মোদী আমলে তীব্র আয়বৈষম্য পিছনে ফেলেছে বৃটিশ আমলকে

অমিতাভ সিনহা

কয়েকদিন আগে প্যারিসের স্কুল অব ইকনমিক্সের প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইনইকুলিটি ল্যাবের একটি রিপোর্টে দেখা গেছে মোদীর আমলে ভারতের মানুষের মধ্যে অসাম্য তীব্রতর হয়েছে যার ফলে তা সমাজ ও সরকারের ওপর বেশ প্রভাব ফেলেছে এবং এর ফলে দূর্বল হয়ে পড়েছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি,যেমন নির্বাচন কমিশন,সিবিআই,আয়কর দপ্তর ইত্যাদি। তাই এই সব প্রতিষ্ঠান যারা নেহেরু জমানা থেকে এই সেদিন পর্যন্ত রোলমডেল ছিল তারা আজ নিজেদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে, নিরপেক্ষ না থেকে মোদী সরকারের নিয়ন্ত্রনে চলে গিয়েছে। ভবিষ্যৎ ভারত প্লুটোক্রেসির দিকে চলে যাওয়া সময়ের অপেক্ষা বলে এই গবেষকেরা মনে করছেন। মোদী জমানার গত দশ বছর যে অন্যায় কাল তা নিয়ে কংগ্রেস প্রচার করছে তার সত্যতা এই রিপোর্ট থেকে অনেকটা স্পষ্ট। মোদী সরকারের নীতি হল ধনীদের আরো ধনী কর আর গরীবদের আরো গরীব ও মধ্যবিত্ত সমাজের বিলুপ্তিকরণ। কর্পোরেটদের মদতের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও মেরুকরণ এবং এইসব তথ্য যাতে প্রকাশ না পায় তাই মিডিয়ার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন যা গোদী মিডিয়া নামে পরিচিত। এই নীতির ফলে সাধারণ ও দরিদ্র মানুষের দিকে নজর না দিয়ে সমাজের এলিট শ্রেণীর দিকে অনেক বেশী নজর সরকারের। নেহেরু ইন্দিরা জমানায় নেওয়া কৃষিনীতির ফলে উদ্বৃত্ত চাল গম কোবিদের সময় থেকে দরিদ্র মানুষের কাছে রেশনের মাধ্যমে দিয়ে সরকার তার কর্তব্য শেষ করেছে। মোদীর প্রচার অনুযায়ী আশি কোটি মানুষের মধ্যে তা দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ দেশের অর্ধেকের বেশী মানুষ এখন দারিদ্রসীমার নীচে।এই অসাম্য এখন যে জায়গায় দাঁড়িয়েছে তা ব্রিটিশ আমলকেও হার মানায়। আসলে মোদী যে ভারতকে আবার পরাধীনতার দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন তার ঝলকানি তার পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে। স্বাধীনতার পর নেহেরু ইন্দিরা যুগে আয়বৈষম্য বা অসাম্য কমেছিল তার কারণ তখনকার রাষ্ট্রনীতি। রেল,বিমান পরিষেবা,বিমা,কয়লা,ব্যাঙ্ক,জ্বালানী তেল ইত্যাদি চলে আসে সরকারের হাতে রাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে। একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সৃষ্টি হয় এইসময়। ফলে চাকুরী তৈরী হয় প্রচুর। কর্মচারীদের জন্য তেরী হয় পে -স্কেল,প্রভিডেন্ট ফান্ড,গ্রাচুইটি,পেনসন,চিকিৎসা ভাতা,গৃহ ভাতা ইত্যাদি। ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে আস্তে আস্ত একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে। একইসঙ্গে ধনী শ্রেণীর আয়ের হার অপেক্ষাকৃতভাবে কমতে থাকে। কর্পোরেটদের কর বাড়তে থাকে।এর ফলে পরিকাঠামো তৈরী করা চলতে থাকে। সস্তায় জ্বালানী তেল,রান্নার গ্যাস,পরিবহন ব্যবস্থা,উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থার সুফল পেয়েছে প্রধানত নিম্ন আয় ও মধ্য আয়ের পরিবারগুলি।কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কংগ্রেস প্রথমবার চলে যাওয়ার পর থেকেই তদানীন্তন সরকারের নীতির ফলে অর্থনীতির অধোগতি শুরু হয়ে যায়। বিদেশে সোনাবিক্রির মত ঘটনা সেইসময়ে ঘটেছে। মূলত তার পর থেকেই সমস্যা শুরু হয়। গ্রোথ বা আর্থিক বৃদ্ধি আনতে গিয়ে ঘটলো আয়বৈষম্য। তা তীব্রতর হল মোদীর জমানায় ভুল নীতি ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের জন্য। নোটবন্দী,ভুল জিএসটি যেমন হল তেমনি মোদী ঘনিষ্ঠ হাতে গোনা ব্যবসায়ীদের অনৈতিকভাবে সুবিধা পাইয়ে দিতে গিয়ে ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে নিম্নবিত্ত শ্রেনীতে পরিবর্তন করার প্রকল্প এখনও চলছে। মনমোহন সিং এর সময় ইউপিএ সরকার এনিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত ছিল। এই অসাম্য কিভাবে কমানো যায় তার পরিকল্পনাও করেছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে মোদীর নেতৃত্বে দক্ষিনপন্থী বিজেপি সরকার অসাম্যবৃদ্ধিকে আমল না দিয়ে বা এর কুফল বোঝার অক্ষমতার জন্য নেহেরুকে সকালে বিকালে গালাগাল দেওয়াটাকে তাদের নীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে।কি আছে এই রিপোর্টে?পারিবারিক আয় সংক্রান্ত তথ্যের ওপর নির্ভর করে ভোগব্যায় কতটা তা বোঝা যায়।এই তথ্য সংগ্রহ করত জাতীয় নমুনা সংস্থা। মোদী সরকার এই সংস্থাটিকে কাজ করতে দিচ্ছে না কারণ ২০১৬-১৭ সালে যে পারিবারিক ভোগব্যায় সংক্রান্ত যে সমীক্ষাটি তৈরী করে তা মোদীবাবুদের পছন্দ হয় নি, ফলে তা সরকারী অনুমোদন পায় নি।সম্ভবত তারা ঐ সমীক্ষাটি পাল্টিয়ে মোদীর মনোমত তৈরী করতেও চায় নি। তবে সেই সমীক্ষা থেকে পারিবারিক আয়বিন্যাস করার চেষ্টা করেছিলেন টমাস পিকোটি ( প্যারিস) ও লুকাশ চ্যানসেল( হাভার্ড কেনেডী স্কুল)।তাদের রচিত প্রবন্ধ Indian Income Inequality 1922-2015 from Britishraj to Billionireraj এ এবিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা আছে। এবারেও এই দুইজন অর্থনীতিবিদ ছাড়াও আনমোল সোমাঞ্চি,নিতিনকুমার ভারতী( নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়) এই গবেষণাপত্রটি তৈরী করেছেন। তাদের বক্তব্য ১৯৮০ এর পর থেকে অসাম্য কিছুটা বাড়লেও ২০১৪-১৫ সাল থেকে ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত ভারতে অসাম্য বা আয়বৈষম্য তীব্রভাবে উর্দ্ধগতিতে বেড়েছে। দেশের মোট আয়ে ধনীতম ১ শতাংশের হাতে ২২.৬ শতাংশ ও দেশের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশের বেশী তারা ভোগ করছে। নীচের সারির ৫০ শতাংশ ও মাঝের সারির ৪০ শতাংশ মানুষ বঞ্চিত থেকে গেছে। শেষ সারির ৫০ শতাংশের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ। বিত্তশালী ১ শতাংশ মানুষের গড় আয় বছরে ৫৩ লক্ষ টাকা ও ভারতীয়দের গড় আয় ২.৩ লক্ষ টাকা; অর্থাৎ বিত্তশালীদের আয় গড়পরতা ভারতীয়দের আয়ের ২৩ গুণ। আবার নীচের ৪০ শতাংশ মানুষের গড় আয় মাত্র ৭১ হাজার টাকা ও মাঝের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের গড় আয় ১.৬৫ লক্ষ টাকা। আবার সব থেকে ধনী দশহাজার ব্যক্তির গড় আয় বছরে প্রায় পঞ্চাশ কোটি টাকা। গড়পরতা ভারতীয়দের চেয়ে তা দুইহাজার গুণেরও বেশী।শিক্ষা,স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিবর্তন এর কারণ বলে তারা মনে করছেন। সরকারী হাসপাতালের উন্নতির বদলে আয়ুষ্মান ভারত বীমা প্রচলন কখনও বিকল্প হতে পারে না। এর ফলে কোবিদের সময় হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। ভারতে এখন এক আধুনিক বুর্জোয়াশ্রেণীর রাজত্ব বা বিলিওনেয়াররাজ চলছে বলে তাদের মত। এর ফলে ধনিকশ্রেণী বা প্লুটোক্রেসির মুখে ভারত বলে তারা মনে করছেন। এটা কায়েম হলে ধনীশ্রেণী দেশ শাসন করবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে। অক্সফ্যামের রিপোর্টে গত কয়েক বছরে,বিশেষ করে কোভিদের পর ভারতে কিভাবে ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে আয়ের ব্যবধান বেড়েছে তা পেশ করা হয়েছে।কিন্তু তা নিয়ে কোন পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা সরকার রামমন্দির, বিশাল স্ট্যাচু, বহু আসন বিশিষ্ট সংসদ ভবন বা সেন্ত্রাল ভিস্তার মত কম প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করেছে স্বাস্থ্য পরিষেবাতে নজর না দিয়ে।যখন হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছিলেন না বা নদীর ধারে সারিবদ্ধ মৃতদেহ পোড়ানো চলছে বা নদীতে ভেসে আসছে মৃতদেহের সারি তখনকার অবস্থা মনে রেখে নীতি ঠিক করা সরকারের আশু কর্তব্য ছিলনা কি?কিভাবে মাপা হয় আয় বৈষম্য?বেশ কয়েকটি সূচক থাকলেও সবচেয়ে সহজ ও আধুনিক সূচকটি জিনি সূচক নামে পরিচিত। কোরাডো জিনি এর স্রষ্ঠা। এইসূচকের মান যদি শূণ্য (০) হয় তখন বুঝতে হবে অসাম্য প্রায় নেই। আবার তা যদি এক(১) হয় তাহলে সেখানে সর্বোচ্চ অসাম্য বিরাজ করছে। ১৯৫১ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত পারিবারিক আয়ের বিন্যাসে এই বৈষম্য কমে এসেছিল।১৯৫১ সালে জিনি সূচকের মান ছিল ০.৪৬৩ ও ১৯৮০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ০.৩৯৬। ২০১৪-১৫ সালে তা ছিল ০.৪০২।*মোদীর আমলে এই সূচকের মান বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ০.৬৩২। এর অর্থ দেশে অসাম্য বেড়েছে ১৯৮০ সালের চেয়ে।আবার ১৯৫০-১৯৮০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ নেহেরু ইন্দিরার আমলে দেশে পারিবারিক প্রকৃত আয় (মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে আয় বৃদ্ধি বাদ দিয়ে) বৃদ্ধি পেয়েছিল ৬৫ শতাংশ*।এই তথ্যগুলি সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে ভীতিপ্রদ।ধনিকতন্ত্র কায়েম হলে কি অবস্থা হয় তা পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলেই মালুম হবে। দীর্ঘদিন ধরে লালন করা সাধের গণতন্ত্র শুধু বিসর্জন দেওয়া হবে তাই নয়। সাধারণ মানুষের বাকস্বাধীনতা শেষ হওয়ার চেয়ে বড় কথা যে আমরা, দেশের গুটিকয়েক ধনীশ্রেণী ছাড়া বাকি ৯৯ শতাংশ মানুষ ক্রীতদাসে পরিণত হবে। তাই উক্ত অর্থনীতিবিদেরা চিন্তিত।তারা এই আয়বৈষম্য কমানোর কয়েকটা রাস্তাও বাতলেছেন। তারা মনে করেছেন দেশের ১৬৭ টি বেশীধনী পরিবারের ওপর দুই ( ২) শতাংশ সম্পদকর বসানো। এই করের টাকা শিক্ষা,স্বাস্থ্য, পুষ্টিতে খরচ করা হোক।কিন্তু মোদীসরকার তা করলে যে তাদের ব্যর্থতা প্রমানিত হবে তাই নয় তার ব্যবসায়ী বন্ধুরা কুপিত হবে। তাদের টাকাতেই বিজেপির পাঁচতারা অফিসগুলি চলছে।নেতারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিতে বিধায়ক কিনে ক্ষমতায় আসা, সবই বন্ধ হয়ে যাবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *