–শুভাশিস মজুমদার
১৯৯১ সালের ২১ শে মে মঙ্গলবারের সেই রাত এখনো স্মৃতিতে উজ্বল। একটু রাতের দিকেই দুঃসংবাদটি এলো, নতুন আধুনিক ভারত গড়ে তোলার স্রষ্টা, তরুণ প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখিয়ে উদ্দীপিত করার নায়ক শ্রী রাজীব গান্ধি আততায়ীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। খবর ছড়িয়ে পড়তেই, ঐ রাতেও ভারতের সব প্রান্তের মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। চোখে মুখে অবিশ্বাস ও শোক মিশ্রিত অভিব্যক্তি সবাইকার। কেউই মেনে নিতে পারছেন না এই দুঃসংবাদ। পরবর্তী নির্বাচনে জিতে আসাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। তত দিনে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদকারী ও কুৎসা রটনাকারীদের ভারতবাসী চিনে নিয়েছেন ভালো ভাবেই। তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ফলে ভারতের প্রগতি থমকে যায়, আর্থিক ক্ষেত্রে ভারত প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়ে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুর পরে ভারতের সর্বকালের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সদ্য মাতৃহারা শ্রী রাজীব গান্ধি যখন ক্ষমতায় আসেন স্বাভাবিক কারণেই সকলের সহানুভূতি ছিল তাঁর উপর । কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তিনি প্রমান করে দেন দেশের নেতা হিসেবে তাঁর পারদর্শিতা। তিনি আধুনিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। দেশের উন্নয়নে তাঁর অবদান কখনোই ভুলে যাওয়ার নয়। তিনি ১৯৮৬ সালে ভারত জুড়ে উচ্চ শিক্ষার কর্মসূচির আধুনিকরণ ও সম্প্রসারণের জন্য শিক্ষার বিষয়ে একটি জাতীয় নীতি ঘোষণা করেন। তিনি ১৯৮৬ সালে জওহর নবোদয় বিদ্যালয় ব্যবস্থা নামে একটি কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন, যার ফলে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে আবাসিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। তাঁর প্রচেষ্টার ফলে ১৯৮৬ সালে মহানগর টেলিফোন নিগম লিমিটেড (এম টি এন এল) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং গ্রামীণ অঞ্চলে টেলিফোন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পাবলিক কল অফিস (পিসিও) তৈরি হয়েছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশেষত কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তিতে তাঁর দুর্দান্ত অবদান আমাদের দেশে বিপ্লব ঘটিয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তি (ইনফরমেশন টেকনোলজি) র গোড়াপত্তন ও বিকাশ তাঁর হাত ধরেই হয়। তিনি ভোটের অধিকারের বয়স ১৮ হিসাবে প্রবর্তন করেছিলেন। ভারতে পঞ্চায়েতি রাজকে সক্রিয় করে তোলেন। তিনি যুবশক্তিকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছিলেন। ভারতে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি ভারতের নানা প্রান্তের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির সাথে একাধিক আলোচনা চালিয়েছিলেন, যার ফলে তারা হিংসার পথ ছাড়তে পেরেছিলেন এবং ভারতের সংবিধান এবং গণতন্ত্রকে মেনে নিয়ে ভারতের মূলধারায় যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ভারতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সাথে শান্তি চুক্তি সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন। পাঞ্জাবে লঙ্গোয়াল এর সাথে চুক্তি (২৪ জুলাই, ১৯৮৫), অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (এএএসইউ) এর সাথে আসাম চুক্তি (১৫ ই আগস্ট, ১৯৮৫), লালডেঙ্গার সাথে মিজোরাম চুক্তি (৩০ শে জুন, ১৯৮৬) এবং বিজয কুমার রংখালের সাথে ত্রিপুরা চুক্তি (সেপ্টেম্বর ১৯৮৮) স্বাক্ষর করে তিনি শান্তি নিশ্চিত করেছিলেন। তিনি নাগাল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলির সাথেও আলোচনা শুরু করেছিলেন, কিন্তু তাঁর অকাল প্রস্থানের জন্য তিনি এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে পারেননি। শ্রী রাজীব গান্ধির সময়কালেই, ২২ শে আগস্ট, ১৯৮৮, দার্জিলিঙে শান্তি স্থাপনে কেন্দ্রীয় সরকার, শ্রী জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও জি এন এল এফ নেতা শ্রী সুভাষ ঘিসিংয়ের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়। তিনি ১৯৮৮ সালে মালদ্বীপ প্রজাতন্ত্রের সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা একটি অভ্যুত্থান প্রতিহত করে সরকারের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এলটিটিই এবং শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘাত চলাকালীন, দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে এবং শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাতে রাষ্ট্রপতি জে আর.জয়বর্ধনের সাথে ইন্দো-শ্রীলঙ্কা শান্তি চুক্তি (২৯ শে জুলাই, ১৯৮৭) সম্পন্ন করেন। প্রতিবেশী সব দেশের সাথেই তিনি সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। দীর্ঘ জটিলতার পরে, ৮ ই ডিসেম্বর, ১৯৮৫ সালে, আট টি দেশ মিলে সার্ক (SAARC) তৈরি হয়, যাতে শ্রী রাজীব গান্ধির সক্রিয় বিশেষ ভূমিকা ছিল। তিনি সারা জীবন হিংসার বিরুদ্ধে কাজ করে ভারতবর্ষের অখন্ডতা রক্ষা, শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থাপনের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। তিনি একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক নতুন ভারত গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। পাশাপাশি গ্রামীণ ভারতের সম্পূর্ন বিকাশ ও সমৃদ্ধির প্রতি ছিল তাঁর প্রখর দৃষ্টি। তাঁর অসময়ে চলে যাওয়া ভারতবর্ষের কাছে এক অপূরণীয় ক্ষতি। শ্রী রাজীব গান্ধির অবদান কখনোই ভোলা যাবে না।Sent from RediffmailNG on Android