শান্তনু দত্ত চৌধুরী
বেশিদিন আগে নয়,২০১৪ সালের ১৭অকটোবর রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের মালয়ালাম ভাষায় প্রকাশিত মুখপত্র ‘কেশরী ‘তে কেরালার এক বিজেপি নেতা বি.গোপালকৃষ্ণন একটি নিবন্ধ লেখেন। নিবন্ধটিতে গোপালকৃষ্ণন লেখেন নাথুরাম গডসের উচিৎ ছিল গান্ধির পরিবর্তে জওহরলাল নেহরুকে হত্যা করা।নাথুরাম লক্ষ্য নির্ধারণে ভুল করেছিলেন।লক্ষ্যনীয় নিবন্ধটিতে খুনী নাথুরামের হিংস্র কাজকে নিন্দা করা তো দূরের কথা তার খুনের লক্ষ্য (Target) নিয়ে বিশেষজ্ঞসুলভ মতামত দেওয়া হয়েছে।এই নিম্ন স্তরের বক্তব্যের জন্য গোপালকৃষ্ণন কার্যত বিজেপি ও আরএসএস এর নেতৃত্বের অনুমোদন পেয়েছেন।এই নেতৃত্ব এটি গোপালের ব্যক্তিগত মত বলে দায় সেরেছেন।
মহাত্মা গান্ধিকে হত্যার পর হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি তীব্র জনরোষের সম্মুখীন হয়।ফলে তারা পন্ডিত নেহরুকে হত্যা করার পরিকল্পনা কার্যকর করতে পারেনি।কিন্তু ওই সময় থেকেই তাদের রাজনৈতিক আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য নেহরু। এই সাম্প্রদায়িক শক্তির মতন আর একজন ব্যক্তির আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন মহাত্মা গান্ধি ও পণ্ডিত নেহরু।এই ব্যক্তিটি হলেন কট্টর সাম্রাজ্যবাদী ও ভারত বিরোধী উইনস্টন চার্চিল।ইনি গান্ধিজি সম্পর্কে বলেছিলেন ‘ অর্ধ নগ্ন ভারতীয় ফকির ‘ (হাফ নেকেড ইন্ডিয়ান ফকির)।আমাদের স্বাধীনতার প্রাক্কালে চার্চিল বলেছিলেন ‘ উই আর টার্নিং ওভার ইন্ডিয়া টু ম্যান অফ স্ট্র লাইক দ্য কাস্ট হিন্দু মিস্টার নেহরু, অফ হিম ইন এ ফিউ ইয়ার্স নো ট্রেস উইল রিমেন ‘। অর্থাৎ ‘আমরা ভারতকে তুলে দিয়ে যাচ্ছি বর্ণহিন্দু মিস্টার নেহরুর মতন খড়ের মানুষের হাতে, ক’বছরের মধ্যে আর যাদের খুঁজে পাওয়া যাবেনা।’
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার এক দশকের মধ্যেই উইনস্টন চার্চিলকে স্বীকার করতে হয়েছিল যে নেহরু একজন ভয়লেশহীন মানুষ।তিনি খড়ের মানুষ নন, লোহার মানুষ। ‘এশিয়ার আলো ‘,তাঁর সম্পর্কে এই কথাটা নেহেরুর মৃত্যুর ক-বছর আগে বলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি। তিনি বলেছিলেন ” নেহরুর জোট নিরপেক্ষ নীতি হয়তো আমেরিকার পক্ষে বিরক্তির কারণ হতে পারে, বাট ইট ডাস মিন দ্যাট ইন্ডিয়া ম্যাটার্স।” স্বাধীন ভারতের এই স্বীকৃতি ও সম্মান যদি কোনও বিশেষ একজনের কৃতিত্ব হয় তা অবশ্যই আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিতনেহরুর।
মহাত্মা গান্ধি ১৯৪২ এর ১৫ জানুয়ারি লিখেছিলেন ‘ কেউ কেউ বলেছে পন্ডিত জওহরলাল ও আমার মধ্যে বিচ্ছেদ হয়েছে।আমাদের মধ্যে বিভেদ আনতে হলে শুধু মতান্তর ছাড়াও আরো কিছু ঘটাতে হবে।আমরা সহকর্মী হবার মুহূর্ত থেকেই আমাদের মধ্যে অমিল ছিল; তা সত্ত্বেও আমি কয়েকবছর ধরে বলে আসছি এবং এখন আবার বলছি যে রাজাজি (রাজাগোপালাচারি) নয়, জওহরলালই আমার উত্তরাধিকারী হবে।সে বলে যে সে আমার ভাষা বোঝেনা এবং সে যে ভাষায় কথা বলে সেটা আমার কাছে বিদেশি প্রাণের মিলে ভাষার অন্তরায় হতে পারেনা এবং এটা আমি জানি — যে যখন আমি থাকবো না,সে আমার ভাষাতেই কথা বলবে ”
মহাত্মা গান্ধির উত্তরাধিকারী জওহরলাল ছিলেন ও এখনও আছেন হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবারের অর্থাৎ মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকার থেকে নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত সবার হিট লিস্টে এক নম্বরে।কমিউনিস্টদের একাংশ একসময় তাঁর নাম দিয়েছিল ‘কেরেনস্কি’।রুশ বিপ্লবের সময় সেই গদিচ্যূত প্রধানমন্ত্রী।নেহরুকে কেউ বলেছেন প্রাচীনপন্থী।কেউ বলেছেন নাস্তিক।কেউ তাঁকে বলেছেন কল্পনাবিলাসি। কারও মতে তিনি ট্র্যাজেডির নায়ক,হ্যামলেট।রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড ল্যাক্সি তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, সমসাময়িককালের বিশ্বে সবচেয়ে চলমান জননেতা।
প্রজাতন্ত্রী সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা,পরিকল্পিত উন্নয়ন,জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি–পণ্ডিত নেহরুর চিন্তার ফসল।তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠান গড়ার মনোযোগী কারিগর।যোজনা কমিশন ,সমষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প,ভাখরা নাঙ্গাল, ডি.ভি.সি, এ্যটোমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট, টাটা ইনস্টিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ,মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, দুর্গাপুর, বোকারো, ভিলাই, রাঁচি হেভি ইঙ্গিনীরিং, চিত্তরজন লোকোমোটিভ, আইআইটি , আই.আই.এম আরও কত কিছুইনা পণ্ডিত নেহরুর চিন্তা ও দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করছে।তিনি এগুলিকে বলতেন –‘ টেম্পলস অফ মডার্ন ইনডিয়া ‘।এই দেশের স্বয়ম্ভর অর্থনীতির ভিত্তি এই বিশাল রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিকে এখন পুঁজিপতিদের তল্পিবাহকরা জলের দরে কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দিচ্ছে।পন্ডিত নেহরু যা সৃষ্টি করে গিয়েছেন সেগুলিকে এক এক করে ধ্বংস করাই এখন এই হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রধান কাজ। কেউ একজন লিখেছিলেন ওঁর মাথায় ‘গান্ধিটুপি’ যেমন মানায় তা আর কারোর মাথায় মানায়না।গান্ধিজির সচিব মহাদেব দেশাই বলেছিলেন ওঁর চরকা থেকে শুধু সরু সুতোই বের হয়।জেলখানায় ওঁর প্রায় ১০ বছর সময় কেটেছে।কারাজীবনে তিনি ‘ গ্লিম্পসেস অফ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি ‘ ,’ অটোবায়োগ্রাফি’, ‘ ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া ‘ র মতন বই লিখেছেন যা বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। কবিগুরু ওঁকে সম্বোধন করেছিলেন ‘ঋতুরাজ’ বলে।
১৯৩৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তাঁর স্ত্রীর গুরুতর অসুস্থতার জন্য পন্ডিত জওহরলালকে জেল থেকে ‘প্যারোলে’ মুক্তি দেওয়া হয়।আগেই কমলা নেহরুকে চিকিৎসার জন্য কন্যা ইন্দিরা ইউরোপে নিয়ে এসেছিলেন।সঙ্গে ছিলেন তাঁদের আত্মীয় ও পারিবারিক চিকিৎসক ডা.অটল ।তাঁদের সহায়তা করছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র।তিনি ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসিত হয়ে ইউরোপে ছিলেন।পন্ডিত নেহরু এসে পৌঁছনোর পরই ২৮ ফেব্রুয়ারি ভোর পাঁচটায় সুইজারল্যান্ডের লসেন শহরের এক স্যানেটরিয়ামে কমলা নেহরু প্রয়াত হন। কমলার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ জওহরলালকে শোকবার্তা পাঠান (২৯ ফেব্রুয়ারি,১৯৩৬)।শোকবার্তায় কবি বলেন “আমার গভীর শোক জানাইতেছি।জীবনে মরণে তিনি আপনার বীরত্বে অংশগ্রহণ করিয়াছেন।সেই বীরত্বের কীর্তিস্তম্ভস্বরূপ তিনি অমর হইয়া থাকিলেন “। কবি ওইদিন শান্তিনিকেতন আশ্রম বন্ধ রাখেন। কমলার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ৮ মার্চ, ১৯৩৬ দিনটিতে শান্তিনিকেতন আশ্রমে ‘কমলা দিবস’ পালন করা হয় এবং কবি নিজে প্রার্থনাসভা পরিচালনা করেন।এই উপলক্ষে তিনি যে গানটি রচনা করেন (গীতবিতান আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে সংকলিত)তা হল —– ‘ মরণ সাগর পারে তোমরা অমর তোমাদের স্মরি ‘।
এই সভায় কবি কমলা নেহরুর মহীয়সী ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন ও দীর্ঘ ভাষণ দেন। এই ভাষণটি পরে রবীন্দ্র রচনাবলীতে সংকলিত হয়।ভাষণটিতে কবি জওহরলাল সম্পর্কে বড় প্রত্যাশার কথা উল্লেখ করেন যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
তিনি বলেন “কমলা নেহরু যাঁর সহধর্মিনী,সেই জওহরলাল আজ সমস্ত ভারতের তরুণ হৃদয়ের রাজাসনে প্রতিষ্ঠিত হবার অধিকারী।অপরিসীম তাঁর ধৈর্য্য, বীরত্ব তাঁর বিরাট —কিন্তু সকলের চেয়ে বড় তাঁর সুদৃঢ় সত্যনিষ্ঠা, পলিটিক্সের সাধনায় আত্মপ্রবঞ্চনা ও পরপ্রবঞ্চনার পঙ্কিল আবর্তের মধ্যে নিজেকে কখনো হারিয়ে ফেলেননি।সত্য যেখানে বিপজ্জনক, সেখানে সত্যকে তিনি ভয় করেননি,মিথ্যা যেখানে সুবিধাজনক, সেখানে তিনি সহায় করেননি মিথ্যাকে”। এই ভাষণে কবিগুরুও গান্ধিজীর মতন ভবিষ্যৎ ভারতের প্রধানরূপে জওহরলালের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন—- “আজ হোলির দিন , আজ সমস্ত ভারতে বসন্তোৎসব। …… আজ এই নবযুগের ঋতুরাজ জওহরলাল।আর আছেন বসন্তলক্ষী কমলা তাঁর সঙ্গে অদৃশ্যসভায় সম্মিলিত।তাঁদের সমস্ত জীবন দিয়ে ভারতে যে বসন্ত সমাগম তাঁরা ঘোষণা করেছেন ,সেতো অনায়াস আরামের দিক দিয়ে করেননি “।
পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ছিলেন আমাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশিষ্ট নেতা, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞান মনস্ক চিন্তানায়ক। তিনি ছিলেন এক দুর্লভ শ্রেণির গণতন্ত্রী। বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধানের প্রধান প্রবক্তা। স্বয়ম্ভর অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি সুবিশাল রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রগুলি তাঁরই চিন্তার ফসল।সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের পথ প্রদর্শক এক মহান আন্তর্জাতিকতাবাদী।