পার্থ মুখোপাধ্যায়ঃ
জাতীয় কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধী একটি টুইট করেছেন যেটি সাধারণ ভাবে অন্যান্য টুইটের থেকে বহুল চর্চিত হচ্ছে। আমরা প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার হালের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা জেনেছি এবং দেখেওছি আমাদের দেশের এবং আন্তর্জাতিক দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমগুলিতে। মানুষ পিলপিল করে রাস্তায় ছুটছে, জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের লোকদের তাড়া করছে, মন্ত্রীদের ওপর শারীরিক আক্রমণ করছে, এসব দৃশ্য সত্যিই ভয়াবহ ও মর্মান্তিক। এইসব ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতেই রাহুল গান্ধীর ট্যুইট, যার যোগসুত্র আমাদের দেশেরও সাম্প্রতিক কয়েক বছরের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। রাহুল গান্ধী প্রধানত তিনটি বিষয়কে নিয়ে তার ট্যুইটে ভারত এবং শ্রীলঙ্কার সামগ্রিক পরিস্থিতির তুলনা টেনেছেন। এই তিনটি বিষয় হলো ব্যাপক বেকারত্ব, পেট্রোপন্যের লাগাম ছাড়া মূল্যবৃদ্ধি এবং সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা। রাহুল গান্ধী ট্যুইটারে কয়েকটি গ্রাফিক্সের মাধ্যমে তার ব্যক্তব্যের সারমর্মতা বোঝাতে চেয়েছেন।
ভারতবর্ষে আজ শহর ও গ্রাম মিলিয়ে বেকারত্বের হার ৯ শতাংশের ওপর, যা গত ৪৮ বছরের মধ্যে সর্বাধিক রেকর্ড। অপরদিকে শ্রীলঙ্কার বেকারত্বের হার ২০২০ সালে ছিলো ৪.৮৪%, যা গত দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই হার কোভিড পরবর্তী সময়ে অবধারিত ভাবে বেড়েছে। এই পরিসংখ্যানের মধ্যেই কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য ভারতের পক্ষে এক বিপদের বার্তা বহন করছে কেননা ২০২০ সালে যখন শ্রীলঙ্কার বেকারত্বের হার ৪.৮৪%, তখন ঐ একই সময়ে ভারতের বেকারত্বের হার ছিলো ৬.১%। ফলে বেকারত্বের হারের নিরিখে ভারত শ্রীলঙ্কার থেকে যে ভালো অবস্থানে নেই, তা পরিস্কার এবং রাহুল গান্ধীর ট্যুইটে দুই দেশের বেকারত্বের হারের তুলনা টানা এই পরিপ্রেক্ষিতে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং তা যে অমুলক নয়, তারই ঈঙ্গিত করছে। শ্রীলঙ্কার এক বিরাট জনসংখ্যা যেমন দারিদ্র্যের কবলে পড়েছে, তেমনই ভারতেও অন্তত ৪ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ পুনরায় দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে গেছে।
পেট্রোপন্যের দামের ক্ষেত্রেও শ্রীলঙ্কার অবস্থা এতোটাই সঙ্গীন যে ডিজেল ভর্তি জাহাজ বন্দরে অপেক্ষা করছে, অথচ সেই ডিজেল কেনার মতো পর্যাপ্ত ডলার এই দেশটির নেই। বিদ্যুতের অভাবে দ্বীপরাষ্ট্রে প্রায়শই অন্ধকারে ডুবে থাকছে। অপরদিকে, ভারতেও আজ পেট্রোপন্যের দাম আকাশ ছোয়া। যে পেট্রোপন্য বাজার চালিত দামে বিক্রি হতে ২০১৪য়, সেই দাম আজ দেশের বাজেটের ব্যায় বরাদ্দের প্রয়োজনের ভিত্তিতে ধার্য হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় যেমন জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া, তেমনই ভারতের পাইকারি মূল্য সূচকও আজ ১৫% পেরিয়ে গেছে। ফলে যে অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে আজ শ্রীলঙ্কার মানুষ পতিত হয়েছে, আগামীতে সেই অর্থনৈতিক অবস্থার সন্ধিক্ষণের দিকেই কি আমাদের দেশ ধাবিত নয়, এই প্রশ্ন আজ অনুরণিত হচ্ছে।
আরও একটি জ্বলন্ত অবস্থার কথা রাহুল গান্ধী তার ট্যুইটে তুলে ধরেছেন। শ্রীলঙ্কার সমাজ জীবনে গত কয়েকটি দশকে বিভিন্ন জাতী গোাষ্ঠি পারস্পরিক লড়াই এবং জাতিদাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েছে। সিংহলী ও তামিলদের মধ্যর লড়াইতো পূর্ণ যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলো, যার প্রভাব দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থাকে ভঙ্গুর করে তুলেছিলো। এছাড়াও সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের দ্বারা সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমন দেশটির সামাজিক পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে তুলেছে। ভারতবর্ষের পরিস্থিতিও আলাদা নয়। বর্তমানে বিজেপি সরকারের আমলে দলিত ও সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের ওপর ক্ষমতাসীন দলের আক্রমণ নেমে এসেছে। ফলে আমাদের দেশেরও আর্থ সামাজিক পরিসর নানা বিশৃঙ্খলা ও দূর্যোগের স্বীকার হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। রাহুল গান্ধীর ট্যুইটের আসল লক্ষ কিন্তু বর্তমানে বিজেপি দল ও সরকারের উদ্দেশ্য, যা ক্রমেই প্রতীয়মান হচ্ছে। দেশে এখন হাজারো সমস্যা এবং ২০২৪ এর সাধারন নির্বাচন, ফলে বিজেপি কখনই চাইছেনা যে মানুষের দৈনন্দিন সমস্যাগুলি নাগরিক পরিসরে আলোচনায় আসুক এবং সেই কারনেই বিভিন্ন আঙ্গিকে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির অপপ্রয়াস অব্যহত রয়েছে। এটা আজ প্রশ্নাতীত যে বিজেপি দল ও সরকার উভয়েই মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে চাইছে, আর এই পরিপ্রেক্ষিতেই রাহুল গান্ধীর মন্তব্য যে মানুষের দৃষ্টির অভিমুখ পরিবর্তন করতে চাইলেও যা সত্য এবং যা ঘটছে, সেই সবের সত্যতা এবং তার অভিঘাত পরিবর্তন করা যায়না।