নেতাজির আজাদ হিন্দ সরকার : ধর্মনিরপেক্ষতার মূর্ত প্রতীক

নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ ও আজাদ হিন্দ সরকার ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূর্ত প্রতীক।নেতাজি ১৯৪৩ এর ৮ ফেব্রুয়ারি জার্মানির কিয়েল বন্দর থেকে রওনা দিয়ে ৬ মে বিপদশঙ্কুল সমুদ্রপথ ডুবোজাহাজে অতিক্রম করে উত্তর সুমাত্রার সাবাং দ্বীপে পৌঁছন।এই পথে তাঁর সঙ্গী ছিলেন আবিদ হাসান।তারপর টোকিও হয়ে ১৯৪৩ এর ২ জুলাই দুপুরে একটি ছোট যুদ্ধ বিমানে করে তিনি আবিদ হাসানকে নিয়ে এসে নামলেন সিঙ্গাপুরে। হিন্দুস্তানি ভাষায় মুমতাজ হুসেনের লেখা ও রাম সিংহ ঠাকুরের সুর দেওয়া গান গেয়ে অভ্যর্থনা জানানো হল প্রিয় নেতাকে :-” সুভাষজি সুভাষজি উয়ো জান – এ হিন্দ আ গয়ে, উয়ো নাজ জিসপে হিন্দ কো, উয়ো শান – এ- হিন্দ আ গয়ে।” সুভাষচন্দ্র হচ্ছেন এশিয়ার আলো – ‘ এশিয়াকে আফতাব ‘ এবার এশিয়াতে এসে গিয়েছেন ,এই হচ্ছে গানের বক্তব্য। ৪ জুলাই সিঙ্গাপুরের ক‍্যাথে থিয়েটারে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাদের ও ভারতীয়দের এক বিশাল জমায়েতে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব সুভাষচন্দ্রের হাতে তুলে দেন।

১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে গঠিত হয় আজাদ হিন্দ সরকার। হিন্দুস্তানি ভাষায় ‘ আর্জি এ হুকুমত এ আজাদ হিন্দ ‘। সরকারের প্রধান হলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র। অপর যাঁরা মন্ত্রী হলেন তাঁরা হলেন এ সি চ্যাটার্জি – অর্থ, এস এ আইয়ার – পাবলিসিটি , লক্ষী স্বামীনাথন – নারী বিষয়ক বিভাগ।

সামরিক বাহিনীর আট জন অফিসার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হলেন। এঁরা হলেন :–আজিজ আহমেদ, এন এস ভগৎ , জে কে ভোঁসলে , গুলজার সিং,মহম্মদ জামান কিয়ানী,এ ডি ‌লোগানাথন , এহসান কাদির এবং শাহ নওয়াজ খান। আনন্দমোহন সহায় হলেন ক্যাবিনেট সচিব। এছাড়া মালয়, বর্মা ও থাইল্যান্ড থেকে উপদেষ্টা গোষ্ঠীতে রাখা হল:-করিম গনি ,দেবনাথ দাস, ডি এম খান ,জন থিভি, আত্তাবর ইয়েলাপ্পা, সর্দার ইশোর সিংহ এবং এ এন সরকারকে। নেতাজি সব ধর্মমতের ও বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে নিয়ে তাঁর মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। কোনও সংকীর্ণতা তাঁকে স্পর্শও করেনি।

এই সরকারের ভাষা ছিল হিন্দুস্তানি, যা হচ্ছে হিন্দী ও উর্দুর মিশ্রণ।হরফ রোমান।তবে তামিল ভাষী জনতার কথা চিন্তা করে সব সরকারি নির্দেশ তামিল ভাষায় অনুবাদ করে দেওয়া হত।নেতাজি ‘ জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে ‘ গানটি সহজ হিন্দুস্তানি ভাষায় ( উর্দু ) অনুবাদ করেন এবং তা হল জাতীয় সঙ্গীত।পতাকা হল তেরঙ্গা। মধ্যে গান্ধিজির চরকা।আর টিপু সুলতানের বীরত্বের কথা স্মরণ করে সেনাদের পোশাকের কাঁধে রাখা হয় তাঁর প্রতীক ‘ লম্ফনরত বাঘ ‘। আজাদ হিন্দ সরকার ও সেনাবাহিনীর আদর্শ মন্ত্র হল ইতমদ (বিশ্বাস ), ইত্তেফাক (ঐক্য ) এবং কুরবানি (ত্যাগ )।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র তাঁর সংগ্রামের রূপরেখা প্রস্তুত করেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা আদর্শের ওপর ভিত্তি করে।আজ হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি যারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্তাবক ছিল , তারা নেতাজির নাম ব্যাবহার করার চেষ্টা করছে।তাদের এই অপচেষ্টা রোধ করতে হবে। নেতাজী স্বাধীন ভারতকে কখনও একটি হিন্দুত্ববাদী দেশ হিসাবে কল্পনা করতেন না। তাঁর সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা ছিল হিন্দুস্তানি, যা হিন্দি ও উর্দুর এক মিশ্রিত রূপ। তার অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পাশ্চাত্যের উন্নত প্ৰযুক্তি এবং সমাজতন্ত্রের সংমিশ্রণে। যে কোনও সমাজে উন্নতির পথে নারীজাতির ভূমিকা প্রশ্নাতীত।নেতাজি তাঁর ‘ ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল ‘ গ্রন্থে লিখেছেন ভারতে ব্যাপক নারী জাগরণ ও স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁদের ব্যাপক অংশ গ্ৰহণের পথিকৃৎ মহাত্মা গান্ধি। সুভাষের কাছে যুগ যুগান্তরের মানবিক অবক্ষয়ের সব থেকে বড় উদাহরণ ছিল ভারতে হিন্দু-মুসলমান সমাজে নারীদের সামাজিক অধোগতি। তিনি তাই তাঁর সরকারে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথনকে পূর্ণ মর্যাদায় সমগ্র নারীসমাজের পূর্ণাঙ্গ উন্নয়নের দায়িত্বভার দেন। অনুরূপভাবে গান্ধিজিও বারংবার তাঁর নানা লেখায় নারীর স্বাধীনতা ও উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছিলেন।

১৯৪৩ এর ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের ক্যাথে থিয়েটারে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানি ও বিপুল সংখ্যক ভারতীয়দের উপস্থিতিতে ‘ আজাদ হিন্দ সরকার ‘ , হিন্দুস্তানি ভাষায় ‘ আর্জি হুকুমত এ আজাদ হিন্দ ‘ গঠিত হয়। নেতাজির নিজের করা খসড়া ঘোষণাপত্র নিজে পাঠ করেন।ঘোষণাপত্রে বলা হয় :–

‘ …..এই সাময়িক সরকার (Provisional Government ) নিজের অধিকারবলে সকল ভারতীয়ের আনুগত্য দাবি করছে।সকল নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা , সমান অধিকার , সমান সুযোগের অধিকার নিশ্চিত করা এই সরকারের কর্তব্য।অতীতে বিদেশি শাসকের দুষ্ট অভিসন্ধির ফলে যত রকম বৈষম্য আজ প্রকট হয়ে উঠেছে , সেই সমস্ত বৈষম্য দূর করে সমগ্র জাতিকে সুখ ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় অভীপ্সা ঘোষণা করছে এই সরকার।’

আজাদ হিন্দ সরকারের আদর্শ হল তিনটি উর্দু শব্দ : – ইতমদ ( বিশ্বাস) , ইত্তেফাক (ঐক্য) এবং কুরবানি (ত্যাগ)। সরকারের পতাকার রঙ তেরঙ্গা , মধ্যে থাকল গান্ধিজির চরকা। উল্লম্ফনরত ব্যাঘ্র থাকত ইউনিফর্মের কাঁধে ত্রিবর্ণ অংশের ওপরে, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে টিপু সুলতানের সাহসী প্রতিরোধের কথা স্মরণ করে।

হিন্দি আর উর্দুর মিশ্রণে গড়ে ওঠা হিন্দুস্তানি ভাষা , আর রোমান লিপি – জাতীয় ভাষা ও জাতীয় লিপি হিসাবে নির্ধারিত হল।দক্ষিণ পুব এশিয়ায় বিপুল তামিল জনসংখ্যার কথা চিন্তা করে সরকারের নির্দেশগুলি তামিল ভাষায় অনুবাদ করে দেবার সিদ্ধান্ত হয়।

দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দিতে নেতাজি বাহিনীর তিনটি ব্রিগেডের নামকরণ করলেন মহাত্মা গান্ধি, পন্ডিত নেহরু ও মৌলানা আজাদের নামে। নারীবাহিনীর নাম হল ‘ ঝাঁসির রানী ব্রিগেড ‘। আর আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনারা একটি ব্রিগেডের নামকরণ করলেন ‘ নেতাজি ব্রিগেড ‘

সহজ হিন্দুস্তানি ভাষায় অনুবাদ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘ জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ‘ হল জাতীয় সঙ্গীত।নেতাজির নির্দেশে আবিদ হাসান ও মুমতাজ হুসেন গানটির মূল ভাব অনুবাদ করেন।গানের দ্বিতীয় স্তবকে কবিগুরু লিখেছিলেন :-

‘অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণীহিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানীপূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশেপ্রেমহার হয় গাঁথা।’

আজাদ হিন্দের সেনানীরা গাইলেন :’ সব কে দিল মে প্রীত বসায়ে তেরি মিঠি বাণী হর সুবে কে রহনেওয়ালে হর মজহব কে প্রাণী সব ভেদ ঔর ফারাক মিটাকে সব গোদ মে তেরি আকে ;গুঞ্জে প্রেম কি মালা।’

আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রতিটি সেনাই দেখা হলে পরস্পরকে ‘ জয় হিন্দ ‘ বলে সম্বোধন করতেন।নেতাজি ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতবর্ষের বহুত্ববাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতার মহান আদর্শের প্রতি অন্তর থেকে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।এই বাহিনীতে ব্রিটিশ আর্মির মতন ধর্মভিত্তিক পৃথক পৃথক ‘ চৌকা ‘ অর্থাৎ ‘রান্নাঘর’ ছিলোনা । সবার জন্য একই চৌকা। কোনও ধর্ম ও জাতের বিভাজন ছিলোনা। যুদ্ধের পর বন্দী আজাদ হিন্দ সেনাদের দেশে নিয়ে আসা হয়।গান্ধিজি যখন তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে যান ,তাঁরা অভিযোগ করেন যে ব্রিটিশ সরকার আবার ধর্ম অনুযায়ী পৃথক পৃথক চৌকা চালু করেছে , যা নেতাজির নীতির বিরোধী।গান্ধিজি তাঁদের বলেন ‘ তিনি ব্রিটিশ সরকারকে বলবেন আজাদ হিন্দের বন্দি সৈন্যদের জন্য তাদের প্রথা অনুযায়ী সব বন্দিশালায় একই চৌকা চালু করতে।’ এই শুনে বন্দী সেনারা বলেন তারা নিজেদের মতন ব্যবস্থা করে নিয়েছেন, তারা পৃথক পৃথক চৌকা থেকে খাবার এনে একসঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে খান। এই কথা শুনে গান্ধিজি অভিভূত হন। তিনি বলেন ‘ সুভাষ অসাধ্য সাধন করেছে।’

মন্ত্রিসভার সদস্য ও বাহিনীর অন্যতম সেনাধ্যক্ষ শাহ নওয়াজ খান তাঁর ‘ আজাদ হিন্দ ফৌজের ইতিহাস ও নেতাজি ‘ গ্রন্থে নেতাজির ধর্ম নিরপেক্ষ মন , নীতি ও কাজের অসংখ্য উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি তাঁর দুঃসাহসিক অন্তর্ধানের পর পেশোয়ারে গিয়ে যাঁর কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি মোহাম্মদ আকবর শাহ ।জার্মানি থেকে জাপান তাঁর দুঃসাহসিক সাবমেরিন যাত্রার একমাত্র ভারতীয় সঙ্গী আবিদ হাসান। কোহিমা ও ইমফল অভিযানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন শাহ নওয়াজ খান ও মোহাম্মদ জামান কিয়ানীকে। মণিপুরের মৈরাঙ পতনের পর যিনি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন তিনি সৈকত মালিক। নেতাজি সিঙ্গাপুর থেকে অনির্দেশের উদ্দেশে তাঁর শেষ বিপজ্জনক যাত্রায় যাঁকে সঙ্গী করেন তিনি কর্নেল হাবিবুর রহমান।আর লালকেল্লার সামরিক আদালতে যে তিনজন আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানায়কের বিখ্যাত বিচার হয়েছিল তাঁরা হলেন শাহ নওয়াজ খান, প্রেমকুমার সায়গল ও গুরুবক্স সিং ধীলন।একজন মুসলমান, একজন হিন্দু ও একজন শিখ। আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যান্য সেনাধ্যক্ষদের স্মৃতিচারণেও একই কথা উঠে এসেছে।

ভারতবর্ষের মতো এত বিশাল এক মহাদেশে যে কেবল একটা রাজনৈতিক পথ থাকবে, সংখ্যাগুরুর ধর্মের সর্বগ্রাসী আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে এই কথা গান্ধিজি , নেতাজি সুভাষ বা পন্ডিত নেহরুর কোনও লেখায় পাওয়া যাবে না।

তবে এই বিরোধের কথা আছে কাদের বইয়ে? সংঘ পরিবারের। আজ নেতাজী তাদের কাছে রণবেশধারী সেনাপতি, হিন্দু, মানে এক বিশেষ রকমের হিন্দু, যিনি পৌরুষে ভরপুর, মুসলিম বিতাড়নের মহাসৈনিক হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছেন— রাজধানী দিল্লির বিখ্যাত রাজপথে, ইন্ডিয়া গেটের ঠিক পাশে।

শান্তনু দত্ত চৌধুরী।
Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *