০১-০২ থেকে ২০১০-১১ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে চেকের মাধ্যমে AJL কে ৯০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল।

যার দুই তৃতীয়াংশ খরচ করা হয়েছিল যেসকল সাংবাদিক ও অন্যান্য কর্মচারীরা দীর্ঘদিন কাজ করে যাচ্ছিলেন তাদের বেতন, অবসরকালীন ভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটি ও স্বেচ্ছাবসরের টাকা মেটাতে।

এছাড়াও সেই ঋণ থেকে আয়কর ও অন্যান্য কর জমা দেওয়া, বিদ্যুতের বিল ও অন্যান্য যা যা দেয় ছিল, যা ঋণের বোঝা বাড়ার কারণে AJLকে সাময়িক ভাবে প্রকাশনা বন্ধ করতে বাধ্য করেছিল এবং ২০০৮ সাল পর্যন্ত মেটাতে অসমর্থ ছিল, তা’ মেটানো হয়েছিল।

কংগ্রেস এই ঋণ দিয়েছিল কারণ AJL নামক এই সংস্থাটি স্বাধীনতার পূর্বে কংগ্রেস মহারথী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, কৈলাসনাথ কাটজু, রফি আহমেদ কিদোয়াই, আচার্য নরেন্দ্র দেব, পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন প্রমুখদের মাধ্যমে স্থাপনা করা হয় – আর তা’ পরবর্তীকালে অত্যন্ত অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় পড়েছিল যার কারণে কর্মচারী ও সাংবাদিকদের বেতন দিতেও পারছিল না এবং এই ঋণ টি না পেলে যার ঝাঁপ ফেলা অবশ্যম্ভাবী ছিল।

এটাও সত্যি, ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠার সময় AJLএর তরফ থেকে যে স্মারকলিপি (memorandum of associatiom) জমা দেওয়া হয়েছিল তাতে পরিষ্কার উল্লেখ করা ছিল যে ম্যাগাজিন, পত্রিকা বা পাক্ষিক যাই প্রকাশিত হোক না কেন, তা’ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিচারধারা ও নীতির সাথে সাযুজ্য রেখেই করা হবে।

বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা শ্রী মতিলাল ভোরা ২০০১-০২ সালে AJL এর সভাপতি হন। ২০০৮ সালে এটির প্রকাশনা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় এটাও পরিষ্কার ছিল যে সমস্ত দেনা মিটিয়ে দেওয়ার পর AJL এর কাছে আর কিছু অবশিষ্ট নেই যা দিয়ে তারা কংগ্রেসের ঋণ শোধ করে।

২০০০ সালের শুরুর দিকেই AJL এর পুনরুদ্ধার ও একে কিভাবে বাঁচানো সম্ভব তা’ নিয়ে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল।

তাই, AJL এর শেয়ারহোল্ডারগন ২০১১ সালের জানুয়ারিতে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেন যে ধারা-২৫ নিয়ন্ত্রিত অলাভজনক সংস্থা ইয়ং ইন্ডিয়ানের নামে সমস্ত শেয়ার পরিবর্তিত করা হবে। AJL এর অতিরিক্ত বার্ষিক সাধারণ সভায় সমস্ত শেয়ারহোল্ডাররা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটাই বিজেপি ও সংঘ পরিবারের বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ পরিবেশনের মুখ্য প্রতিপাদ্য।

AJLএর সমস্ত শেয়ার ইয়ং ইন্ডিয়ানের নামে নির্দেশিত হওয়ার পর সেই ৯০ কোটি টাকার ঋণ ইকুইটিতে পরিবর্তিত করা হয় এবং AJL এর উপর থেকে সমস্ত ঋণ মকুব করা হয়।

সংস্থার এই নির্ধারিত পুনর্গঠনের ফলে অনেকগুলো উদ্দেশ্য সাধিত হয়। এসোসিএটেড জার্নাল লাল ফিতের বাঁধন থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয় ও আরো সংবাদপত্র ও ডিজিটাল প্লাটফর্মের সূচনার পটভূমিকা প্রস্তুত হয়। ঋণ ইকুইটিতে রূপান্তরিত হওয়াতে বহু বছরে এই প্রথমবার AJL এর একটি ভদ্রস্থ ব্যালান্স শিট তৈরি করা সম্ভব হয়। আর দাতব্য, অলাভজনক সংস্থা এটিও নির্দিষ্ট করে যাতে AJLবা ইয়ং ইন্ডিয়ানের কোনো শেয়ারহোল্ডার বা ডাইরেক্টর যেন আর্থিক ভাবে লাভবান না হন।

এতে প্রকাশনা সংস্থাটিকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হয় আর আজ নিউ দিল্লি, পাঁচকুল্লা ও মুম্বাই থেকে AJL হিন্দি ও ইংরাজি দুটি পৃথক ভাষায় সাতটি পর্বের দুটি আলাদা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করে যার ২০০০০ এর ওপর গ্রাহক। এছাড়াও হিন্দি, ইংরাজি ও উর্দু এই তিনটি ভাষায় ওয়েবসাইটও চালানো হয়। যেটি বার্ষিক অন্তত ১ কোটি ৮০ লাখ লোক দর্শন করে আর বার্ষিক প্রায় ৮ কোটি লোক এই ওয়েবসাইটগুলির প্রতিটি পাতার দর্শক।

AJL আজও সমস্ত সম্পত্তিরই মালিক। বিজেপি সরকারের আয়কর বিভাগ এর মূল্যায়ন করেছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার, ডঃ সুব্রামানিয়াম স্বামী ২০০০ কোটি টাকা বলে যেটিকে চালাতে চেয়েছিলেন। যা আজ AJL আয় করে তা’ পুরোটাই তাদের হিসেবের খাতায় তোলা আছে এবং পুরো টাকাটাই তাদের প্রকাশনা ও ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবসায় ব্যবহৃত হয়। বার্ষিক সাধারণ সভায় সমস্ত খরচের হিসেব পেশ করা হয় ও অনুমোদন দেওয়া হয় আর তা’ স্বাধীন অডিটর দ্বারা অডিট করা হয় ও তারপর আয়কর বিভাগে দাখিলও করা হয়। আজও AJL এর সমস্ত স্মারকলিপি বা পরিচালনসমিতির নিয়মাবলী অনুযায়ী, কাউকে কোনো ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ দেওয়া হয় না আর AJL তাই একটি জনস্বার্থে ব্যবহৃত অলাভজনক সংস্থা।

১৯৩৭ সালে শুরু হওয়ার পর থেকেই ন্যাশনাল হেরাল্ড ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এর সম্পাদক হয়েছেন কে রামা রাও, চলপতি রাও এবং খুশবন্ত সিংহের মত নামী ব্যক্তিত্ব যারা অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিককে তৈরিও করেছেন।

ন্যাশনাল হেরাল্ডই ভারতের প্রথম সংবাদপত্র যার সম্পাদকীয় অংশটি ফাঁকা রাখা হত। যখন সংবাদপত্রের শিরোনামগুলি সেন্সর করা শুরু হয়, তখন তারা শিরোনাম ছাড়াই সংবাদপত্র প্রকাশ করত। কিছুদিন তো এমনও হয়েছিল যে কর্মচারীরা নিজেরাই কমিউনিটি রান্নাঘর তৈরি করে, অফিসে থেকে, ঐচ্ছিক বেতন কাটিয়েও এই সংবাদপত্র প্রকাশ করেছেন।

জওহারলাল নেহরু একবার নিজের পৈতৃক নিবাস এলাহাবাদের ইন্দিরা ভবন বেচেও ন্যাশনাল হেরাল্ডের বন্ধ হয়ে যাওয়া কে রুখতে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে এই সংবাদপত্রের ভূমিকা ও নেহরু তথা আরো অনেক প্রথিতযশা কংগ্রেসী নেতৃত্বের আবেগের কথা মাথায় রেখে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বরাবর এই সংস্থাকে সহায়তা প্রদান করে এসেছে।

তাহলে এত গোলমাল কিসের ?

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *