পার্থ মুখার্জিঃ
১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই ১৮৮৮ সালে তৎকালীন সংযুক্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের কাজকর্ম শুরু হয় কলকাতায় অনুষ্ঠিত অধিবেশনের মাধ্যমে, যার সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সেই সময়ের কর্মকাণ্ড জাতীয় কংগ্রেসের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত থাকলেও তা স্বতন্ত্র ভাবেই পরিচালিত হতো। ১৯২০ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অনুমোদন প্রাপ্ত হয় এবং সরাসরি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অঙ্গীভূত হয়। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হলেও অন্ততঃ কুড়ি বছর তা একটি বাৎসরিক সর্বভারতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠানের মধ্যেই তার রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম সীমাবদ্ধ থাকতো, যেখানে দেশের বিভিন্ন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা এবং প্রস্তাব পাশ করা হতো। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের রাজনৈতিক কর্মসূচিও সেই পথই অনুসরণ করতো।
এরপর অবিভক্ত বাংলার ইতিহাসে একটি ঘটনা শুধু এই বাংলারই রাজনৈতিক চিত্র বদলে দেয়নি, তার অনিবার্য অভিঘাতের প্রতিফলন ঘটে এই বাংলার সেই সব মানুষদের চিন্তায় এবং কর্মকান্ডে, যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত ছিলেন। সেই সুদূরপ্রসারী ঘটনাটি হলো তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জনের দ্বারা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ। অবিভক্ত বাংলার বাঙ্গালিরা এই বঙ্গভঙ্গ মেনে নেয়নি। শুরু হয় প্রতিবাদ, যা ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সমাজের বৃহত্তর অংশে। এই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় জাতীয় কংগ্রেসের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত এই বাংলার বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের মানুষরাও এতে অংশগ্রহণ করেন। শুধুমাত্র বাৎসরিক অধিবেশনের চার দেওয়ালের বাইরে এই প্রথম বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সদস্যদের আন্দোলনের ময়দানে দেখা গেল, যা এই আন্দোলনকে এক অন্য মাত্রার শক্তি ও গতি যোগালো। এই আন্দোলন চরম শিখরে পৌঁছয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে কেননা ইত্যবসরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদও গ্রহন করেছিলেন এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যাবলীতেও অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন।
এই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রসের সম্পর্কের সম্পৃক্তকরন ঘটে যখন ১৯০৮ সালে অবিভক্ত বাংলার পাবনায় আয়োজিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সদস্যদের ও আপামর মানুষের যুক্ত আন্দোলনের ফলস্বরূপ পরবর্তিকালে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধ হয়। এছাড়াই বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসী মনোভাবাপন্ন মানুষরা জাতীয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কংগ্রেসের হয়ে চার দেওয়ালের বাইরে রাস্তায় নেমে জনগনের সঙ্গে মিশে আন্দোলনের এক ভিন্ন পথের দিশা দেখিয়েছিলো।
তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার পাবনা জেলা শহরে ১৯০৮ সালের ১১-১৩ই ফেব্রুয়ারী শুরু হয় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম সভাপতিত্বের জন্য প্রস্তাব করেন এবং অরবিন্দ ঘোষ সেই প্রস্তাব সমর্থন করেন। যদিও সেই সম্মেলনে নরম ও চরমপন্থীদের স্পষ্ট বিভাজন হয়েছিলো, তবু দুই পক্ষই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম সর্বসম্মতিক্রমে মেনে নিয়েছিলেন। ১৯০৮ এর পাবনা প্রাদেশিক সম্মেলনের ব্যবস্থাপনা ছিলো বিশাল এবং সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ জাঁকজমক পূর্ণ। বিশাল সংখ্যক মহিলাসহ অন্তত ৫০০০ হাজার প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। এই বিপুল প্রতিনিধি সংখ্যাই পৃরমান করে সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের নিরিখে প্রাদেশিক কংগ্রেসের জনমানসে ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব ও সমর্থন।
শুধুমাত্র বঙ্গভঙ্গের কারনেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্ব করা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না, ১৯০৮ এর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশন সেই বছর আরও একটি কারনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, যার প্রেক্ষাপট রাজ্যের প্রেক্ষিত ছাড়িয়ে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক অভিঘাত সৃষ্টি করেছিলো এবং যার প্রভাব বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিসরেও প্রভাব ফেলেছিল পরবর্তীকালে তার সুদুরপ্রসারি রাজনৈতিক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ায়। এই ঘটনাটি ছিলো ১৯০৭ সালে সুরাটে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন, যেখানে রাজনৈতিক মত ও পথের দিশা নির্নয়ের সিদ্ধান্তঃ গ্রহনের পথে দলে ব্যাপক মনান্তর সৃষ্টি হয়, যা নরমপন্থী বনাম চরমপন্থীদের বিরোধ বলে পরিচিত। ১৯০৮ এর পাবনা রাজ্য সম্মেলন এই দৈত কারনে কংগ্রেসের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এই সার্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিতগুলির কারনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্ব এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছিলো।
এই প্রথম ১৯০৮ এর পাবনা সম্মেলনে কোনো সভাপতি প্রথমবার বাংলা ভাষায় তার ভাষন পাঠ করেন। এর পূর্বে ১৮৮৮ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত সভাপতির ভাষন ইংরেজিতেই দেওয়া হতো, রবীন্দ্রনাথ যার প্রথম ব্যাতিক্রম ঘটালেন। রবীন্দ্রনাথের সভাপতির অভিভাষনের মূল প্রতিপাদ্য ছিলো তৎকালীন বঙ্গীয় যুব সমাজ। রবীন্দ্রনাথ যুবসমাজকে বিশেষ ভাবে আহ্বান জানান সার্বিক গ্রাম উন্নয়নের কাজে বিশেষ ভাবে ব্রতী হওয়ার। সভাপতির ভাষনে রবীন্দ্রনাথ যুবসমাজকে একদম নিম্নস্তর এবং বৃহত্তর আঙ্গিক, উভয় ক্ষেত্রেই গ্রামীন পরিকাঠামো তৈরির আহ্বান জানান। এছড়াও রবীন্দ্রনাথ বাংলার হিন্দু ও মুসলমান, উভয় সমাজকেই একত্রে জীবিকা নির্ভর উদ্যোগ গ্রহনেরও আবেদন জানান। রবীন্দ্রনাথ তার ভাষনে বাংলার প্রতিটি গ্রামে কংগ্রেসের শাখা বিস্তারের লক্ষমাত্রা পুরনেরও সুপারিশ করেন এবং কয়েকটি গ্রাম নিয়ে এক একটি ইউনিট গঠনেট কথা বলেন, যাতে উন্নয়নের কর্মকান্ড সমাজের নিচুতলায় পৌঁছায়। সবিশেষ উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রনাথ চাষের জোতের আকার ছোটো হওয়ার কারনে কৃষির কাজে সমবায় গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
রবীন্দ্রনাথের বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবীর রাষ্ট্রীয় কংগ্রেসের ১৯৮৯ সালের অধিবেশনে প্রথম মহিলা ডেলিগেট হয়ে যোগ দেওয়ার পর ১৯০৮সালে পাবনার বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্ব বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস তথা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির সেই সময়ে আত্মিক সম্পর্কের এক উজ্জল পরিচয় বহন করে।
ছবিঃ সংগৃহীত
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
#tagore&congressidea