শাসক পাল্টে যায়। কিন্তু শাসনের রূপ বোধহয় একই থাকে।

মুকুল বসাকের বিশেষ প্রতিবেদনঃ

পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সিঁড়ি হিসাবে ধরা হয় সিঙ্গুর – নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণে অংশ নিতে অনিচ্ছুক কৃষকদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকে। সিঙ্গুরের টাটা কারখানা তৈরির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দীগ্রামেও একই ভাবে সালিম – সিপুত্রা গোষ্ঠীর জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ক্ষমতায় আসার দরজা খুলেছিলেন একদা ‘অগ্নিকন্যা’ মমতা বন্দোপাধ্যায়।

সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম – দুটি ঘটনাতেই অভিযোগ শোনা গিয়েছিলো শাসক দল সিপিএমের কিছু স্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে , যাঁরা জমির দালালি করার লোভে গায়ের জোরে গ্রামবাসী কৃষকদের থেকে স্বল্প মূল্যে জমি কেড়ে নিচ্ছিলেন।

অভিযোগের সত্যাসত্য প্রমাণ করতে করতে গেম – সেট – ম্যাচ মমতা ব্যানার্জীর। ক্ষমতায় তৃণমূল। সব অভিযোগ হিমঘরে। “তাহাদের কথা আর কেউ বলে না” … হারিয়ে গেছে সিঙ্গুর – নন্দীগ্রাম। না.. বোধহয় হারিয়ে যায় নি… রূপ পরিবর্তন করে আবার দেখা দিয়েছে। এবারে অভিযুক্ত তৃণমূল কংগ্রেস। এবং সেই দলের নেতা – বিধায়ক – জনপ্রতিনিধিরা। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু এবারে ফারাক্কার বেনিয়াগ্রামের দাদনটোলা। অভিযুক্ত সংস্থার নাম আদানী পাওয়ার। আবার গ্রামবাসীদের জমি জোর করে হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা থেকে আদানী সংস্থার বিদ্যুৎ যাবে বাংলাদেশে। অভিযোগ, ফারাক্কার NTPC এলাকার ৫০০ বিঘা জমি আদানী গোষ্ঠীকে দিয়ে দিয়েছে ভারত সরকার। শ্রীলংকার সাম্প্রতিক বিতর্কে আমরা দেখেছি যে নরেন্দ্র মোদী নিজে বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে চুক্তি করছেন আদানী সংস্থার বিদ্যুৎ সরবরাহ করবেন বলে। দুটি সার্বভৌম দেশের চুক্তির মধ্যে আদানী কি করে ঢুকছেন এবং নরেন্দ্র মোদী কার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছেন দেশের মানুষের স্বার্থ বাদ দিয়ে – সেই নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ভারত – বাংলাদেশ সরকারের মধ্যেও তেমন নাকি আদানি গোষ্ঠীর বিদ্যুৎ সরবরাহ করার চুক্তি হয়েছে। এবং সেটি এমন কিছু কৃষকের জমির উপর দিয়ে যাবে যে সেই জমির মালিককে সেভাবে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার। তৃণমূল সরকার এবং এলাকার তৃণমূল নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জমি দখল করার। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে জিলা পরিষদ হয়ে বিধানসভা – নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সামনে দাঁড়ায় সাধ্য কার ? অন্তত তেমনই ধারণা ছিল কেন্দ্রের মোদী সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের মমতা সরকারের। কিন্তু এলাকার আম ও লিচু চাষীদের নাছোড় মনোভাব জন্ম দিয়েছে আরেক “ভূমিরক্ষা আন্দোলন”-এর। গ্রামবাসীদের বক্তব্য হলো, “যেখানে আদানী গোষ্ঠীর বিদ্যুৎ টাওয়ার লাগানোর কথা ছিল সেখান দিয়ে না লাগিয়ে আম ও লিচু বাগান ও মানুষের আবাসনের উপর দিয়ে হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক। একটি লিচু গাছ প্রায় ২০০ বছর বাঁচে।

প্রতি বছর প্রতিটি গাছে যা লিচু হয়, তাতে বাৎসরিক আয় হয় ১৫,০০০ টাকা। আদানি গোষ্ঠী প্রতি বিঘা জমির দাম ঠিক করেছে ৩ লক্ষ টাকা। এটি যথেষ্ট নয় বলে কৃষকদের অভিযোগ। প্রতি বছর যে জমি ও লিচু গাছ থেকে ৩ লক্ষ টাকা রোজগার হয়, তার বাজারমূল্য ৩ লক্ষ টাকা হয় কি করে ? ভূমি অধিগ্রহণ আইন ২০১৩ মানা হচ্ছে না এই ক্ষেত্রে। “মালদা এবং মুর্শিদাবাদের ফারাক্কা সংলগ্ন এলাকায় মূল কৃষি উৎপাদন আম ও লিচুই। কয়েক লক্ষ মানুষের রোজগারের প্রধান ও একমাত্র উৎস এই চাষই। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের “গুজরাত মডেল”-টি এখানে বুঝতে হবে। কারণ ফারাক্কা এবং বীরভূমের মোহাম্মদবাজারের দেউচা – পাচামী কোনোভাবে এই জায়গায় এক হয়ে যাচ্ছে।

নরেন্দ্র মোদী সরকার মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার “Chaebol” মডেল অনুসরণ করে ভারতের সব সম্পদ আদানী ও আম্বানি এই দুটি গোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দিতে চাইছে। দক্ষিণ কোরিয়ার মিলিটারি শাসক পার্ক চুং হি যেমন পুরো দক্ষিণ কোরিয়ার সব সম্পদ লাগিয়ে দিয়েছিলেন স্যামসুং , হুন্ডেই , LG , Daewoo প্রভৃতি পরিবারভিত্তিক সংস্থাকে শক্তিশালী করতে, নরেন্দ্র মোদীর লক্ষ্য সেখানে আদানী ও আম্বানী দুই পারিবারিক গোষ্ঠীকে বিশ্বের প্রধান সংস্থা বানানো এবং এই দুই কোম্পানির ভবিষ্যতের সঙ্গে ভারতবাসীর ভবিষ্যৎকে জোড়া।

আদানী ও আম্বানী সংস্থার মুনাফা বাড়ানোই যেন দেশপ্রেমী হওয়ার একমাত্র লক্ষণ। আম্বানী ও আদানীকে “বিশ্বগুরু” বানানোর সঙ্গে সঙ্গে এবং ভারতের সব পরিকাঠামোর অধিকার এই দুটি “গুজরাতি সংস্থা”-র হাতে ছাড়ার পরে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি তাঁদের লভ্যাংশের ভাগ এই দুই সংস্থার থেকে বুঝে নেবেন। এটিকে ইংরেজিতে Plutocracy বলা হবে না oligarchy তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে।

কিন্তু ঘটনাটি হলো, নরেন্দ্র মোদীর “গুজরাত মডেল”-এর Design -টি বোধহয় এবারে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ফারাক্কার বেনিয়াগ্রাম এবং বীরভূমের দেউচা – পাচামী দুই জায়গার মানুষেরই অভিযোগ হলো, জমি অধিগ্রহণের মামলা আদালতের বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও আদানী গোষ্ঠী তাঁদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

এবং সেই কাজে পুলিশ – প্রশাসন এবং শাসক দল তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা সাহায্য করছেন। বিরাট পুলিশবাহিনী নামিয়ে গ্রামবাসীদের বাড়ি বাড়ি ঢুকে অত্যাচার চালানো হচ্ছে। এবং তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি জনগণের পক্ষে না থেকে আদানী গোষ্ঠীর সালিশি করছেন। ঠিক যে অভিযোগটি ১৫ বছর আগে সিঙ্গুর – নন্দীগ্রামে লক্ষণ শেঠের মতো কিছু সিপিএম নেতার বিরুদ্ধে উঠেছিল।দেউচা – পাচামীর কয়লা , ফারাক্কার জমি , সাগরের গভীর সমুদ্র বন্দর বানিয়ে আদানীর হাতে তুলে দেওয়া – নরেন্দ্র মোদীর “আদানী মডেল”-এর পূর্ণাঙ্গ চিত্র। গুজরাতেও ঠিক এই ভাবে প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার , দলিত – আদিবাসীদের জমি, সমুদ্র বন্দর আদানী গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। narcotics drugs ওই আদানীর গুজরাত বন্দর দিয়েই ভারতে ঢুকছে বলে অভিযোগ। এমনিতে দেউচা পাচামীতে পুরু ব্যাসল্টের স্তর ভেদ করে কয়লা উত্তোলন কতটা সম্ভব – এই নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু তাতে “জমি অধিগ্রহণ” এবং তৃণমূলের “জমি মাফিয়া”-দের হুমকি ধামকি থেমে থাকছে না। তৃণমূলের বীরভূমের জেলা সভাপতি এবং কয়লা – জমি – পাথর – গরু – বালি দুর্নীতিতে অভিযুক্ত অনুব্রত মন্ডলের স্পষ্ট হুমকি যে, জমি দখলে বাধা দিতে এলে তিনি “শুঁটিয়ে লাল” করে দেবেন। এতে নাকি বীরভূমে কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঘটনা হলো, Indian Express -এর করা সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী গুজরাতে অপ্রচলিত শক্তি শিল্পে গত ২০ বছরে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ১২০০০। যেখানে Vibrant Gujarat -এ প্রস্তাবিত কর্মসংস্থান ছিল ২০ লক্ষ !এই ধরনের শিল্পে জমিটাই যায়। বিকল্প কর্মসংস্থান হয় না।

গুজরাটের দলিত – আদিবাসীরা ভুক্তভোগী। প্রশ্ন হলো, “মমতা ব্যানার্জী সরকারের কি দায় পড়লো আদানী গোষ্ঠীর পক্ষ নিয়ে ফারাক্কার বেনিয়াগ্রামে বিক্ষোভরত জেলা পরিষদ সদস্য কংগ্রেসের আসিফ ইকবাল সহ গ্রামবাসীদের উপরে পুলিশ লেলিয়ে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধেই arrest warrant জারি করার ?”

মোদী – দিদির যে আঁতাতের অভিযোগ কংগ্রেস – বাম সহ বিরোধীরা তোলেন সেটির ঝলকই কি দেউচা – পাচামীর পরে বেনিয়াগ্রামে দেখা গেলো না ? নয়তো মমতা ব্যানার্জীর পুলিশ ও প্রশাসনের কি দায় পড়েছিল হাইকোর্টে গৃহীত মামলার শুনানির অপেক্ষা না করে একেবারে উর্দ্ধশ্বাসে আদানী গোষ্ঠীর কার্যনির্বাহী সদস্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ?উত্তরটি সব যুক্তিবাদী স্বাধীনতাচেতা মানুষকে খুঁজতে হবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *