ভারত ছাড়ো আন্দোলন-ব্রিটিশ সরকার ও শ্যামাপ্রসাদঃ

পার্থ মুখার্জী

১৯৪২ সালে পরাধীন ভারতের তৎকালীন বোম্বাই শহরের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে চলছে সর্ব ভারতীয় কংগ্রেস কমিটির অধিবেশন। এদিকে পুরোদমে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। অপর দিকে ক্রিপস্ মিশন ব্যার্থ। সেই আবহেই ১৯৪২ এর ৮ই আগস্ট গান্ধীজি তার ভাষনে ডাক দিলেন ভারত ছাড় আন্দোলনের, যার পোষাকি পরিচয় ক্যুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট। এই ভারত ছাড়ো আন্দলনের প্রেরনা মন্ত্র ছিল গান্ধীজিরই আহ্বান “করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে”। ৯ই আগস্ট আন্দোলনের শুরুর আগের দিনই কংগ্রেসের সব প্রথম সারির নেতারাই সরকারের দ্বারা বন্দি হলেন কিন্তু তবু আন্দোলন শুরু হলো নেতৃত্ব বিহীন অবস্থায় যার মুল উৎস ছিলো সাধারন মানুষের আবেগ। এদিকে অবিভক্ত বাংলায় তখন চলছে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সরকার যার সহযোগী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির হিন্দু মহাসভা এবং নেপথ্যে মহম্মদ আলি জিন্নার মুসলিম লীগ। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সলতে পাকানো থেকেই শ্যামাপ্রসাদ তার কর্ম পদ্ধতি ঠিক করে ফেলেন কেননা শ্যামাপ্রসাদ বুঝলেন যে এক প্রবল জন আন্দলন তাদের সাধের ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আছড়ে পড়তে চলেছে। শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন অত্যন্ত একরোখা মানুষ, যা সিদ্ধান্ত নিতেন তা পালন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকতেন। এটা ছিল তার এক চারিত্রিক গুন। সেই সময় শ্যামাপ্রসাদ বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন মন্ত্রী ছিলেন, ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহন ও কার্যকরের ক্ষেত্রে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা থাকতোই। শ্যামাপ্রসাদ স্থির করলেন নিজ কর্তব্যে তিনি অটল থাকবেন অর্থাৎ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কখনই সফল হতে দেওয়া যাবেনা। এক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএসের মতের মিল ছিল যেহেতু তাদের ঐক্যমত ছিল ইংরেজদের পরাজয় ও ভারতীয়দের স্বাধীনতা তাদের স্বার্থের পরিপন্থী। কর্তব্যে অবিচল শ্যামাপ্রসাদ ২৬শে জুলাই, ১৯৪২ এ একটি পত্র লিখলেন তৎকালীন বাংলার গভর্নর জেনারেল জন হার্বাটকে। নিজের সমস্ত আবেগ ও মনবাসনাকে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎ্পাতের রুপ দিয়ে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তার ও তার দলের দায়বদ্ধতার প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কঠোর হস্তে দমন করার অঙ্গীকার ঘোষনা করলেন। শ্যামাপ্রসাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখলো বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষ। সরকারের হাতে দমনমূলক যা শক্তি ছিল, তা একত্র করে তৎকালীন প্রশাসন ঝাঁপিয়ে পড়লো স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকারীদের ওপর। অকথ্য ও বল্গাহীন অত্যাচার এবং দমন-পীড়নের ফলস্বরূপ ও নেতৃত্বহীনতার কারনে ক্রমে ক্রমে ভারত ছাড়ো আন্দোলন স্তিমিত হলো। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে এই নাছোড়বান্দা জেহাদ এবং ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অকৃত্রিম সমর্থন শ্যামাপ্রসাদ ও হিন্দু মহাসভার মাথায় এক সাফল্যের মুকুট আর এই মুকুটের সবচেয়ে সুদৃশ্য ও গৌরবের পালক হলো সেই সময়ের গ্রাহ্য জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে উত্তোলন করতে গিয়ে মহিলা কংগ্রেস নেত্রী মাতঙ্গিনী হাজরার বুকে বন্দুকের গুলি এবং তার বুকের রক্তে লাল হয়ে যাওয়া পতাকা আর দেশের একাকার হয়ে যাওয়া মাটি। পরিসমাপ্তি হলো একটা ইতিহাসের কিন্তু গৌরবান্বিত হয়ে রইলো সেই ইতিহাসের একটা অধ্যায়, যার সাক্ষ্য বহন করছে আজও সেই ময়দান, যা আজ প্রসিদ্ধ অগস্ট ক্রান্তি ময়দান নামে।শ্যামাপ্রসাদ ও হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএসের বিরুদ্ধে একটা মিথ্যা অভিযোগ করা হয় তাদের নাকি স্বাধীনতা সংগ্রামে ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কোনো অংশগ্রহন ছিলনা। সত্য ঘটনা হলো অবশ্যই ছিলো, তবে তা ব্রিটিশদের পক্ষে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *