সৌম্যজিৎ রায়”
ভারত এক প্রাচীন দেশ, কিন্তু নবীন জাতি। সর্বত্রই তরুণরা যেমন হয়ে থাকে আমরাও তেমন অস্থির। যে ভারতের স্বপ্ন আমি দেখি সেই ভারত শক্তিমান, স্বাধীন ,স্বাবলম্বী। বিশ্বমানবের সেবায় সেই ভারত থাকবে সবার সামনের সারিতে। কঠোর পরিশ্রম এবং আমাদের সমবেত সংকল্পের মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ”।
রাজীব গান্ধী, এক প্রাচীন দেশ ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। ভাগ্যের ফেরে পাইলট থেকে পলিটিশিয়ান , পলিটিশিয়ান থেকে ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম ট্রাজিক হিরো হিসেবে প্রস্থান। তার পাঁচ বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বে ভারত দেখেছিল নিজের যৌবন, চরম পরিণতি পেয়েছিল ভারতের আধুনিকমনস্কতা। এদিকে তার স্বতঃস্ফূর্ত রঙ্গ পরিহাসে ঝানু সাংবাদিকরাও মোহিত হয়ে পড়তেন। এমন এক প্রাণোচ্ছল ভারতীয় যুবকের মৃত্যুদিন আজ। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুদিন আজ। প্রিয় পাঠক, চলুন একসঙ্গে তার কিছু রাজনৈতিক অবদানের স্মৃতিচারণা করি।
১৯৮২ সালে ভারতে খুব সফলভাবে এশিয়ান গেম অনুষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক মহল থেকেও যথেষ্ট প্রশংসিত হয় ভারত। কিন্তু এই সফলতার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল রাজীব গান্ধীর, তা হয়তো অনেকেই মনে রাখেনি। তার ২২ মাসের নিরলস পরিশ্রমে আন্তর্জাতিকমানের বেশ কয়েকটি স্টেডিয়াম এশিয়ান গেমস উপলক্ষে তৈরি হয়। কাজটি সহজ ছিল না,কিন্তু তাঁর দক্ষতা ও অধ্যবসায়ের জোরে সফল হয়। পরবর্তীতে তিনি বিবৃতিতে ক্যাবিনেট মন্ত্রী থেকে শ্রমিকসাধারণ সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। বলেন,”আমরা ভারতীয়রা যখন সত্যি কিছু করতে চাই তখন যে কি অধ্যবসায় করতে পারি বহির্বিশ্বের কাছে এশিয়ান গেমসই তার প্রমান”।
অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন তিনি।প্রধানমন্ত্রী হয়ে এসে ভারতের স্বাবলম্বতা ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে শক্তিশালী ভারত গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। মননে তৈরি করেছিলেন তার ব্লু-প্রিন্টও। আমেঠি থেকে নির্বাচিত হয়ে এসে সর্বপ্রথম আমি ঠিক সার্বিক উন্নয়নের দিকে নজর দেন। রাজনীতিকে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করার চেষ্টায় আনেন “anti-defection” ল। সঙ্গে ভোটাধিকারের বয়স ২১ বছর থেকে কমিয়ে ১৮ বছর করেন।শিক্ষার ব্যাপারে তার বিজ্ঞানসম্মত মনোভাবের উপর ভিত্তি করেই শিক্ষায় নবোদয় নীতির প্রণয়ন। ঔপনিবেশিক শিক্ষার রক্ষণশীলতা ভেঙে নবোদয় নীতিতে বৃত্তিশিক্ষার উপরে জোর দেওয়া হয়। তৈরি হয় নবোদয় বিদ্যালয়, পিছিয়ে পড়া সমাজের শিক্ষার্থীদের এ এক নতুন দিগন্ত। শান্তি প্রতিষ্ঠায় আসাম অ্যাকর্ড, মিজো অ্যাকর্ড, লঙ্গোয়ালের সাথে পাঞ্জাব অ্যাকোর্ড ছিল কয়েকটি সফল পদক্ষেপ। শান্তিচুক্তি সম্পাদন হয় দার্জিলিং, ত্রিপুরাতেও। দেশের উদ্দেশ্যে বার্তা দেন, “কে জিতল ,কে হারল, তাতে কিছু যায় আসেনা।জরুরী কথাটা হল এই যে গণতন্ত্রের প্রদীপটিকে নিভতে দেওয়া হয়নি।জরুরী কথাটা হল এই যে ভারত জয়ী হয়েছে।”
রাজীব যেন ভারতের আধুনিকরণের এক মূর্ত প্রতীক। তিনি চেয়েছিলেন এই আধুনিকতাকে ভারতের তৃণমূল স্তর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। আর তৃণমূলস্তরে সুশাসন ও সুযোগ-সুবিধা পৌঁছাতে গান্ধীজীর গ্রাম স্বরাজের মূর্ত রূপ “পঞ্চায়েতরাজ”কে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দেন। এক কথায় বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। আধুনিকতার উপর বল দিতেই ভারতে ঘটিয়ে ফেলেন টেলিকমিউনিকেশন বিপ্লব, কম্পিউটার বিপ্লব। ভারতের ভবিষ্যতের গতিপথ পাল্টে দেয় এই দুটি ঘটনা। তৈরী হয় বিএসএনএল, এমটিএনএল এর মত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা।
বিশ্ব রাজনীতিতে রাজীব ছিলেন গান্ধীপন্থী। “বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সহমর্মী অবস্থানের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের লালন”-এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।”প্যালেস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে ,দক্ষিণ আফ্রিকার স্থানীয় মানুষরা বর্ণবিদ্বেষের শিকার হচ্ছে ,তাদের বিরুদ্ধে চলছে আক্রমণ,লাতিন আমেরিকা সরকারগুলোকে অচল করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে এবং দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চলছে সশস্ত্র সংঘর্ষ” চিন্তা প্রকাশ করে তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গান্ধীবাদী আন্তর্জাতিকতাবাদের ধারণার দিকটি সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পরমাণু যুদ্ধ পরিহার, বর্ণ বিরুদ্ধে লড়াই ছিল তাঁর অন্যতম লক্ষ্য যার কথা তিনি নাসাউতে কমনওয়েলথ রাষ্ট্রসমবায়ের শীর্ষ সম্মেলনে উল্লেখ করেন।বিশ্বে পরমাণু অস্ত্র বর্জনের লক্ষ্যে গঠিত”ফাইভ কন্টিনেন্ট ইনিশিয়েটিভ” ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধী হাতে “বেয়ন্ড ওয়ার” অ্যাওয়ার্ড তুলে দেন।জাতিবিদ্বেষ এর বিরুদ্ধে একজন রাষ্ট্রনেতা হিসেবে রাজীব গান্ধীর অবদান স্মরণীয়। তার উদ্যোগেই ১৯৮৬ সালে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের রজত-জয়ন্তী উপলক্ষে হারারেতে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে “আফ্রিকা তহবিল” গড়া হয়।
মানবিকতার পাশাপাশি ন্যায়ের পক্ষে তার শক্তিশালী বিদেশনীতির দিকগুলি নিয়ে বর্তমানে তেমন আলোচনা হয় না। তার শক্তিশালী বিদেশনীতি প্রসঙ্গে “অপারেশন ক্যাকটাস” এর কথা মাথায় আসে।১৯৮৮ সালে, আব্দুল্লাহ্ লুতাফির নেতৃত্বে মালদ্বীপের সরকারকে সশস্ত্র ক্যু এর মাধ্যমে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। মালদ্বীপের রাজধানী মালে ঘিরে ফেলে লুতাফির ভাড়া করা সন্ত্রাসবাদিরা। আক্রমণকালে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি আব্দুল গাইওম কোনরকম নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে পালাতে সফল হন। সাহায্যের জন্য বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একমাত্র ভারতই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। রাজীব গান্ধীর নির্দেশে ভারতীয় প্যারাট্রুপার মালদ্বীপে পাঠানো হয়। অপারেশনের নাম দেওয়া হয় “অপারেশন ক্যাকটাস”। ভারতীয় সেনাবাহিনী অপরিসীম বীরত্বে এই অপারেশন সাফল্য লাভ করে। মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতিকে খুব সফল ভাবে উদ্ধার করতে সমর্থ হয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারতের হস্তক্ষেপে মালদ্বীপ এক অবৈধ ক্যু থেকে রক্ষা পায়। সমগ্র পৃথিবীর কাছে ভারত প্রশংসিত হয়। এছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে গ্রেট ব্রিটেন এর উপর তার প্রবল চাপ সৃষ্টি তার ন্যায়পূর্ণ,শক্তিশালী বিদেশনীতির দিককে তুলে ধরে।
এছাড়াও ভারতীয় অর্থনীতিতে রাজীব গান্ধী নতুন দিশায় ভারতকে পরিচালিত করে।রাজীব গান্ধীই প্রথম লাল ফিতের বাধন কেটে বাজারকে মুক্ত করার পদক্ষেপ নেন।ভারত প্রবেশ করে অর্থনৈতিক দ্রুত সমৃদ্ধির এক নতুন যুগে।
আজ তার মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপনের পাশাপাশি রাজনৈতিক মূল্যবোধের দিক স্মরণ করতে হবে। পাঁচ বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বে একটা মানুষ এত বড় একটি গণতান্ত্রিক দেশের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়ে চলে গেলেন, ভারতকে স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা দিয়ে গেলেন — এ তো নিজেই এক নিঃশব্দে ঘটে যাওয়া ক্রান্তি, যে ভারতবাসীদের জীবন সবচেয়ে বেশি মাত্রায় উন্নত করেছে। এই ক্রান্তির বিপ্লবী রাজীব গান্ধীর নাম ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে