সরকারের বর্ষপূর্তি কিন্তু ভরসা কই?

চন্দন ঘোষ চৌধুরী:

গত ৫ই এপ্রিল, ২০২২, কলকাতার নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতায় বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার নানা বর্ণনা শুনে মনে হলো এত মানুষ, সংবাদমাধ্যম ও অগণিত টিভি দর্শকদের সামনে সাবলীল সত্যের অপলাপ এক শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

রাজ্যের কর্ণধারের স্ববিরোধী মতামত সম্পর্কে রাজ্যের মানুষ সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। কিন্তু রাজনৈতিক বা সমাজনৈতিক মিথ্যাভাষণকে একটা সাময়িক বর্ণনা করা যায়, অর্থনৈতিক মিথ্যাকে নয়। কারণ, পরিসংখ্যানগত বিচারে মিথ্যা কে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাই নেই।

দ্বিতীয় কারণ , বাস্তব উপলব্ধি বা Feel index যা সাধারণ মানুষ নিজের প্রাত্যহিক জীবনে উপলব্ধি করতে পারেন এবং করছেনও।

কয়েকটি তথ্যকে সামনে আনা যাক এখানে।

একটি রাজ্যের অর্থ ব্যবস্থা বোঝার সহজ উপায় রাজ্যের প্রথমত GSDP , আর্থিক ঘাটতি বা fiscal deficit, রাজস্ব ঘাটতি বা Revenue Deficit, পরিকল্পনা ও ব্যয় বরাদ্দ ও সামগ্রিক সামাজিক প্রকল্প শিক্ষা- স্বাস্থ্য সহ।

দ্বিতীয় অধ্যায় , শিল্প নীতি, শিল্প সম্ভাবনা ও প্রাক- শিল্প ব্যবস্থ্যার উন্নয়ন বা Industrial Development Infrastructure.

তৃতীয় অধ্যায় , বেকারত্ব দূরীকরণ ও ব্যবসায়িক পরিধির বিস্তার ।

এসবই synchronized action বা সংঘবদ্ধ ক্রিয়া।

মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এই স্বাভাবিক প্রশ্নের উত্তর কখনো দেন না। সামাজিক বন্টনের নামে সরাসরি ভোট রাজনীতির ক্রেতার বা Dole politicsএর ভুমিকায় থাকে সরকার। শুরু হয় Dark Art Management , সর্বস্তরে অর্থ ব্যবহার করে দুর্নীতির ব্যবস্থাকে ছড়িয়ে দেওয়া। প্রশাসন ও দলকে একসূত্রে বেঁধে দেওয়া। গণতন্ত্রের সীমানা ছাড়িয়ে বিরোধী শূন্য করবার চেষ্টা করা , যাতে মানুষ ভয়ের আবর্তে জড়িয়ে পড়ে, প্রতিবাদের ভাষা না পায়। বিরোধী সমর্থন লুঠ হয়।

এ সবই Dark Art Management এর সংজ্ঞা। বাংলার মানুষের Feel index এ যা প্রতি মুহুর্তে অনুভূত।

GSDP এই সময়ে ১৫.৩৬ লক্ষ কোটি টাকা যার মধ্যে ৩৪.২৩% দেনাভার যার পরিমাণ ৫.৮৬ লক্ষ কোটির টাকার কিছু বেশী। বাজেট ঘাটতি শুধুমাত্র এই আর্থিক বছরে ৬২,৩৯৭ কোটি টাকা। রাজস্ব আয় ১.৯৮ লক্ষ কোটি টাকা , ব্যয় ২.৬১ লক্ষ কোটি টাকা। ১/৩ অংশে র বেশী শুধু ঋণের বোঝা রাজ্যের মানুষের উপর।

GSDP র ২৩% আসে কৃষি ক্ষেত্র থেকে, ২০% শিল্প ও ৫৭% পরিষেবা থেকে। মনে রাখতে হবে , ২০২১ শের নিরিখে দারিদ্র্য সীমার নীচে বাংলার মানুষের সংখ্যা ১৯.৯৮%

এক্ষেত্রে আমার একটি পূর্বতন লেখার উল্লেখ করবার প্রয়োজন আছে, সংক্ষেপিত এই বছরের বাজেট বিশ্লেষণ।

পশ্চিম বঙ্গ বাজেট ২০২২:

১. সামগ্রিক ভাবে বাজেট বরাদ্দ কম। ৩,২১,০৩০ কোটি টাকা বাজেট এ রাজস্ব ঘাটতি ২৮, ২৮০ কোটি। রাজকোষ ঘাটতি ৬২,৩৯৮ কোটি ।

২. ঋণের পরিমাণ ৫, ৮৬,৪৩৯ কোটি টাকা। শোধ করতে হয় ৬৯,৫১২ কোটি বছরে। এর পরও আগামী বছর ধার নিতে হবে ৭৩,২৮৬ কোটি টাকা।

৩. বরাদ্দ কমেছে খাদ্য ও সরবরাহ ৩০০০ কোটি , ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মাত্র ১৬ কোটি।পূর্ত দফতরের বরাদ্দ ৩৪ কোটি।

৪. পরিকাঠামো উন্নয়নের কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। সুতরাং শিল্প উন্নয়নের কোনও সম্ভাবনার দিশা নেই।

৫. স্বাস্থ্য সাথী ও লক্ষী ভান্ডারের বরাদ্দ জনমহিনী প্রতিশ্রুতি বাজেট বহির্ভুত ঘোষণা। এই বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ নেই। তাই আয় ও ব্যায় এর ঘাটতি ২,৯১০০০ কোটি টাকা।

৬. GSDP প্রস্তাবিত বৃদ্ধি ১১.৫ % যা বর্তমান ৮% বৃদ্ধির তুলনায় এক অলীক কল্পনা।

৭. সমগ্র ব্যায় বরাদ্দ ১৮% বৃদ্ধি কিন্তু এই অবস্থায় সমগ্র আয় ১৯% নীচে। সামগ্রিক আয় না বাড়লে এই হিসাব প্রায় ৩৩,৭৬৮ কোটি টাকা বর্তমান হিসাবে।

৮. রাজস্ব ঘাটতি ২.৫৪ % , বর্তমান হিসাবে৩৪,৩৪৫ কোটি টাকা।

৯. আর্থিক ঘাটতি ৩.৮৬% । প্রায় ৫৩০০০ কোটি টাকা।

বেকারত্ব ৬.৯% এই মার্চ, ২০২২ এ , প্রায় ৩৩% , অস্থায়ী চাকরি। Employment Exchange এর ভূমিকা নগন্য। ২ লক্ষের উপর সরকারী পদ শূন্য। ১ লক্ষ শিক্ষকের পদ নিয়োগহীন।

দুর্নীতির শিখরে এই সরকার।

অনেক ‘বন্ধু’ ও ‘সাথী’ প্রকল্প করে দান-খয়রাত করছেন, সিন্ডিকেট ও তলাবাজি শিল্পের স্তরে নিয়ে গেছেন আর বাংলাকে কর্মবিমুখ করে তুলছেন। আগামী প্রজন্মকে কর্মহীন, দিশাহীন করে তুলছেন মুখ্যমন্ত্রী।

প্রখ্যাত লেখক প্রয়াত রমাপদ চৌধুরীর” ভারতবর্ষ”। গল্পের কাহিনী এইরকম – দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের শেষ দিকে আমেরিকান সৈন্যরা আস্তানা গড়েন একটি আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল মাহাতোগাঁও-এ (নাম উল্লেখ নেই, তবে বর্ণনায় সাঁওতাল পরগনা মনে হয়) । ছোট একটি হল্ট স্টেশন তৈরী হয়। রেলগাড়ি থামে। প্রচুর খাদ্য ও সামগ্রী আসে নিত্যদিন।

সেই খাদ্যের উচ্ছিষ্ট বিতরণ শুরু হয় আদিবাসীদের মধ্যে। এক এক করে সেই খাবারের লক্ষ্যে অঞ্চলের মানুষ জড়ো হতে থাকেন কাজ ফেলে।

ক্রমে যুদ্ধ শেষ হয়। সৈন্যরা ফিরে যায় দেশে। হল্ট স্টেশনে আর রেলগাড়ি থামে না। কর্ম বিমুখ মানুষগুলো ভিখারি হতে শুরু করে।

‘Dole politics’ টাই সেই বিতরণ রাজনীতি। যাকে উল্লেখ করেছি কালো শৈল্পিক ব্যবস্থা বা ‘Dark Art Management’।

সরকারের বর্ষপূর্তি উদযাপন হচ্ছে ঘটা করে, কিন্তু মানুষের ভরসা কি আছে?

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *