অভিষেক রায়
গত বছর একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। মোবাইলে ওয়াটসঅ্যাপে ঘুরেছিল ভিডিওটি। কি যেন বিশাল মাপের একটা ভেঙে পড়ছে। আসলে একটা পাহাড়ের অংশ বালির স্থুপের মত ভেঙে পড়ছে। পাকদণ্ডী যেমন বেয়ে চলে পাহাড়ের নীচ থেকে উপর, তেমনি এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের সেই একমাত্র পথ। সেই পথে একটি গাড়ি ঠিক পাহাড় ভেঙে পড়ার মুহূর্তে এসে পড়েছে। ওপরদিক থেকে মানুষের চিৎকার। সেই সমবেত আর্ত চিৎকারের ফলে থেমে যায় গাড়িটি। ভিডিও এখানেই শেষ হচ্ছে। আশা করা যায় গাড়ির চালক সহ যাত্রীর আর কোন ক্ষতি হয়নি। প্রায় ২৯টা শহরের তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রিতে পৌঁছেছে। বিগত এক দশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের একটি তালিকা ইন্টারনেটে খুঁজতে গিয়ে দেখলাম ২০১৩ র উত্তরাখণ্ডের ফ্ল্যাশ ফ্লাড, ২০১৪ র কাশ্মীরের বন্যা, পশ্চিম বাংলায় ২০২০ র আম্ফান, ২০২১ এ ইয়াস। সেই বছরই মহারাষ্ট্রে নিসর্গ। শুধু ভারতে নয়, গত বছর বর্ষায় নিউ ইয়র্ক শহরে ভেসে গেছিল। কিন্তু এমনটা সত্যি ঘটছে কি ভাবে! বিশ্ব উষ্ণায়নও এখন নূতন কোন বিষয় নয়। এবং আমরা সবাই জানি বিশ্ব উষ্ণায়নের কথা গত দুদশক ধরে। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পৃথিবী।
২০১৫ সালে প্যারিসে রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে একটি সম্মেলন হয়। সেই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটজনক পরিস্থিতিতে ১৯০ টি দেশ একটি চুক্তি সাক্ষর করে। পৃথিবীর গড় উষ্ণতা যে ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাকে ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে রাখতে হবে, কিন্তু চেষ্টা করতে হবে যেন এই বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে রাখা যায়। আবার ২০১৮ তে রাষ্ট্রপুঞ্জেরই একটি রিপোর্টে বলছে প্যারিস চুক্তিতে ঠিক হওয়া ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর বিপর্যয় আগের হিসাব অনুযায়ী অনেক বেশি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড রাখার চেষ্টা না করলে প্রলয় কেউ আটকাতে পারবেনা। কিন্তু এই ক্রম বর্ধমান উষ্ণতার কারণ কি? বৈজ্ঞানিকেরা বলছেন গ্রীন হাউজ গ্যাসগুলি পৃথিবীকে গরম করছে। কার্বন ডাইঅক্সাইড-সহ অন্য গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ উত্তরোত্তর বাড়ছে। কার্বন ডাইঅক্সাইড গত পাঁচ বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এই গ্যাস শয়ে শয়ে বছর ধরে বায়ুমণ্ডলেই থেকে যায়। সমুদ্রে থেকে যায় আরও অনেক বেশি সময়। আর এই গরম বৃদ্ধি পাওয়ায়, আরেকটি ভয়ানক ঘটনা ঘটছে, অ্যান্টারটিকার বরফ একটু একটু করে গলছে। গ্রীনল্যান্ড ও অ্যান্টারটিকার বরফ গলার সাথে সাথে সমুদ্রের জল তল বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি সমীক্ষায় বলছে এই জলস্তর বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবন সহ বেশ কিছু দ্বীপ ভেসে যাবে।
আজকের পৃথিবীর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিপদ হল জলবায়ু পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের জন্যে আরেকটি বিষয় দায়ী, তা হল গাছ কাটা। প্রতিদিন পৃথিবীর বুক থেকে অরণ্য অপসারিত হচ্ছে। এই অরণ্য গুলোয় থাকে পৃথিবীর ৫০% জীব বৈচিত্র্য। আজ থেকে একশো বছর আগে, পৃথিবীতে তিন গুণ বেশী বনাঞ্চল ছিল। মানুষের চাহিদা মেটাতে কেটে ফেলা হয়েছে সেই অরণ্য। অ্যামাজনের বর্ষারণ্য যাকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস, সেখান থেকে ২ কোটি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। একই ঘটনা ঘটছে ভারতেও। খনির জন্যে, রাস্তা সম্প্রসারণ এবং নগরায়নের জন্যে কেটে ফেলা হচ্ছে অরণ্য। মধ্য প্রদেশে হীরের খনির জন্যে তিন লক্ষ গাছ কেটে ফেলার কথা হয়েছিল। পরে সরকারের মধ্যস্থতায় তা বন্ধ হয়। মহারাষ্ট্রে রাস্তা সম্প্রসারণের জন্যে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে কয়েক লক্ষ গাছ। যশোর রোড, কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতেও একই ঘটনা ঘটেছে। এদিকে পশ্চিম বাংলায় প্রাচীন বৃক্ষ কেটে নতুন গাছ বসানো হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায় সবুজায়ন অব্যাহত থাকছে। কিন্তু একটি প্রাচীন গাছ যে পরিমাণে অক্সিজেন দেয় এবং পরিবেশকে বিশুদ্ধ রাখে, একটি নতুন গাছ সে জায়গায় পৌঁছতে বহু বছর লাগে। তাহলে আদপে এতে পরিবেশের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু নয়।
এছাড়াও শহরগুলিতেও আমরা প্রায়ই দেখি কারণে, অকারণে নিরন্তর কাটা হচ্ছে গাছ। এরপরেই আসছে মাটি। অরণ্য অপসারণ এবং কৃষিব্যবস্থা বিশেষ করে কীটনাশক যুক্ত কৃষি ব্যবস্থাতে ক্ষতি হচ্ছে মাটির। প্রতি বছর ৭৫,০০০ কোটি টন মাটি নদী এবং সমুদ্রে জমা হচ্ছে। এছাড়াও প্রতি বছর ৫৩৩.৪ কোটি টন মাটি ক্ষয়ে যাচ্ছে। এতে বিপুল ভাবে ক্ষতি হচ্ছে চাষের। বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর বুক থেকে মাটিও বিলুপ্ত হতে পারে। রাষ্ট্র পুঞ্জের পরিবেশ দপ্তর জানিয়েছে যে প্রতি বছর ভারতে তিন কোটি ৬০ লক্ষ্য বর্গ কিলোমিটার মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। এটি একটি খুব বড় রকমের বাস্তুতন্ত্রের সংকট যা গভীর ভাবে দুশ্চিন্তার বিষয়। খুব বড় রকমের প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটলে সাধারণ মানুষের কাছে এই খবর গুলো পৌঁছয় না। এগুলো সংবাদ মাধ্যমের কাছে গুরুত্ব বিশেষ পায়না।
শুধু গাছ নয় বাদ পড়েনি পাহাড়ও। অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানায় পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে বহুতল, বিশাল আবাসন। পশ্চিম বঙ্গেই পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে দুটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ হয়েছে। আর এই সব অঞ্চলের ভূমিজ অধিবাসীরা হয়েছে গৃহহীন। এই প্রক্রিয়া স্বাধীনতার পর থেকেই হয়ে আসছে।
পরিবেশ দূষণের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হল প্লাস্টিক দূষণ। প্লাস্টিক মাটিতে পচে না, এ তথ্য আমরা জানি। তাই এই প্লাস্টিক মাটি ও জল সবচেয়ে বেশী দূষিত করে। আর এই প্লাস্টিকের যত্র তত্র ব্যবহার আমরা এখনো বন্ধ করতে পারিনি। বলা ভালো ব্যবহার আরো বেড়েছে। প্রতি বছর এক কোটি টন প্লাস্টিক সমুদ্রে ঢোকে। এর বেশীর ভাগ প্লাস্টিক গুঁড় গুঁড় হয়ে যাকে মাইক্রো প্লাস্টিক বলা হয়, তা সমুদ্র তটে এবং গভীর সমুদ্রের নিচে সেডিমেন্ট হয়ে জমা হয়। জলে এই প্লাস্টিক ঢুকলে প্লাস্টিক থেকে টক্সিক রাসায়নিক পদার্থ জলকে স্বাভাবিক ভাবেই দূষিত করে। সমুদ্রের মাছ গুঁড় প্লাস্টিক খায় এবং এবং সামুদ্রিক খাবারের সাথে তা মানুষের পেটে গিয়ে তা ক্যান্সার ও নানারকম রোগ ঘটায়। আবার এই প্লাস্টিক পেটে যাওয়ার দরুন মারা যাচ্ছে অন্য জীবও। যেমন গরু, ছাগল ঘাসের সাথে প্লাস্টিক খেয়ে শ্বাস রোধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা প্রচুর হচ্ছে। বহু সময়েই প্লাস্টিক ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণের কথা শোনা গেছে কিন্তু সেসব কার্যকরী হতে দেখা যায়নি। তাই কড়া নিয়ন্ত্রণ এবং মানুষের বোধগম্যতা আসা খুব জরুরী।
পৃথিবীর বাস্তুশাস্ত্রের ভারসাম্য গোটা প্রাণী ও জীব জগতের সাথে এক সূত্রে বাঁধা। এখানে সকলেই সকলের পরিপূরক। জল, মাটি, বায়ু, বৃক্ষ ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব কি সম্ভব? এটাও মনে করা দরকার জল, মাটি, বায়ু, বৃক্ষের মানুষের প্রয়োজন নেই। কিন্তু মানুষ তাদের ছাড়া বাঁচবে না। তাহলে প্রকৃতি ধ্বংসের এই আত্মঘাতী পদক্ষেপ কেন?
এই প্রকৃতি ধ্বংসের অন্যতম কারণ হল মানুষের লোভ যার আরেক নাম consumption। উন্নয়নের নাম করে মানুষ নিরন্তর ভাবে ধ্বংস করছে প্রকৃতি ও প্রাণীজ সম্পদ। আর এই ধ্বংস চলেছে উন্নয়নের নাম করে।
প্রকৃতির এই বিপর্যয়ের কথা বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং তাই তারা গ্রাম সমাজ গড়ার দিকে নিজেদের সাধন ক্ষেত্র খুঁজে নিয়েছিলেন। দুজনেই পরিবেশ বান্ধব জীবনের কথা বলে গেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালে ইতালির তুরিন শহরে ‘City and Village’ বক্তৃতার মধ্যে বলেছেন, “অসংযত আড়ম্বরপূর্ণ জীবনের আকাঙ্ক্ষা সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের কুক্ষিগত, যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এই যে ক্রমবর্ধমান বোঝা তা একদিন যেকোন সভ্যতার পক্ষে মারাত্মক হবে।
তাহলে বুঝতেই পারছেন উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী ধ্বংসের কিনারায় এসে পড়েছে। কিন্তু মানুষ সম্ভবত জেগে ঘুমোচ্ছে।
২০২১ এ গ্লাসগো শহরে যখন জলবায়ু সম্মেলন চলছে তখন পৃথিবীকে বাঁচানোর ডাক দিলেন আঠেরো বছরের সুইডিশ তরুণী গেটা থুনবার্গ। গ্রেটার দাবীকে সমর্থন জানাতে সেদিন পার্কে জড়ো হয়েছিলেন বহু পরিবেশ আন্দোলনকারী। গ্রেটার এই আন্দোলন প্রভাব ফেলেছে গোটা বিশ্বে।
আমাদের বর্তমান সভ্যতায় জীবনশৈলীতে যদি পরিবর্তন না আসে তা হলে তারা বিলুপ্ত হবে।