গুলবার্গ সোসাইটির হত্যাকান্ডে দোষীদের শাস্তি চেয়ে যাঁরা সুপ্রিম কোর্টের কাছে বিচার চাইলেন তাঁদেরই কোর্টের তীব্র ভর্ৎসনা: গ্রেপ্তার হলেন তিস্তা শেতলবাদ

সুশান্ত দাশগুপ্ত :

সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতি এ এস খানউইলকর , দিনেশ মাহেশ্বরী এবং সি টি রবিকুমারকে নিয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ গত ২৪ জুন আহমেদাবাদের গুলবর্গা সোসাইটি হত্যা মামলা সম্পর্কে রায় দিয়েছেন। ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এক বিশাল দাঙ্গাবাজ জনতা ওই হাউসিং সোসাইটি আক্রমণ করে। ওখানে বাস করতেন কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন এম.পি এহসান জাফরি। ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে তিনি প্রশাসনের সমস্ত স্তরে বারবার আকুল আবেদন করেও কোনও পুলিশ প্রটেকশনের ব্যবস্থা করতে পারেন নি। অবশেষে ওই দাঙ্গাবাজ জনতার হাতে ওই হাউসিং সোসাইটিতে ৬১ জন নিহত হন। এহসান জাফরির হাত পা কেটে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। হাউসিং সোসাইটিটি অগ্নিদগ্ধ হয়ে আজও পরে আছে।উপদ্রুত এলাকা ঘোষণা করে দিয়ে ওই নিম্ন মধ্যবিত্ত মালিকদের ওখানে ফিরে যাবার রাস্তা বন্ধ। নিহত এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া জাফরি বিচার চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন। সেই মামলাই সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছয়। সুপ্রিম কোর্ট ২০০৮ সালে একটি স্পেশাল ইনভেস্টিগেটিং টিম ( সিট ) গঠন করে দেয়।

সিট, নরেন্দ্র মোদি ও গুজরাত প্রশাসনকে নির্দোষ ঘোষণা করলে তার বিরুদ্ধেও জাকিয়া জাফরি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। তাঁকে সহায়তা করেন তিস্তা শেতলবাদ ও তাঁর সংগঠন সিটিজেন ফর জাস্টিস এন্ড পিস ( সিজেপি )। সুপ্রিম কোর্টের উপরোক্ত বেঞ্চ ওই আবেদন ভিত্তিহীন বলে নাকচ করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে আদালত তিস্তার ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছে এই আইনি লড়াইয়ে জাকিয়া জাফরিকে সহায়তা করার জন্য। তারা বলেছেন “জাকিয়া পরিস্থিতির শিকার ।আর এই আবেগকে কাজে লাগিয়েছেন তিস্তা “। জাকিয়া জাফরির আবেগকে কাজে লাগিয়ে তিস্তার কী লাভ সে সম্পর্কে অবশ্য এই বেঞ্চ কোনও ব্যাখ্যা দেননি। তাঁদের মতে এই মামলায় আবেদন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। একই সঙ্গে বিচারপতিরা গুজরাত পুলিশের দুজন প্রাক্তন আইপিএস অফিসার আর.বি.শ্রীকুমার ও সঞ্জীব ভাটের ভূমিকারও কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন , তারা অকারণে গুজরাট সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিরুদ্ধে সমালোচনা করে গিয়েছেন।

তিন বিচারপতির বেঞ্চ তদন্তকারী ‘ সিট ‘ কী অসম্ভব ভালো তদন্ত করেছে সে সম্পর্কে বিস্তৃত ভাবে বলেছেন।শুধুমাত্র বোঝা গেল না ওই হাউসিং সোসাইটিতে সারা দিন ধরে পুলিশের নাকের ডগায় আক্রমণ চালিয়ে এহসান জাফরিসহ ৬৯ জনকে হত্যা করলো মাত্র ২১ জন লোক। তাও ১০ জনের অপরাধ লঘু।বাকি ১১জনের কারো Sentence হয় নি।কিছু দিনের কারাবাস হয় , আবার জামিনও হয়েছে। ২০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে । কিন্তু তাতে কী হয়েছে ? প্রধান অপরাধ তাঁদের যাঁরা স্বামী , আত্মীয় , প্রতিবেশী , বাসভূমি সব হারিয়ে আদালতের কাছে সুবিচার চেয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের গঠন করা ‘ সিট ‘ এর তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন ? এতো বড় সাহস।

এই তিন সদস্যের বেঞ্চ এই রায়ে আর যা বলেছে তা অবিশ্বাস্য ও অভূতপূর্ব। মহামান্য বিচারপতিরা বলেছেন, যারা এই আবেদনে জাকিয়া জাফরির পাশে দাঁড়িয়েছেন , তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে শাস্তি দেওয়া উচিৎ। ওদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ওই বেরোনোর পরদিনই সকালে সংবাদ সংস্থা ANI দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন মোদীজি নীলকণ্ঠ । তিনি এই সমস্ত সাংবাদিক ও সমাজসেবা মূলক সংস্থার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ করে বলেন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। তিনি একথাও বলেন যে যদিও তিনি এখনও সম্পূর্ণ রায় পড়েন নি ,তবে ওই রায়ে তিস্তা শিতলবাদের নাম আছে। আপ ক্রনোলজি সমঝিয়ে।গুজরাট পুলিশ আর দেরী করেনি।শীর্ষ আদালতের রায়কে হাতিয়ার করেই ২৫ জুন আমেদাবাদের একটি থানায় ৮ পাতার এফ.এই.আর দায়ের করা হয়। এরপরই গুজরাট পুলিশের এন্টি টেরোরিস্ট স্কোয়াড (ATS ) মুম্বাই থেকে তিস্তা শেতলবাদকে গ্রেপ্তার করে। গুজরাট পুলিশের প্রাক্তন আই.জি , আর.বি. শ্রীকুমারকে গ্রেপ্তার করা হয় আমেদাবাদ থেকে।সঞ্জীব ভাট আগেই একটি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জেলে আছেন।

২৬ জুন অনেকগুলি ষড়যন্ত্রমূলক ধারায় অভিযোগ দায়ের করে তিস্তা শেতলবাদকে আমেদাবাদের মুখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে হাজির করলে তাঁকে ১ জুলাই পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে দেওয়া হয়।

সিট ( SIT ) এর তদন্ত বিষয়ে কয়েকটি কথা

——————————————–

২০০২ সালে গুজরাতের ভয়াবহ দাঙ্গা , যার মধ্যে গুলবার্গ সোসাইটির হত্যাকান্ড আছে , সম্পর্কে তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্ট ২০০৮ সালে একটি স্পেশাল ইনভেস্টিগেটিং টিম (SIT )গঠন করে। তাহলে এই কথাটা স্পষ্ট যে ওই দাঙ্গা ও হত্যাকান্ড সম্পর্কে গুজরাত পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে আস্থা রাখতে না পারার ফলেই সুপ্রিম কোর্ট ২০০৮ সালে SIT গঠন করে দিয়েছিল।

SIT এর যিনি প্রথম মুখ্য অধিকর্তা ছিলেন সেই আর কে রাঘবন ২০১৪ সালের জুলাই মাসেই জানান গুজরাত দাঙ্গায় ওই রাজ্য সরকারের কোনও গাফিলতি ছিলনা।মূখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এই দাঙ্গার কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় নি। দুই আই.পি.এস অফিসার সঞ্জীব ভাট ও আর.বি. শ্রীকুমার সম্পর্কে SIT এর বক্তব্য , ওরা অসত্য কথা বলেছিলেন। এই দুই আই.পি.এস অফিসার তাঁদের সাক্ষ্য তে বলেন, মোদি একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি মিটিংয়ে সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের বলেছিলেন কিছুদিন চুপ থেকে হিন্দুদের ক্রোধ প্রকাশ করার সুযোগ দিন। SIT এর বক্তব্য এই দুই পুলিশ অফিসার মিথ্যা কথা বলেছিলেন।

আরকে রাঘবনকে এরপরই নরেন্দ্র মোদির সরকার সাইপ্রাসে রাষ্ট্রদূত করে পাঠায়।

আইনজীবী কপিল সিবাল সুপ্রিম কোর্টে জানান সম্প্রতি নারোদা পাতিয়া গণহত্যায় সেশন কোর্টের রায়ে ২৮ বছর সাজা প্রাপ্ত বিজেপি নেত্রী মায়া কোদনানিকে গুজরাট হাইকোর্ট বেকসুর খালাস করে দিয়েছে , অথচ SIT তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে কোনো আপিল করেনি।

এই সব বিষয় SIT দেখেছে কি?

———————————————-

সন্মানিত বিচারপতি ওয়াই.ভি.কৃষ্ণ আয়ার – এর নেতৃত্বে যে নাগরিক কমিশন গঠিত হয়েছিল, তাঁরা অসংখ্য মানুষের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করে, বহু নমুনা সংগ্রহ করে, প্রশাসনের বক্তব্য গ্রহণ করে। ওই কমিশনের রিপোর্ট SIT ও সুপ্রিম কোর্ট সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলে আইনজীবী প্রশান্তভূষণ ও সমাজকর্মী মালা হাশমি সংবাদ মাধ্যম The Wire এর সাংবাদিক আসমা খানম শেরওয়াণীকে জানান। তাঁরা বলেন SIT এর তদন্তকারীরা ওই ২৮ ফেব্রুয়ারি , ২০০২ এর অভিযুক্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের Call List কেন চেক করেনি ? কেন নারোদা পাতিয়া ও গুলবার্গ সোসাইটির হত্যাকাণ্ডের মাস্টার মাইন্ড বাবু বজরঙ্গি এখনো জামিন পেয়ে বাইরে। ২০ বছর তো হয়ে গেলো।

বেস্ট বেকারি হত্যাকান্ড, যাতে ১৬ জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হল, সেই হত্যার জন্য কেন একজনেরও শাস্তি হলো না ?

রানা আয়ুবের লেখা ‘ গুজরাট ফাইল ‘, মনোজ মিত্তা ‘ র ‘Friction of fact findings ‘ , আশিস খৈতানের ‘ স্ট্রিং ভিডিও ‘ প্রভৃতি তদন্তমূলক বিশদ প্রতিবেদনগুলি SIT আদৌ দেখেনি। সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান বেঞ্চও ওগুলির ভিত্তিতে নতুন করে তদন্তের কথা না বলে SIT , গুজরাত সরকার ও নরেন্দ্র মোদিকে ‘ ক্লিন চিট ‘ দিয়েছে। ওগুলি পরীক্ষা করলেই বোঝা যেত গুজরাত দাঙ্গার মাস্টার মাইন্ড কে বা কারা?

সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রায় ——————————————

সুপ্রিম কোর্টের মতে SIT খুব ভালো তদন্ত করছে ও গুজরাত সরকারেরও কোনো দায়িত্ব নেই এই দাঙ্গার জন্য , সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দিতেই পারে।

কিন্তু যাঁরা তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির জন্য জন্য আবেদন করেছিলেন তাঁদের কিছু Disgruntled Element ( হতাশ ব্যক্তি )ও তাঁরা Ulterior Motive ( সুদূর প্ৰসারি উদ্দেশ্য ) নিয়ে এই কাজ করেছে বলে সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন শীর্ষ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত দুই বিচারপতি , যাঁরা অত্যন্ত সম্মানিত। এঁরা হলেন জাস্টিস মদন বি লকুর এবং দীপক গুপ্তা। আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়ে এইভাবে কারো সম্পর্কে মন্তব্য করা Principle of Natural Law Of Justice বলে তাঁরা মন্তব্য করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট SIT কে নিয়োগ করেছে বলে তার তদন্ত নিয়ে সুপ্রিম করতেই কাছে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবেনা এই ব্যাখ্যার সিঙ্গেল তাঁরা দ্বিমত পোষণ করেন।

আইনজীবী প্রশান্তভূষণ মনে করিয়ে দিয়েছেন ওই ভয়ঙ্কর দাঙ্গার পর গুজরাত সরকারের আচরণ সম্পর্কে ২০০৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন দুই বিচারপতি জাস্টিস দোরাইস্বামী রাজু ও জাস্টিস অরিজিৎ পাসয়াত বলেছিলেন ‘ এরা হচ্ছে আধুনিক যুগের নিরো। তাঁরা বলেছিলেন “যখন নারী ও শিশুরা জ্বলছে , নির্বিচারে নিহত হচ্ছে তখন গুজরাট প্রশাসন হত্যাকারীদের রক্ষা করার চেষ্টা করে চলেছে।” সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান বেঞ্চ তৎকালীন ডিভিশন বেঞ্চের ওই বক্তব্য সম্পর্কে কী বলবেন ? রাষ্ট্রপুঞ্জের তীব্র নিন্দা

————————- ——–

সমাজকর্মী ও সাংবাদিক তিস্তা শেতলবাদকে গ্রেপ্তার করার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা করল রাষ্ট্রপুঞ্জ। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার রক্ষা কমিটির অন্যতম আধিকারিক মেরি লউলার বলেন মানবাধিকার রক্ষা করার জন্য কাজ করা কোনো অন্যায় নয়। তিনি বলেছেন ” তিস্তা শেতলবাদ ঘৃণা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক দৃঢ় কণ্ঠ ।” তিস্তাকে আটক করা নিয়ে মেরি লউলার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *