রাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথ

অনির্বান চৌধুরী :

রাজনীতি চিন্তার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করেন,’জীবনের যা কিছু মহত্তম দান তার পূর্ণ বিকাশ আমাদের অন্তঃপ্রকৃতির মধ্য থেকেই’। রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি চিন্তার প্রথমেই এসেছে রাষ্ট্র বনাম সমাজ সম্পর্কিত বিতর্ক অর্থাৎ রাষ্ট্র বড় না সমাজ বড়।

ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাই ,সেখানে পারিবারিক ব্রাহ্ম পরিবেশ, হিন্দু মেলার আধ্যাত্মিক ও সাংগঠনিক কাজকর্ম,সঞ্জীবনী সভার গুপ্ত স্বাদেশিক ভাবনা তাঁকে প্রভাবিত করেছে। কংগ্রেসের এই পর্বে অধিবেশনগুলোতে স্বদেশচিন্তা ও জাতি গঠনের প্রশ্ন তাঁকে নাড়া দিয়েছে।বিশ শতকের সূচনাকাল থেকেই রবীন্দ্রমানসের এক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল।এই সময় লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা একই সঙ্গে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ ও ইউরোপীয় উদারবাদের বিরুদ্ধে কবিকে ক্ষুব্ধ করেছে। সাম্রাজ্যবাদ ও অতি জাতীয়তাবাদী প্রবণতার কবির ধিক্কার,বিশ্বজনীন ভাবনা এই পর্বেই প্রকাশিত হয়েছে। 1910 থেকে 1925 এই পর্বে রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা সাম্রাজ্যবাদ,কুসংস্কার,সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার। পাশাপাশি সমাজ সংস্কার, গ্রাম সংগঠন , বিশ্বমানবতা ইত্যাদি নানা প্রশ্নে কবির গঠনমূলক ভাবনা প্রকাশ পায়।

রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় দেশের মানুষ, দেশের মাটিই অগ্রাধিকার পেয়েছে। ফলত তাঁর রাজনীতিতে রাষ্ট্র বনাম সমাজ এই বিতর্কে সমাজভাবনা বা মানবভাবনাই গুরুত্ব লাভ করেছে।তাই তাঁর কাছে সমাজের স্বাধীনতাই দেশের স্বাধীনতা।’চরকা’ (কালান্তর) প্রবন্ধে তিনি প্রচলিত রাজনীতিকে দেশগত মানুষের জীবিকা বলে বর্ণনা করেছেন।দেশের লোক বা রাষ্ট্রনায়কদের বিষয়বুদ্ধি এই রাষ্ট্রনীতিতে আত্মপ্রকাশ করে।আর এই বিষয়বুদ্ধিই হলো ভেদবুদ্ধি। কবির বক্তব্য, এই ভেদবুদ্ধির দ্বারা চালিত হয়ে বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্র তাদের নিজস্ব স্বার্থ চরিতার্থ করার আয়োজনে নিযুক্ত থাকে। আর তার ফলে মিথ্যা দলিল আর অস্ত্রের বোঝা কেবলই ভারী হয়ে উঠছে।এই বোঝা বাড়ানোর আয়োজনে পরস্পর পাল্লা দিয়ে চলেছে।রবীন্দ্রনাথ রাজনীতির এই স্বার্থসর্বস্ব ধারণাকে অতিক্রম করে এক নতুন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিলেন।

রাজনীতি তাঁর কাছে ব্যাপক অর্থ লাভ করে স্বদেশি ভাবনা,মানবতার ভাবনা,বিশ্ব মানবতার দৃষ্টিতে। ম্যাকিয়াভেলিয় চাতুর্যের দ্বারা চালিত রাজনীতি নয়,রবীন্দ্রনাথ চান প্রেমের ডাকে ভারতবর্ষের উদ্বোধন।দেশের শক্তিকে দেশের সৃষ্টিকার্যে নিয়োজিত করাই আসল কথা। ভারতের উদ্বোধনকে সমগ্র পৃথিবীর উদ্বোধনের অঙ্গ হিসেবেই তিনি দেখেন। ভেদবুদ্ধি বা সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি নয়,মানুষের শুভবুদ্ধির উদ্বোধনের মাধ্যমেই চলবে এই রাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের কাজ। জনহীন দ্বীপে রবিনসন ক্রুশোর স্বাধীনতা তাঁর কাম্য নয়,পারস্পরিক সম্বন্ধের মধ্যেই আছে প্রকৃত স্বাধীনতা,সেখানে ভয় নেই, অবিশ্বাস নেই, ভেদ নেই। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন,ভেদটাই দুঃখ,সে ভেদ বিদেশির সাথেই হোক আর স্বদেশির সাথেই হোক। এই ভেদবুদ্ধি বিচ্ছিন্নতা বাড়ায়, সমৃদ্ধির পথে চলতে বাধা দেয়।

রবীন্দ্রনাথ ভারতের রাজনীতিতে মানুষের স্থান নেই দেখে মর্মাহত হন। তিনি দেখেন,ভারতের রাজনীতি কীভাবে শিকড় ছড়িয়েছে উপরওয়ালাদের মহলে।রাজশক্তি আর ভদ্রলোক মিলে ভারতের রাজনীতি ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়েছে। তিনি লক্ষ্য করেন,এদেশের রাজনীতিবিদ আর সাধারণ মানুষের মধ্যে কী অসীম দূরত্ব ! …

রবীন্দ্রনাথের মানবচিন্তাই হলো তাঁর স্বদেশচিন্তার প্রেরণা আর এই স্বদেশচিন্তাই হলো তাঁর জীবনসাধনার অঙ্গ। এই সমাজ বা রাষ্ট্রচিন্তাই হলো রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাষ্যের মূল কথা যার মধ্যে নিহিত রয়েছে,মানুষ, মিলন,প্রেম,সমাজ গঠন। তাঁর স্বদেশচিন্তার অখন্ড দৃষ্টিতে এসেছে সংস্কৃতি, সমন্বয় ও মানবিক ঐক্যের ভাবনা আর এই স্রোত গিয়ে মিশেছে বিশ্ববোধের মহাসমুদ্রে। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায় , ‘ও আমার দেশের মাটি,তোমার পরে ঠেকাই মাথা, তোমাতে বিশ্বমায়ের,তোমাতে বিশ্বময়ীর আঁচল পাতা’।

ভারতের ইতিহাসের নানা পথে তিনি অসামঞ্জস্য দেখেছেন। কিন্তু সৃষ্টির ভাবনা, গঠনের ভাবনা, মিলনের ভাবনায় এই অসামঞ্জস্যতাকে তিনি অতিক্রম করতে চেয়েছেন। উপনিষদের ‘এক’এর মহান আদর্শের উপর তিনি স্থাপন করতে চেয়েছেন তাঁর ধ্যানের ভারতকে যে উপনিষদ শুনিয়েছিল উদার বিশ্ববোধের বাণী..’বসুধৈব কুটুম্বকম’। জাতীয়তাবাদের নামে জাতিগত অভিমানকে তিনি ঘৃণা করেন। তাই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন বা নিয়মতান্ত্রিক ইউরোপীয় ধাঁচের জাতীয়তাবাদ কোনোটাই তাঁর পছন্দ নয়। এমন মনে করার কারণ নেই যে, ইংরেজের শাসননীতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলনকে তিনি সমর্থন করেন না কিন্তু তাঁর বিশ্বাস শুধু বিচ্ছিন্ন উত্তেজনায় জাতীয় আন্দোলনকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানো যায় না। ফলে তার সাফল্য আসতে পারে না। জাতিকে তাই তিনি গঠনমূলক কর্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রস্তুত হতে বলেন। ফরাসি চিন্তাবিদ রেনার শিক্ষাকে গ্রহণ করতে বলেন। রেনার অনুসরণে তিনি বলেন, ‘নেশন একটি সজীব সত্তা….দুইটি জিনিস নিয়ে এই পদার্থের অন্তঃপ্রকৃতি গঠিত করিয়াছে। একটি হইতেছে, সর্বসাধারণের প্রাচীন স্মৃতিসম্পদ আর একটি পরস্পর সম্মতি,একত্রে বাস করিবার ইচ্ছা।’ ভারতীয় জাতীয়তার শক্তি হলো বিচিত্রকে এক করে তোলার ইচ্ছা। মিলনশক্তির উদ্ভবে তা সার্থক করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

তাঁর জাতীয়তাবাদী চিন্তায় ধন অর্জন, প্রভুত্ব অর্জন, হানাহানি,কাড়াকাড়ি , সাম্রাজ্যবাদের নীতি, আগ্রাসী নীতি সম্পূর্ণ বর্জিত। তাঁর কাছে নেশনতত্ত্ব নয়, মনুষ্যত্ব তথা সমাজতত্ত্বই বড়। রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত দেশপ্রেমবিরোধী জাতীয়তাবাদী চিন্তা আন্তর্জাতিকতার উদার অঙ্গনে এসে মিলে যায়। রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিকতার ভাবনার প্রথম কথা, দেশের মানুষকে ত্যাগের দ্বারা আপন করা, দ্বিতীয় কথা,পৃথিবীর সমস্ত দেশ ও সমস্ত জাতি নিয়ে যে মানুষের ইতিহাস গড়ে উঠেছে তাকে জানা,তৃতীয় কথা, মানুষের সত্য নিহিত বিশ্বমানবের মধ্যে, শেষ কথা, জগৎকে ভালোবাসা। ……………………………………………কবির স্বদেশচিন্তা যা বিশ্বচেতনায় একীভূত তা শুধুমাত্র কল্পনার বাতাস মনের ভিতর প্রবেশ করিয়ে নয় বা প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্ট নয়। তিনি দেশে দেশে ঘুরেছেন । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলার পর তিনি গেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে, দেখেছেন মানবতার অপমৃত্যু, দেখেছেন উগ্র জাতীয়তার আগুন জ্বেলে জাতীয়তার নামে ‘বাণিজ্যের সঙ্গে সাম্রাজ্যের গান্ধর্ব বিবাহ’ আর মানবতার বুকে ছুরিকাঘাত। স্বার্থান্ধ জাতিপ্রেম কীভাবে প্রেক্ষিত তৈরি করেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের তাও কবি দেখেছেন প্রত্যক্ষভাবে। তিনি মিশেছেন কত মানুষ, সাহিত্যিক,লেখকদের সাথে, দেওয়া-নেওয়া করেছেন অভিজ্ঞতার। জাতীয়তাবাদ কীভাবে আধিপত্যবাদের রূপ নিয়ে দেশের মানুষ ও অন্য দুর্বল জাতিকে লাঞ্ছিত ,অপমানিত করেছে , সভ্যতার নামে এক অন্ধকার সমাজের ছবি তৈরি করেছে যেখানে না আছে দেশপ্রেম, না আছে সমাজ গঠন তা রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছেন গভীরভাবে। মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ না ঘটলে,জাতিসমূহের সহযোগিতা বৃদ্ধি না পেলে সভ্যতার বিকাশ হতে পারে না। পঙ্গু ব্যবস্থায় কোনো দেশের বিকাশের পথও রুদ্ধ হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের কথায় নেশনতন্ত্র হলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংঘের এক যান্ত্রিক উদ্দেশ্য অন্ধ স্ব-জাতি গর্ব ও পরজাতি বিদ্বেষ (gigantic vanity of selfishness) এতে ধ্বনিত। লোভ, স্বার্থের দ্বন্দ্ব এই জাতিতন্ত্রের মর্মকথা।যুদ্ধ, রেষারেষি, শক্তি পরীক্ষা ,অস্ত্র পরীক্ষার এক বিশাল রণাঙ্গনে এক জাতি অন্য জাতির সম্মুখীন হয়। মানবিক আদর্শ এখানে ভূলুন্ঠিত। …..দেশপ্রেমের মোড়কে এই সাইকো ফ্যানাটিসিজম রবীন্দ্রনাথের কাম্য ছিল না। একত্বের মধ্যে বহুত্বের বিকাশ আবার বহুত্বের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের বিকাশই ছিল তাঁর রাজনীতির ভাষ্য , এই ছিল তাঁর স্বদেশচিন্তা, সমাজচিন্তা,জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা , এই ছিল তাঁর মানবতার মর্মকথা।

ছবিঃ সংগৃহীত

( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

#tagore&congressidea

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *