মে দিবসের আলোকে বর্তমান শ্রমিক শ্রেণীর  সংকট

শুভাশিস মজুমদারঃ

১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে ৮ ঘন্টা কাজ, উপযুক্ত বিশ্রাম ও মর্যাদার দাবিতে ধর্মঘট সহ আন্দোলনে নেমেছিলেন শ্রমিকেরা। পুলিশের গুলিতে বহু শ্রমিক নিহত হন, মৃত্যু হয়েছিল ৭ পুলিশের। ফাঁসি দেওয়া হয় চার শ্রমিক নেতাকে। কিন্তু শ্রমিকদের এই দাবি পরে ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপ ও অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশগুলিতে। ১৮৯০ সালের ১ মে গোটা দুনিয়ায় শ্রমিকেরা মে দিবস উদযাপন শুরু করেন।   

 আমাদের দেশেও স্বাধীনতার পূর্বে সভা সমাবেশ হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে ১৯১৮ সালে গান্ধীজি আমেদাবাদে নীল শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করেন। দেশের প্রথম শ্রমিক সংগঠন এ আই টি ইউ সি -র সভাপতি ছিলেন লালা লাজপত রাই। পরবর্তী কালে পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, নেতাজি সুভাষ, ভিভি গিরি, এম এন জোশি, শিবনাথ ব্যানার্জি প্রমুখ কংগ্রেস নেতা এই সংগঠনের সভাপতি হন। তাই শ্রমিক স্বার্থে স্বাধীনতা পূর্ব কাল থেকেই কংগ্রেস আন্দোলন করে এসেছে। স্বাধীন ভারতে শ্রমিক স্বার্থে শ্রম আইন কার্যকর করা হয়। ন্যূনতম মজুরি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা অনেক ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত নয় বলে দেখা যায়। বিভিন্ন কারনে শ্রমিকদের শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়।যদিও বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের ছত্র-ছায়ায় শ্রমিকেরা সঙ্গবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু এই ট্রেড ইউনিয়নগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংগঠন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতভেদ ও সংঘর্ষের কারনে তাই শ্রমজীবী মানুষের সার্বিক একতা সর্বদাই বাধা প্রাপ্ত। 

কেন্দ্রের বর্তমান শাসকদল ধর্ম এবং জাতপাতের নামে সমাজে যে ক্রমাগত বিভেদ সৃষ্টি করছে, তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শ্রমিকদের একতায়। কৃষক ও শ্রমিক অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাদপদ শ্রেণীভুক্ত। তাঁদের মূল লড়াইটা ধনীক শ্রেণীর শোষণের বিরুদ্ধে, নিজেদের মধ্যে জাতপাতের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে তাঁরা নিজেদের দুর্বল করলে তাঁদের সংগ্রাম কখনোই সফল হবে না।                 

করোনাকালে লকডাউনের ধাক্কায় সারা দেশে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। ২৩ কোটি ভারতীয় নতুন করে দারিদ্র সীমার নীচে চলে গেছে, অথচ সেই সময়েই দেশের কর্পোরেটগোষ্ঠীর মুনাফা লাফিয়ে বেড়েছে! অর্থনৈতিক চরম অসাম্যের মধ্যে কর্পোরেট শ্রেণীকে আরো সুবিধা পাইয়ে দিতে প্রচলিত শ্রম অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তাই নয়া শ্রম আইন প্রণয়ন হয়েছে। ১) শ্রমিকদের মজুরি কমানো, ২) খুবই কম অথবা বিনা মজুরিতে শ্রমসময় বাড়িয়ে নেওয়া এবং ৩) স্থায়ী শ্রমিকের বদলে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ। কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া শ্রম আইন সেই লক্ষ্যেই কাজ করেছে। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পাশ করেছে কোড অন ওয়েজেস। ২০২০ সালের বাদল অধিবেশনে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে আরও তিনটি শ্রম আইন – ক) দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন কোড, খ) দ্য অক্যুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশন্স কোড এবং গ) কোড অন সোশ্যাল সিকিউরিটি।               শিল্প মালিকদের স্বার্থে বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্য শ্রম আইনে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এনেছে ভারতের সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশ – তারা তিন বছরের জন্য সেখানে কার্যত সব শ্রম আইনই মুলতুবি করে দিয়েছে।ফলে সেখানে ইচ্ছেমতো শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে, এমন কী ন্যূনতম পারিশ্রমিক দিতেও মালিকরা বাধ্য থাকবেন না। বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট এবং নবীন পট্টনায়েকের উড়িষ্যা সরকার তাদের শ্রম আইনে পরিবর্তন এনে শিল্প মালিকদের নানা সুবিধে করে দিয়েছে।         

 পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার কংগ্রেস সহ বিরোধীদের, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের স্বার্থে, কেন্দ্রের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা যে কোনো আন্দোলন কে দমন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মঘটের অধিকার প্রায় কেড়ে নেওয়া হচ্ছে শ্রমদিবস নষ্ট হওয়ার যুক্তি দিয়ে। অথচ বিভিন্ন অছিলায় সরকারি ছুটি ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে, যা আগে কোন জমানায় হয়নি। এই রাজ্যে চা শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থা করুন। কাজের সন্ধানে হাজার হাজার শ্রমিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্য রাজ্যে যাচ্ছে। অনেক সময়েই বিপদে পড়ছেন। গরিব মহিলারাও ব্যতিক্রম নয়।
           

এই সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে জোট বেঁধে কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় লাগাতার আন্দোলন চলছে, যা ভবিষ্যতে আরো জোরদার করা প্রয়োজন।( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *