হিংসা — পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের প্রাথমিক শর্ত

দীপ্তিমান ঘোষ

আমরা ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তিন দশা পার হয়ে এলাম। কোভিড-১৯-এর প্রকোপ, প্রখর গ্রীষ্মকালীন দাবদাহ সত্ত্বেও ভোটদানের ঊর্ধ্বমুখী হার বেশ কিছু সংশয়ের সামনে আমাদের হাজির করেছে।

প্রথম দুই দফা ভোটাভুটির শেষে বেশ কয়েকটি উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা আমার নজর কেড়েছে, যেমন ভোটদান পর্ব মূলত শান্তিপূর্ণ থেকেছে। কিন্তু তৃতীয় দফার দিন আমরা সেই পুরনো হিংসার পুনরাবৃত্তি দেখতে পেয়েছি এবং সেটা এমন স্তরেও পৌঁছে যায় যেখানে দুজন মহিলা প্রার্থীকে পর্যন্ত আক্রান্ত হতে হয়। একজন মহিলা বিরোধী প্রার্থীকে তার বিরোধী দলের কর্মী থাপ্পড় মারে, এবং একজন তৃণমূল মহিলা প্রার্থীকে প্রাণে বাঁচতে ধানক্ষেত ধরে ছুটতে হয় এবং তারপরেও বিরোধীরা তাকে শারীরিক  নির্যাতন করে।

অথচ সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতি আমরা দেখলাম তামিলনাড়ু, কেরালা, আসাম এবং পুদুচেরির নির্বাচনে। আসাম বাদে বাকি তিন জায়গায় নির্বাচন পর্ব ছিল সাকুল্যে এক দিনের ঘটনা। সদ্য ২০২০-এর অক্টোবরে বিহারে নির্বাচন যজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছে, কোভিড-১৯ অতিমারির পর প্রথম ভোটদান পর্ব। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে এবং এক ৬৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। ১৫ বছর আগে হিংসাপ্রবণ একটি রাজ্য হিসাবে বিহারের বদনাম ছিল। সেখানে কয়েকজন মাফিয়াগুন্ডা কিছু নির্বাচনী ক্ষেত্রে হিংসার রাজ কায়েম করেছিল। ওই সকল নির্বাচনী ক্ষেত্রগুলিতে এই দুর্বৃত্তদেরই ভোটে দাঁড়াতে দেখা যেত। নিতিশ কুমার সরকারের কৃতিত্বে এই সব অধিকাংশ গুন্ডা বদমায়েশ আজ কারান্তরালে এবং সত্যি কথা বলতে গুন্ডারাজ দমন করা গেছে। এরফলে বিহারের রাজনীতির বাতাবরণে শুদ্ধিকরণ ঘটেছে এবং রাজ্যে নির্বাচনও শান্তিপূর্ণ হতে দেখা গেছে।

আজ আমাদের নিজেদের কাছে প্রশ্ন করার সময় এসেছে, এ জিনিস কেন সম্ভব নয় পশ্চিমবঙ্গে? নজিরবিহীনভাবে এবারের ভোট আট দফায় সংঘটিত হবে। এক নির্বাচন থেকে পরের নির্বাচনে ভোটপর্বের সাথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সংখ্যাবৃদ্ধিও চলেছে সমান তালে। অথচ তথাপি এই হিংসাবৃত্তি কিছুতেই দমন করা যায় নি। কারণ হচ্ছে বাংলায় হিংসা ব্যাপারটা বিশেষভাবে জাতিগত একটি বিষয় এবং আমাদের এখানেই লক্ষ্য করতে হবে যে কেন এমনটা হচ্ছে।

১৯৬৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস পার্টি সামান্য কিছু ভোটে হেরে যায় এবং একটি যুক্ত ফ্রন্ট সরকার রাজ্যে প্রশাসনিক দায়িত্বে আসে। বাংলায় তখন দুইটি স্তরে হিংসার উদ্রেক হতে দেখা যায় — প্রস্তুতকারী শিল্প সংস্থায় এবং গ্রাম বাংলায় জমিদার ও জোতদারদের বিরুদ্ধে। নকশালপন্থীদের নেতৃত্বাধীন অতি বাম আন্দোলনে এক ভয়াবহ হিংসার প্রতিটি দিন, অসংখ্য হত্যা খুন প্রত্যক্ষ করে পশ্চিমবাংলা। ১৯৭১-এর সাধারণ নির্বাচনে এই নকশালবাড়ি আন্দোলনের রূপ চরম হিংসার আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৭২ বিধানসভা নির্বাচনে বিতর্কিতভাবে আবার কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে হিংসায় মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠতে দেখা যায়।

১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বামফ্রন্ট সরকারের অবতারনার সাথে সাথে অবশ্য ঘটনার বদল শুরু হয়। দীর্ঘ বিরতির পর ফের পঞ্চায়েত নির্বাচন সংঘটিত হয়। যাহোক অন্যান্য রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনের যা হয় না বাংলায় অবশ্য তা-ই হল, দলীয় প্রার্থীদের ব্যবহার লক্ষ্য করা গেল। বর্ষীয়ান গান্ধিবাদী নেতা এবং পশ্চিমবঙ্গের পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন পঞ্চায়েত করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। সেইসময় প্রফুল্লবাবু জনতা পার্টীর সাংসদ। কিন্তু দেখা গেল, যেহেতু সি পি এম এবং বাম দলগুলি জানতো তাঁদের কর্মী খুবই শক্তিশালী ফলত তারা দলীয় ছাতার তলায় পঞ্চায়েত ভোটের জন্য দাবি জানায়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে সর্বস্তরে দেখা গেল দল ও নাগরিকবৃন্দের এক আন্তঃসম্পর্ক গড়ে উঠল, যেখানে দল ক্রমশ মুখ্য নির্ণায়কের স্তরে উপনীত হল এবং এমনকি সমাজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের ক্ষেত্রেও। এটা যেন একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেল যে সাধারণ মানুষের পাশে বিচার ব্যবস্থার জটিল সিঁড়ি ভেঙে অতদূর যাওয়া সম্ভব নয় ফলত প্রতিবিধান এভাবেই। ২০০৭-২০০৮ অব্দি এই বামফ্রন্টের নানান কাল জুড়ে পঞ্চায়েতের উপর কর্তৃত্ব জুলুমের পর্যায়ে পৌঁছে গেল।

২০০৭ সালের মার্চ মাসে নন্দীগ্রামে গুলি চলার ঘটনা বামফ্রন্টের গ্রামীণ ক্ষেত্রে প্রথম ক্ষতের সৃষ্টি করল। এবং পরের বছর ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল দলের ব্যাপক সমর্থন লাভ কংগ্রেসের ওই ঘটনারই অভিঘাতের ফলস্বরূপ। তৃণমূলের সিঙ্গুর অভিযান গ্রামবাসীকে ভুল বার্তা দিল যে, মমতা ব্যানার্জি গরিব মানুষের একজন এবং তারা পূর্ণ সমর্থন জানাল তাকে। বামেদের হাত থেকে পঞ্চায়েত তৃণমূলের ঝুলিতে স্থানান্তর টি এম সি দলের ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভের প্রাথমিক কাজটা সেরে দিয়েছিল। সেই থেকে তৃণমূল দলের আর পিছনে ফিরে তাকানোর ফুরসৎ মেলে নি। জয়ের প্রাথমিক উত্তেজনা এবং সমর্থন কদিনের মধ্যেই দলের নেতাকর্মীদের সুরে ঔদ্ধত্যরূপে আত্মপ্রকাশ করল। বামেদের সাথে একত্রে এক বিশেষ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তৃণমূল জমানায় দল ও নাগরিকবৃন্দের ওই আন্তর সম্পর্ক ব্যাপারটি বদলে গেল। স্থানীয় পেশিধারীরা পাড়ার ক্লাবের বদান্যতা ও সৌজন্যে সহজেই স্থানীয় বাসিন্দাদের তাদের দয়াদাক্ষিণ্যের আওতায় এলে ফেলল। স্থানীয় প্রশাসনিক স্তর যা বিগত তিন যুগ ধরে দল্কে বাঁচিয়ে রাখার মত কাজগুলি করত তারাই রাতারাতি তাদের আনুগত্য বদলে ফেলল।

২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে নিয়মনীতি লঙ্ঘনের প্রাচুর্য পরিলক্ষিত হল। গোটা বাংলায় ৩৪ শতাংশ আসলে বিরোধীরা এমনকি তাদের প্রার্থী খাড়া করতে পারল না। ২০০০০ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজিত হল। যেকোনো উপায়ে ক্ষমতার পুনর্দখলে তৃণমূল পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করল। স্থানীয় চত্বরে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ল সমাজের গভীর স্তরে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে যার প্রেক্ষিতে জবাবও মিলল তেমনই। বিজেপি দল ১৮ টি লোকসভা আসনে জয়লাভ করল। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকান্ডের পরেও এ বাংলার নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছিল ১৬ টি আসন। খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে যে, কংগ্রেস এবং বামদলগুলি ২০১৯-এর নির্বাচনে জোটবদ্ধ লড়াইয়ে সামিল হতে পারে নি যদিও ফলাফল হয়তো তার জন্যে খুব একটা কিছু হেরফের হতো না। ২০২১ নাগাদ তৃণমূলের প্রতি সমর্থন যথেষ্ট ভাবেই অবমৃয়মান। তাদের নিজেদেরই পর্যবেক্ষণ বলছে তারা হেরেও যেতে পারে। বিজেপি দলও বলছে তারা হিংসার বিরুদ্ধে হিংসা দিয়েই জয় ছিনিয়ে আনবে এবং দলের রাজ্য সভাপতির অসংযমী মন্তব্য এ পরিস্থিতিতে যথেষ্ট ক্ষতিকর। এই মন্তব্যগুলি স্রেফ আরও হিংসাকে উস্কে দেওয়া ছাড়া কিছুই না। শিকার হচ্ছেন কিন্তু কিছু সাধারণ মানুষ। অসংখ্য অগণিত বেকার ও আধা বেকার এই তরুণ সম্প্রদায়ই মূলত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলির সহকারী বা স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করে। শেষপর্যন্ত একচুল শুভবোধের আশাই রাখতে পারেন। দলীয় ছাতার আওতায় পঞ্চায়েত নির্বাচন এই বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপারটার সমাধান করতে পারে। বাংলার হিংসাবৃত্তির বদনাম কখনই বিনিয়োগের পক্ষে উপযুক্ত নয়। সিঙ্গুর থেকে টাটা কোম্পানির বিতাড়ন বাংলার মুখ পুড়িয়েছে। ২০২১-এর এই ঘটমান বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস-আই এস এফ-এর সংযুক্ত মোর্চা একটি সুস্থ বিকেলের সন্ধান দেয়। মানুষের ভাগ্য আজ তাদের নিজেদের হাতেই। আজ মানুষকে যুক্তির পাশে সায় দিতে হবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *