ইলেক্টোরাল বন্ড – বিজেপির রাজনৈতিক তোলাবাজি এবং দূর্নীতি নিয়ে দূর্নীতি।

পার্থ মুখোপাধ্যায়

আগের সংখ্যায় ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে তাৎক্ষনিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রাথমিক কিছু বিষয়কে নিয়ে একটি লেখা বেরিয়েছিল। এখন যেহেতু আরও অনেক নতুন তথ্য সামনে এসেছে এবং আসছে, তার ভিত্তিতেই এই বর্তমান লেখাটি প্রস্তুত হয়েছে। ইলেক্টোরাল বন্ডের শুরুর ইতিহাসটাই বেশ চমকপ্রদ এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার অপব্যবহারের এক চুড়ান্ত নিদর্শন হয়ে আছে। ২০১৭ সালের অর্থ বিল বা সাধারণ অর্থে বাজেটের অংশ হিসাবে ইলেক্টোরাল বন্ড ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে প্রবর্তন করা হয়। এই ব্যবস্থায় যে কোনো সংস্থা বা মানুষই তাদের ইচ্ছামতো অর্থের বন্ড কিনতে পারতেন, যা পরবর্তীতে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫১র আওতায় থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্রেতা বা দাতার পছন্দ অনুযায়ী ভাঙ্গাতে পারতেন। এই ক্রয় এবং ভাঙ্গানোর প্রক্রিয়াগুলি সম্পন্ন হতো স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মাধ্যমে। এই সমগ্র প্রক্রিয়ার বিশেষত্ব ছিলো বন্ড ক্রয়ের সময় ক্রেতা বা দাতা এবং ভাঙ্গানোর সময়ে রাজনৈতিক দলগুলির পরিচয় সম্পূর্ণ রূপে গোপন রাখা হতো। সিপিএম এবং বামপন্থী দলগুলি প্রথম থেকেই এই ইলেকটোরাল বন্ডের ব্যবস্থারই বিরুদ্ধে ছিলো। জাতীয় কংগ্রেসও এই পরিচয় গোপন রাখার প্রসঙ্গের বিরোধিতা করে। আসলে এই ইলেক্টোরাল বন্ডের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাটা প্রথম থেকেই আর্থিক স্বচ্ছতার বিভিন্ন মানদন্ডে এবং আইনি নৈতিকতার অনুশীলনের ধারাবাহিকতার বিচারে একাধিক স্বাভাবিক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলির বিশাল অর্থের খরচের কথা এবং প্রয়োজনের প্রেক্ষিত সম্পর্কে আমাদের দেশে বহু আলোচনা অনেক দিন ধরেই চলছে। আলোচনায় এমন কথাও উঠে এসেছে যে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের চেয়েও হয়তো আমাদের রাষ্ট্রীয় সাধারন নির্বাচনের খরচ বেশি। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলির কাজের প্রয়োজনে বিপুল খরচের বোঝা কমানোর কথা বলে মোদী সরকার অর্থ বিলের অংশ হিসেবে এই ইলেক্টোরাল বন্ডের প্রচলন করে। প্রথমেই যে কারনে ইলেক্টোরাল বন্ডের ব্যাপারে আপত্তি উঠেছিল তা এই বন্ড ব্যবস্থাটিকে আইনি রূপ দেওয়ার পথে সমাজের বিভিন্ন অংশ এবং রাজনৈতিক দলগুলির সম্ভাব্য প্রশ্নের বিতর্কগুলিকে সচেতন ভাবেই এড়াতে চাওয়ার কারনে। এই কাজটি করতে আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত সংসদীয় নিরিক্ষা ও সমীক্ষার প্রক্রিয়াগুলিকে সরাসরি এড়াতে অর্থ বিলের মাধ্যমে মোদী সরকার এই ইলেক্টোরাল বন্ডের প্রচলন করে। এইসব কারনে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সংবিধানের ১১০ নং আর্টিকেল লঙ্ঘনেরও অভিযোগ ওঠে।সংবিধানের ১১০ নং আর্টিকেলে অর্থ বিলের কথা বলা হয়েছে। বাৎসরিক বাজেট সংসদে পাস হওয়ার পর অর্থ বিলে পরিনত হয়, যা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ কর, সরকারি ঋণ নীতি, সরকারের আয় এবং ব্যায়ের নির্ধারণ প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে। সংসদে অন্যান্য বিল পাসের ক্ষেত্রে সরকার ব্যার্থ হলে পদত্যাগ করতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু অর্থ বিল পাসে ব্যার্থ হলে সরকারের পদত্যাগ নিশ্চিত হয়। এছাড়া অর্থ বিল সময়ে পাস না হলে বা ভোটাভুটিতে পরাজিত হলে অথবা তার আনুসাঙ্গিক কোনো বিল ভোটাভুটিতে পরাজিত হলে পরবর্তীতে ব্যায় বরাদ্দ এবং সাধারন কাজকর্ম পরিচালনাতেও ব্যাপক সাংবিধানিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এইসব কারনে বিরোধীদেরও অর্থ বিল পাসের ক্ষেত্রে একটা দায় এবং দায়িত্ব থেকেই যায়। ঠিক এই অবস্থাতেই বিরোধীদের বাধ্যবাধকতার এবং দায়বদ্ধতার অনৈতিক ও অন্যায় সুযোগ নিতে মোদী সরকার ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে ২০১৭ সালের অর্থ বিলের অংশ করে সংসদে পেশ করে। ঘটনাচক্রে এই ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত বিলের বিরোধিতার কারনে যদি অর্থ বিল ভোটাভুটিতে পরাজিত হতো, তখন দেশে নানা রকম আর্থিক ও রাজনৈতিক জটিলতার সৃষ্টি হতো। অর্থ বিলের অংশ হওয়ার কারনেই ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলিও বর্ধিত আলোচনা এবং সংসদীয় বিভিন্ন সমিতিগুলির বিস্তারিত পর্যালোচনা ব্যতিরেকেই আইনে পরিনত হয়। এই বন্ডের বিষয়টিকে অর্থ বিলের অংশ হিসাবে পেশের আরও একটা কারন ছিলো ২০১৭ সালে বিজেপির রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিলোনা, ফলে ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত বিল সাধারন বিল হিসাবে পাশ না হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিলো যা অর্থ বিলের ক্ষেত্রে ছিলোনা।এই জন্যেই অভিযোগ উঠেছিলো মোদী সরকার সংবিধানের ১১০ নং আর্টিকেলের অন্যায় অপব্যবহার করেছে।এরপর সময় যতই এগিয়েছে, ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে ধোঁয়াশা, প্রশ্ন এবং অভিযোগ ক্রমশ জোরদার হয়েছে এবং অর্থ বিলের সুরক্ষার ঢাল নিয়ে একে আইনে পরিনত করানোর উদ্দেশ্য ততই প্রকট হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে এই ইলেক্টোরাল বন্ডের হাতবদলকে সবরকম আইনি মান্যতা দেওয়ার লক্ষ্যে কোম্পানি আইন, ২০১৩ এবং আয়কর আইন, ১৯৬১ এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫১ তেও প্রয়োজনীয় বদল করা হয়েছিলো। এই বন্ডের বিরুদ্ধে ছিলো এমনকি নির্বাচন কমিশন এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াও। জাতীয় কংগ্রেসও নীতিগতভাবে তথ্য গোপনের বিষয়টির বিরুদ্ধেই ছিলো এবং এই ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে তাদের বিরোধিতার কথা ব্যাক্ত করেছে।বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের পর সিপিআই(এম) এবং এ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্ম (এডিআর) এর দায়ের করা মামলায় গত ১৫ই ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ এ মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট এই সমগ্র ইলেক্টোরাল বন্ড এর ব্যাপারটিকেই অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছে। শুধু তাতেই ক্ষান্ত না থেকে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট কোম্পানি আইন, ২০১৩, আয়কর আইন, ১৯৬১ এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫১ তে করা সংশোধনগুলিও একই সঙ্গে বাতিল করেছে। একই সঙ্গে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে এই নির্দেশও দেয় গত ১২ ই এপ্রিল, ২০১৯ তারিখ থেকে কেনা সবরকম বন্ডের যাবতীয় বিবরন গত ৬ই মার্চ, ২০২৪ এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে জানাতে বলে, যা কমিশন গত ১৩ই মার্চ, ২০২৪ তারিখের মধ্যে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে দিতে বাধ্য থাকবে।মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের মতে ইলেক্টোরাল বন্ডের পদ্ধতিতে দেশের সাধারন মানুষের তথ্য জানার অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। স্টেট ব্যাঙ্ক কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে বন্ডের তথ্য জানাতে তাদের অপারগতার কথা জানায় এবং আগামী ৩০শে জুন, ২০২৪ পর্যন্ত সময় চায়। সাধারন বোধগম্যতার মাপকাঠিতে যেটা আপাতগ্রাহ্য সম্ভাব্য কারন বলে সাধারনভাবে প্রতীয়মান হয় তা হলো মোদী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় স্টেট ব্যাঙ্ক অন্ততঃ আগামী সাধারন নির্বাচনের আগে এই সংক্রান্ত কোনো অস্বস্তিকর খবর জনসমক্ষে আসতে দিতে রাজি নয়। যদিও মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট এই বিষয়ে অত্যন্ত কড়া মনোভাব নিয়ে স্টেট ব্যাঙ্ককে বন্ডগুলির আলফা নিউমেরিক নং সমেত যাবতীয় তথ্য অবিলম্বে প্রকাশ করতে নির্দেশ দেয়। স্টেট ব্যাঙ্কের মতে তারা যাবতীয় তথ্য নাকি নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে। এখন দেখার তা থেকে কি কি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসছে।এখানে উল্লেখযোগ্য যে ইলেক্টোরাল বন্ডের বর্তমান ব্যবস্থার পূর্বে কোনো সংস্থা ব্যবসায়ে লাভ না করলে নির্বাচনী ফান্ডে চাঁদা দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারতো না। এমনকি সর্বোচ্চ চাঁদার ক্ষেত্রেও একটা উর্ধসীমা ছিলো যেখানে কোনো সংস্থা তার বিগত তিন বছরে লাভের সাড়ে সাত শতাংশের বেশি দিতে পারতো না। পরিচয় গোপন করে চাঁদা এবং ব্যবসায়ে ক্ষতি হলেও চাঁদা দেওয়ার সুযোগ বা উর্ধসীমা না রাখার উদ্দেশ্যেই সংশ্লিষ্ট আইনগুলিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা হয়েছিলো।মোদী সরকারের প্রধান ব্যক্তব্যই ছিলো ইলেক্টোরাল বন্ডের কারনে রাজনীতিতে কালো টাকার প্রভাব কমবে, কিন্তু তথ্য যতোই সামনে আসছে, ততোই এই দাবির বিপরীত চিত্রই দেখা যাচ্ছে। যেহেতু এখনো পুরোপুরি ভাবে আলফা নিউমেরিক নং মিলিয়ে বন্ডের দাতা এবং গ্রহীতাদের পরিচয় জানার প্রক্রিয়া চলছে, তাই সাধারন ভাবে সার্বিক পরিস্থিতির বিচারে পরিচয় কেন্দ্রীক আলোচনার থেকে প্রবনতাগুলি নিয়েই আলোচনা করা বরং ফলপ্রসূ হবে।সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বন্ড ক্রেতা বা দাতাদের তালিকায় সরাসরি বড় পরিচিত তেমন সংস্থা কেউ নেই। তালিকায় সবচেয়ে বড় দাতা হিসাবে যাদের নাম উঠে এসেছে তারা বিভিন্ন সরকারি লটারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। সরকারি বিভিন্ন লটারি নিয়েই অনেক অভিযোগ শোনা যেতো এবং বর্তমানে অনেক রাজ্য লটারিই বন্ধ হয়ে গেছে। মোটা চাঁদার বিনিময়েই যে তারা লটারিগুলির দায়িত্ব পেতো, তা আজ জলের মতো পরিস্কার।তালিকায় থাকা দ্বিতীয় বড় দাতা সংস্থাটি মোটা টাকার বন্ডের বিনিময়ে দেশের বিভিন্ন বিশাল বিশাল সরকারি ঠিকাদারি কাজের বরাত পেয়েছে। এমনও অভিযোগ উঠেছে যে বিভিন্ন ঠিকাদারি সংস্থাগুলি প্রায় চার হাজার কোটি বন্ডের বিনিময়ে প্রায় চার লক্ষ কোটি টাকার সরকারি ঠিকাদারি বরাত আদায় করেছে। তেমনই আবার মোদী সরকারের আরও একটি আপাতঃ রূপ সামনে এসেছে। অভিযোগ উঠেছে এটাও নাকি দেখা গেছে যে বিভিন্ন সংস্থায় ইডি, সিবিআই এবং আয়কর হানার পরে পরেই সেই সব সংস্থা মোটা টাকার বন্ড কিনেছে, অর্থাৎ সেই সব সংস্থাকে নির্দিষ্টকরে মোদী সরকার টার্গেট করেছে যাতে তারা ভীত হয়ে এবং উপায়ান্তর না পেয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সির হানার অনতিবিলম্বেই মোটা টাকার বন্ড কিনে রেহাই পেতে চেয়েছে বা পেয়েছে। এটা আরও পরিস্ফুট হয় যখন বিভিন্ন সংস্থা লোকসানে চলা সত্বেও বন্ডের মাধ্যমে চাঁদা দিয়েছে, এমনকি এমনও দেখা গেছে কোম্পানির মুলধনের কয়েক গুন অথবা ক্ষমতার কয়েক গুন বেশি টাকার বন্ড তারা কিনেছে। সাধারন ভাবেই এটা বলা যায় ক্ষমতা বা দৃশ্যমান সম্পদের অতিরিক্ত বন্ড কিনলে তা লুকোনো সুত্র থেকেই আসার কথা এবং তাও যে এক অর্থনৈতিক অপরাধের সামিল, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।এটা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে দেশে এসবিআই এর মাধ্যমে মোটামুটি সাড়ে বারো হাজার কোটি টাকার বন্ডের যা হিসাব জনসমক্ষে এসেছে, তার প্রায় ৪৯ শতাংশই বিজেপির তহবিল গেছে, যার পরিমান ছয় হাজার কোটি টাকারও বেশি। সারা দেশের সমস্ত অন্যন্য দলগুলির হাতে বাকি ৫১ শতাংশ। এক হিসাব মতে মোট প্রায় কুড়ি হাজার কোটি টাকার মতো ইলেক্টোরাল বন্ড বিভিন্ন সংস্থা এসবিআই এর থেকে কিনেছে। এই ক্ষেত্রে আরও একটি অত্যাশ্চর্য হিসাব হলো মোট চাঁদার পরিমানে তৃনমূল কংগ্রেসের মতো একটি আঞ্চলিক শক্তি যেখানে এক হাজার ছশো কোটি টাকার বেশি পেয়েছে, সেখানে শতাব্দী প্রাচীন জাতীয় কংগ্রেসের পরিমান এক হাজার চারশো কোটি টাকার কিছু বেশি। অপরদিকে বিজেপির তহবিলে বৃহত্তর অংশ যাওয়া নিয়েইদানীং বিজেপির নেতা বা মুখপাত্ররা এক অদ্ভুত যুক্তি খাড়া করছেন। তাদের মতে যেহেতু বিজেপির লোকসভায় এমপির সংখ্যা ৩০৩ জন এবং জাতীয় কংগ্রেসের সংখ্যা ৫২ জন, তাই বিজেপি জাতীয় কংগ্রেসের থেকে ছয় গুন চাঁদা বেশি পাওয়ার হকদার। বিজেপির আরও ব্যক্তব্য হলো কুড়ি হাজার কোটি টাকার মাত্র এক তৃতীয়াংশ সোয়া ছয় হাজার কোটি টাকা নাকি বিজেপি চাঁদা হিসাবে পেয়েছে, যেখানে বিরোধী দলগুলি বাকি দুই তৃতীয়াংশ বা প্রায় চোদ্দো হাজার কোটি টাকা পেয়েছে। বিজেপির এই ব্যক্তব্য আসলে সত্যের অপলাপ মাত্র। প্রথমত, বিজেপির পাওয়া সোয়া ছয় হাজার কোটির চাঁদার হিসাব প্রায় সাড়ে বারো হাজার কোটি চাঁদার ভিত্তিতে, যা এখনও পর্যন্ত জনসমক্ষে এসেছে, কুড়ি হাজার কোটির ভিত্তিতে নয়। তাছাড়াও শুধু মাত্র এমপি কেন, একটি রাজনৈতিক দলের প্রচুর এমএলএরাও থাকেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও থাকেন। শুধএই এমপি সংখ্যার বিচারে কেন চাঁদার মানদন্ড বিচার হবে। আরও একটি সংখ্যাতত্বে এটা দেখা যেতেই পারে, যেমন গত ২০১৯ এর সাধারন নির্বাচনে বিজেপি পায় কুড়ি কোটির মতপ ভোট এবং জাতীয় কংগ্রেস পেয়েছিলো প্রায় ১২ কোটি ভোট। অর্থাৎ জাতীয় কংগ্রেস বিজেপির ষাট শতাংশ ভোট পেলেও বিজেপি জাতীয় কংগ্রেসের থেকে প্রায় ছয়শো শতাংশ ইলেক্টোরাল বন্ডের চাঁদা বেশি পায় যা দেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড” এর অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরিতধর্মী। এসবই বিজেপির আসলে হিসাব গুলিয়ে দেওয়ার হিসাব।এতক্ষন ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত সাধারন বিষয়গুলির সার্বিক আলোচনা করলাম। এবার কিছু বিশেষ এবং নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। অতি সম্প্রতি দিল্লির আবগারি নীতি সংক্রান্ত দূর্নীতির অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই একই দূর্নীতির চক্রে অরবিন্দ ফার্মা নামক সংস্থার ডিরেক্টর পি শরৎচন্দ্র রেড্ডিকেও ১০ই নভেম্বর, ২০২২এ গ্রেপ্তার করা হয়ছিলো। তথ্য বলছে এই গ্রেপ্তারির পাঁচ দিন পরেই ১৫ই নভেম্বর, ২০২২এ অরবিন্দ ফার্মা ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে পাঁচ কোটি টাকা দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই শরৎচন্দ্র রেড্ডির জামিন হয়ে যায়। পরবর্তীতে এরা এবং এদের সহযোগী সংস্থাগুলি আরো অন্ততঃ ৬২ কোটি টাকা দেয়, যার অন্ততঃ দুই তৃতীয়াংশই বিজেপির তহবিলে গেছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে দিয়ে চাপ ও ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে অগুনতি সংস্থার থেকে বন্ডের মাধ্যমে জোর করে টাকা আদায় করা হয়েছে, যা রাজনৈতিক তোলাবাজির সামিল এবং এছাড়া চাঁদার বিনিময়ে ক্ষেত্র বিশেষে বন্ডকে জামিন দেওয়ার কাজে ব্যবহার করার মতো ঘটনাগুলিতে যেখানে অন্যরা জেলে, পরিস্কার যে মুখে যাই বলা হোক না কেন, স্বচ্ছতা নয়, বিজেপির আসল উদ্দেশ্য ছিলো রাজনৈতিক ক্ষেত্রের সঙ্গে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করে বিপক্ষ দলগুলিকে পরিচালনার ক্ষেত্রে অর্থের অভাবের সমস্যায় জর্জরিত রাখা। আসলে অসাংবিধানিক ইলেক্টোরাল বন্ড মানে বিজেপির রাজনৈতিক তোলাবাজি এবং দূর্নীতি নিয়ে দূর্নীতির আখ্যান।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *