পার্থ মুখোপাধ্যায়
সঙ্ঘ পরিবারের সামাজিক, রাজনৈতিক আগ্রাসন ক্রমশই সাঁড়াশির মতো চেপে বসছে ভারতবর্ষের বহুমাত্রিক ও বহুত্ববাদী দর্শনভিত্তিক মূল কাঠামোর উপর। রাজনৈতিক ক্ষেত্র ছাড়াও আর্থ সামাজিক পরিসরের প্রতিটি আঙ্গিকেই সঙ্ঘীয় চেতনা ও চিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটছে বা ঘটানো হচ্ছে। ভারতবর্ষের যে সকল ক্ষেত্রে তার এই বহুমাত্রিক চিন্তনের প্রকাশ প্রকট, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভারতীয় সেনাবাহিনীর, বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনী। ভারতবর্ষের ঐক্যের মূল শক্তি তার বিভিন্নতায় এবং পরিচয় তার গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যার প্রধান উপজীব্য হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও তার ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য বন্দিত হয়ে এসেছে। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও কিএই মূহুর্তে সঙ্ঘীয় চেতনার দ্বারা আক্রান্ত?
চলতি বছরের এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্যুইটার হ্যান্ডেলে একটি ছবি ট্যুইট করা হয় যা ছিলো জম্মু ও কাশ্মীরের ডোডা জেলার একটি ইফতার অনুষ্ঠানের, যা সেনাবাহিনীর উদ্যোগেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। হ্যাশট্যাগ “রামাদান” দিয়ে “পিআরও ডিফেন্স জম্মু” এই হ্যান্ডেলের ট্যুইটে বলা হয় ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্যকে বজায় রাখতে সেনাবাহিনী ডোডা জেলার আরনোরাতে ইফতারের আয়োজন করেছিলো। এই ট্যুইটটি দেঝার পর সঙ্ঘীয় চেতনায় জারিত সুদর্শন টিভির এডিটর-ইন-চিফ সুরেশ চাভাঙ্কে একটি ট্যুইট করেন। সুরেশ চাভাঙ্কে লেখেন এটা খুবই দুঃখের ব্যাপার যে এই রোগ এখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যের ঢুকে গেছে। তার এই ট্যুইটের মন্তব্যের পরেই পরিচিত ঢংয়ে আরও বেশ কয়েকটি ট্যুইট বিভিন্ন জনের করেন সুরেশের ব্যক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই ঘটনাক্রমের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই সেনাবাহিনী তাদের ইফতার নিয়ে ট্যুইটটি মুছে দেয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন বেশ কজন প্রাক্তন পদস্থ সেনা ব্যক্তিত্বরা। সেনাবাহিনীর সুত্রেই বলা হয়েছে এমন ইফতার আয়োজন তারা অনেক আগে থেকেই করে এসেছে এবং এই নিয়ে কোনোদিন কোনো আপত্তি কেউ করেনি। সেনা সুত্রে এটাও বলা হচ্ছে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের সঙ্গে সৌহার্দ্যের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যই এই আয়োজন করা হয়।
সঙ্ঘীয় চেতনায় যারা উদ্বুদ্ধ, তার আপত্তি জানাতেই পারে কিন্তু প্রশ্ন হলো সেনাবাহিনী কেন এমন অযৌক্তিক মনোভাবকে প্রশ্রয় দেবে। এসব কথার উৎস হলো যেহেতু সেনাবাহিনীর সব কাজই প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীন, যা এখন সঙ্ঘপরিবারের রাজনৈতিক ধারা বিজেপির করায়ত্ত।
ভারতবর্ষের সেনাবাহিনী ভারতীয়দের অত্যন্ত গর্বের। ভারতবর্ষের সংবিধান যদি তার অবকাঠামো হয়, তাহলে তার প্রতিরক্ষাবাহিনী এক অন্যতম পরিকাঠামোর ভুমিকা পালন করে। আমাদের জাতীয় সংহতির এক অনন্য পরাকাষ্ঠা হিসেবে প্রতিরক্ষাবাহিনীর উপস্থিতি, যার অন্যতম মুখবন্ধ হলো ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সেই কারনেই বহুদিনের প্রথা হিসেবে সর্বধর্মের অনুষঙ্গ পালনের রীতিকেই আক্রমণ করা হয়েছে ইফতারের বাহানায়। বহু প্রাক্তন সেনা আধিকারিকদের মতো বহু সাধারন মানুষেরও প্রশ্ন প্রতিরক্ষাবাহিনী এই সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় বিভেদের বেড়াজাল ছিন্ন করে তার প্রবহমান ধারাকে বজায় রাখতে কেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক প্রভাবের প্রতিক্রিয়া এবং সম্ভাব্য রোষানল এড়াবার কারনে ট্যুইটটি মুছে ফেলার সহজ সহাবস্থানের পথে গেল।