অশোক ভট্টাচার্য ( রাজা) :
গান্ধীর পথের সঙ্গে তাঁর অনেক দূরত্ব ছিলো এ কথা শুনতে শুনতে আমরা যারা বড় হয়ে উঠেছি,তারা আংশিক সত্যের মধ্যে ঘোরাঘুরি করেছি মাত্র। বরং গান্ধীর মতের সঙ্গে নজরুল পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষেত্রে অমত প্রকাশ করেছেন, এ কথার মানে এটাও তো দাঁড়ায় যে, বাকি পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে মিল ছিলো। গান্ধী সম্পর্কে নজরুলের মূল্যায়ন এবং কংগ্রেসের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক একরৈখিক নয়, একথা যেমন সত্য তেমনই এটাও সত্য যে, গান্ধীর গ্রাম-স্বরাজ এবং স্বাধীন অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ার ভাবনা নজরুলকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছিলো।এ প্রসঙ্গে নজরুল গবেষণার অন্যতম আকর গ্রন্থ কমিউনিস্ট নেতা মুজফফর আহমেদের লেখা ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ শীর্ষক গ্রন্থটি আমাদের সামনে বেশ কিছু তথ্য নিয়ে আসে। মুজজফর আহমেদের গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের প্রতি নজরুলের ছিলো এক নির্মোহ সমর্থন। জানা যায় নজরুলের সঙ্গে গান্ধীর প্রথম মুখোমুখি দ্যাখা হয় হুগলিতে, তারপর ১৯২৫ এর মে মাসে ফরিদপুরের কংগ্রেস অধিবেশনে। এই অধিবেশনে মহাত্মা এবং দেশবন্ধুর উপস্থিতিতে নজরুল নিজের লেখা ১২ চরকার গান পরিবেশন করেছিলেন। তার এক বছর আগে হুগলিতে নিজের গলায় এই গান মহাত্মাকে প্রথম শুনিয়েছিলেন স্তুতি করে নজরুল লিখেছেন–
“তুই সাত রাজারই ধন
দেশ-মা’র পরশ-রতন,
তোর স্পর্শে মেলে স্বর্গ অর্থ কাম্য মোক্ষ মন।”
গান্ধীজি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসাবেই ‘চরকা’ র ধারণা সামনে এনেছিলেন, সেই ধারণাকে আত্মস্থ করে নজরুল ভাবছেন –এই চরকাই যেমন স্বদেশী ভাবনার প্রাণ ভোমরা, তেমনই আবার জোর জুলুমের বিরুদ্ধে দশম গ্রহ, বিষ্ণু – চক্র ভীম কঠোরঃ
ঘোর-
ঘোর রে ঘোর ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর
ওই স্বরাজ-রথের আগমনি শুনি চাকার শব্দে তোর।।”
আবার এই গানেই কবি লিখছেন–
” ঘর ঘর তুই ঘোর রে জোরে
ঘর্ঘরঘর ঘূর্ণিতে তোর
ঘুচুক ঘুমের ঘোর।
তোর ঘুর- চাকাতে বল-দর্পীর তোপ কামানের টুটুক জোর।”–অর্থাৎ তোপ-কামানের হিংস্রতাকেও ম্রিয়মান করে দিতে পারে অহিংস চরকার কর্মপ্রবাহ। অসহযোগ আন্দোলন চলছে। সেই সময় নজরুল লিখছেন —
” এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মা’র আঙ্গিনায়।
ত্রিশ কোটি ভাই মরণ-হরণ গান গেয়ে তাঁর সঙ্গে যায়।
।অধীন দেশের বাঁধন-বেদন কে এলো রে করতে ছেদন?
শিকল-দেবীর বেদীর বুকে মুক্তি – শঙ্খ কে বাজায়।।”
–বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না যে, এই ‘পাগল পথিক’ মানে গান্ধীজিকেই বুঝিয়েছেন নজরুল।
নজরুলের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু কাকাবাবু মুজফফর আহমেদের লেখা থেকে জানা যায় গান্ধীজিকে লক্ষ করে নজরুলের লেখা যতসম্ভব প্রথম কবিতাটি হলো–“ইরাফিলের শিঙ্গা বাজে আজকেঈশান-বিষাণ সাথে,প্রলয়-রাগে নয় রে এবার ভৈরবীতে দেশ জাগাতে।পথের বাধা স্নেহের মায়ায়পায় দলে আয় পায় দলে আয়!রোদন কিসের? আজ যে বোধন!বাজিয়ে বিষাণ উড়িয়ে নিশান আয় রে আয়।।”
মহাত্মা গান্ধীর প্রতি নজরুলের মনোভাব আরো স্পষ্টরূপে আমরা লক্ষ করি তাঁর লেখা ‘ উপেক্ষিত শক্তি উদ্বোধন ‘ প্রবন্ধে। নজরুল সেখানে লিখছেন –“এ কথা হয়ত তোমাদের বিশ্বাস হইবে না, কিন্তু এই সে দিনকার সত্যাগ্রহ,হরতালের কথা মনে কর দেখি,একবার মহাত্মা গান্ধীর কথা ভাবিয়া দেখ দেখি।তিনি আজ ভারতে কি অসাধ্য সাধন করিতে পারিয়াছেন।”–কি সেই অসাধ্য সাধন? সেটা হলো জাতপাতহীন, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা। হিংসা এবং দ্বেষ মুক্ত রাজনীতির চর্চা। যে চর্চার বড় অভাব আজকের ভারতে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, পরবর্তী সময়ে গান্ধীর রাজনৈতিক পথের বিপরীতে হেঁটেছিলেন নজরুল। দুনিয়া জোড়া কমিউনিজমের আলোড়ন তাঁকেও নাড়িয়ে দিতে পেরেছিলো। সে কথা অন্যত্র আলোচনা করা যাবে। কিন্তু দু’জনে এক মূল বিন্দুতে মিলেছিলেন। কোন সে বিন্দু?
গান্ধী সম্পর্কে নজরুলের মূল্যায়নঃ
“চিনেছিলেন খ্রিষ্ট বুদ্ধ
কৃষ্ণ মোহাম্মদ ও রাম –
মানুষ কী আর কী তার দাম।
(তাই) মানুষ যাদের করত ঘৃণা,
তাদের বুকে দিলাম স্থান
গান্ধী আবার গান সে গান।”
–কিন্তু গান্ধীর সেই গানকে অন্তরে নিতে পারিনি আজকের ভারত, তাই তো নজরুল গেয়ে ওঠেন —
“হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি — ভাব্লি এতেই জাতির জান,
তাইত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশ’-খান।
এখন দেখিস ভারত জোড়া
পচে আছিস বাসি মড়া,
মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া॥”