ঋজুরেখ চক্রবর্তী:
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এই নিবন্ধের শিরোনামটি কারুর কারুর মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে এর উদ্দেশ্য বিষয়ে, কেননা শিরোনামটি ভুল প্রত্যাশা জন্ম দিতে পারে এই ভেবে যে রবীন্দ্রনাথের কোনও এতদনাবিষ্কৃত দিক বুঝি আলোচিত হবে এখানে, আর তার ফলে বিস্ময়েরও উদ্রেক করতে পারে এই মর্মে যে আজ রবীন্দ্রনাথের এই একশো-একষট্টিতম জন্মবার্ষিকীতে পৌঁছেও এমন কোন দিকটা থাকতে পারে তাঁর যা এতদনাবিষ্কৃত ও তাই এতদনালোচিত! এই বিস্ময়, যদি ইতোমধ্যেই তা জেগে থাকে কারুর মনে, সঙ্গত; এবং আমি মেনে নিতে বাধ্য যে এই নিবন্ধের ঠিকঠাক শিরোনাম হতে পারত ‘চেনা হয়েও অচেনা রবীন্দ্রনাথ’ বা ‘চেনা রবীন্দ্রনাথ: অচেনা রবীন্দ্রনাথ’ গোছের কিছু, কিংবা হতে পারত ‘রবীন্দ্রনাথ: ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিকতাবাদী’।
নিবন্ধটিকে একটি বিপুলায়তন গবেষণামূলক প্রবন্ধের কি আরও একটু টেনেটুনে বড় করে আস্ত একটা গবেষণাগ্রন্থেরও আকার এবং প্রকার আমি, চাইলে, দিতে পারতাম। রচনাটিকে করে ফেলতে পারতাম উপমালঙ্কারের অকৃপণ প্রয়োগে যুক্তিজালের বিস্তারকে দিগন্তবিস্তৃত করে তুলতে চিরদক্ষ রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন প্রবন্ধ ও বক্তৃতা ও চিঠিপত্র থেকে দেওয়া উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতিতে এমনই ভারাক্রান্ত যে পড়তে পড়তে, কেউ যদি সত্যিই ধৈর্য ধরে পড়তেন, পাঠকের মনে সংশয় জাগা সম্ভব ছিল এটি আদতে কোনও মৌলিক রচনা, না কি নেহাতই এক উদ্ধৃতি-সংকলন।
কিন্তু আমি তা করব যে না, করছি যে না, তা দ্বিবিধ কারণে। প্রথমত, রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে উদ্ধৃতিযোগ্য অংশ বেছে বের করা, বা বলা ভালো, উদ্ধৃতির অযোগ্য অংশ বেছে বাদ দেওয়া এক অমানুষিক কাজ; তিনি এমনই একজন যাঁকে বাদ দিতে হলে সম্পূর্ণ বাদ দিতে হয়, আবার নিতে হলে সম্পূর্ণ নিতে হয়। আর দ্বিতীয়ত, এবং মুখ্যত, একজন উৎকৃষ্ট উদ্ধৃতি-সংকলকের সহায়তায় ও সম্পাদনায় মাধ্যমনির্ভর খণ্ডিত পরিচয় নয়, স্বয়ংবাহিত সম্পূর্ণ অখণ্ড পরিচয়ই রবীন্দ্রনাথ দাবি করেন, বিশেষত আজ এবং অধিকতর বিশেষত এই বিষয়ে, এই জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতার প্রশ্নে।
আন্তর্জাতিকতা নিয়ে সারা বিশ্বের মতোই ভারতবর্ষেও সবচেয়ে বেশি মাথা ঘামিয়েছে কমিউনিস্টরা। তাদের একটি অতীব প্রিয় শব্দ: বিশ্ববীক্ষা। এই বিশ্ববীক্ষারই ফেরে পড়ে তারা তাদের অবিভক্ত অবস্থা থেকে শুরু করে কালক্রমে অসংখ্য শাখাপ্রশাখা সমেত বর্তমান অবস্থায় আজ অবধি ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’, অর্থাৎ, কমিউনিস্ট পার্টি নামক বৈশ্বিক ধারণার ভারতীয় অংশ হয়েই থেকে গেছে, মনেপ্রাণে ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’ আর কিছুতেই হয়ে উঠতে পারেনি, যার ফলে সেই কবেই, আজ থেকে ঠিক সত্তর বছর আগে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর ডায়েরিতে আক্ষেপ করে যেতে হয়েছে CPI does not understand the mind of India, হুবহু এই ইংরেজিতেই, লিখে রেখে। আমি এবিষয়ে শুধু এটুকুই সংযোজন করতে চাইব, ভারতের মন যে তারা চিনে উঠতে পারেনি তার অন্যতম কারণ হল, যে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা নিয়ে আদি থেকে অদ্যাবধি তাদের বহুবার জেরবার হতে হয়েছে ও হচ্ছে, পড়তে হয়েছে হাজারো প্রশ্ন ও সমালোচনার মুখে, তাদের সেই তাত্ত্বিক ভুবনে তারা রবীন্দ্রনাথকে ঠাঁই দেয়নি কখনও, অন্তত যথাযথভাবে তো দেয়ইনি, অথচ এবিষয়ে রবীন্দ্রনাথই হতে পারতেন তাদের তাত্ত্বিক পথপ্রদর্শক। ভারতবর্ষে শুধু নয়, সম্ভবত সমগ্র প্রাচ্যেই আন্তর্জাতিকতাবাদের আদি প্রবক্তা রবীন্দ্রনাথকে চিনতেই তারা পারেনি, অন্তত পার্টিগতভাবে, আর তার ফলে চিনতে পারেনি ভারতীয় জাতীয়তাকেও, চিনতে পারেনি ভারতীয় মনকে, চিনতে পারেনি ভারতবর্ষকে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে, এবং ভারতবর্ষকেও, চেনার দায় বা দায়িত্ব একা কমিউনিস্টদের, তা তো নয়! কমিউনিস্টদের বাইরে, অন্তত কমিউনিস্টদের পার্টিগত চৌহদ্দির বাইরে তো বটেই, যে বিপুল ভারতীয় মন, যে বিশাল জাতীয়তাবাদী ভারত যা দেশপ্রেম ও রাষ্ট্রপ্রেম একাকার করে ফেলেনি, অন্তত একাকার করে ফেলতে চায়নি, দেশরক্ষার একমাত্র অর্থ যুদ্ধং শরণং গচ্ছামি বলে ভাবেনি, অন্তত ভাবতে চায়নি, তারা কি রবীন্দ্রনাথকে চিনেছে যথাযথভাবে?
আন্তর্জাতিকতার ধারণা বাদ দিয়ে জাতীয়তার ধারণাও যে খণ্ডিত থেকে যায়, আন্তর্জাতিকতার বোধ ব্যতীত জাতীয়তার বোধও যে অসম্পূর্ণ থেকে যায়, আন্তর্জাতিকতাবাদের পাথেয় ছাড়া জাতীয়তাবাদের পথ অনুসরণ করা যে প্রকৃত প্রস্তাবে অসম্ভব, এই শিক্ষা তো রবীন্দ্রনাথই দিয়ে গেছেন আমাদের।
এই রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনেছি কি সার্থকভাবে? উত্তরটা, সম্ভবত, অনেকদূর পর্যন্ত, না। আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী থেকে এই অচেনা রবীন্দ্রনাথকে যদি আমরা চিনতে শুরু করি, তবেই আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে। আর তা না হলে? যাদের খোদ অস্তিত্বটাই রবীন্দ্রনাথের প্রণীত ও ফলিত জীবনাদর্শের মূর্ত বিরোধিতাতুল্য, তারা স্রেফ ক্ষমতার জোরে প্রতিটি ভাষণে কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা থেকে ঠিক বা ভুল উদ্ধৃতি দিয়ে যাবে আর আমরা বসে বসে শুনব, উদ্ধৃতি ভুল হলে সাধ্যমতো প্রতিবাদ করব, এই হবে আমাদের নিয়তি, এটুকুই থাকবে আমাদের হাতে পেন্সিলের মাপের রবীন্দ্রনাথ। আমরা কি চাইব তা?
অলংকরণ–মুকুল বসাক
#tegore&congressidea