শান্তনু দত্তচৌধুরী
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং গত ১৪ জুন ‘অগ্নিপথ স্কিম ‘ এর কথা ঘোষণা করেন।এই স্কিম অনুযায়ী এখন থেকে ১৭ থেকে ২১ বছরের যুবকরা স্থল , নৌ ও বিমান বাহিনীতে যোগে দেবার জন্য আবেদন করতে পারবেন।এতদিন যোগদানেচ্ছু যুবকদের যেমন পরীক্ষা হত, সেরকম পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে যোগ দেবেন।তবে তাঁদের মাত্র ৬ মাসের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন মোদি সরকারের বহু ঘোষিত কর্ম সংস্থানের জন্য ঘোষিত দিনদয়াল উপাধ্যায় গ্রামীন কর্মকৌশল যোজনায় নিরস্ত্র বেসরকারি গার্ডের চাকরীর প্রশিক্ষণ ৬ মাসের। তাহলে বোঝা যাচ্ছে সামরিক বাহিনীকে মোদি – শাহরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন।
যারা এই নতুন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিতে যোগ দেবেন , তারা হচ্ছেন ‘ অগ্নিবীর।’ তাদের চাকরি হবে চার বছরের জন্য। তারপর তাদের মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগ অগ্নিবীর অবসর নেবে।২৫ ভাগ পর্যন্ত সেনা বাহিনীতে থাকতে পারে। অবসরের পর এদের কোনও পেনশন থাকবেনা, থাকবেনা মেডিক্যাল সুযোগ।এরা এককালীন ১১ লক্ষ টাকা পাবে, যার মধ্যে ৫ লাখ টাকা এদেরই বেতন থেকে কেটে নেওয়া। এই হচ্ছে ‘ অগ্নিপথ ‘ স্কিম। এই অদ্ভুত স্কিম ঘোষণা হওয়া মাত্র দেশ জুড়ে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। সারা দেশ জুড়ে যুবকরা প্রবল বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে।
কিন্তু প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী সেই থেকে নীরবতা অবলম্বন করে চলেছেন। বহু অবসরপ্রাপ্ত বর্ষীয়ান সেনানায়ক ও বহুযুদ্ধের নায়করা এই স্কিম সেনাবাহিনীর সংহতি, দক্ষতা, উৎকর্ষতা ও শৃঙ্খলার চরম ক্ষতি করবে বলে জোরালো মত প্রকাশ করেছেন। সেনাবাহিনিতে দুধরণের সৈন্য থাকবে , নিয়মিত ও অস্থায়ী সৈন্য। সৃষ্টি হবে বৈষম্য।দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের গ্রাম সমাজেও ব্যাপক অসন্তোষ ও অস্থিরতা তৈরি হবে। গ্রাম ভারতের নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র ঘরের বিরাট সংখ্যক যুবক সেনাবাহিনীতে যাবার স্বপ্ন দেখে।সেই জন্য কঠোর পরিশ্রম করে তারা নিজেদের প্রস্তুত করে। সেই স্বপ্নের ওপর বিশাল আঘাত এই জনবিরোধী ও দেশবিরোধী ‘ অগ্নিপথ ‘ স্কিম। যারা গ্রামীণ ভারত থেকেসেনাবাহিনীতে যোগ দেয় তাদের মধ্যে এক বিরাট অংশ আবার আসে দলিত , পিছড়ে বর্গ , আদিবাসী ঘর থেকে। কোভিড অতিমারীর অজুহাতে গত ২০২০ ও ২০২১ সালে নৌ , স্থল , বিমান কোনো বাহিনীতে কোনো রিক্রুটমেন্ট হয়নি। যদিও দেশে নির্বাচন হয়েছে , বড় বড় মিটিং হয়েছে, কিছুই আটকায় নি। শুধু তাই নয় ,২০১৮ -১৯ এ নিয়োগের জন্য বিমান বাহিনী ৭০০০ জন যুবককে নির্বাচিত করেছিল , তাও বাতিল বলে এয়ার মার্শাল এস.কে.ঝা জানিয়েছেন।এক নির্দয় সিদ্ধান্ত।
বর্তমানে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল সর্বদা সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষাকে নিজেদের দলীয় স্বার্থ সিদ্ধির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। সে পাক সীমান্তের উরি, বালাকোট, পুলওয়ামা সব ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি কেন্দ্রের শাসক দল কিভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ সৃষ্টি করে। পাক সীমান্ত বলে ধর্মকে জড়িয়ে দেওয়ার সুযোগও তারা কাজে লাগায়। তবে লাদাখের গালওআন উপত্যকায় চীনা সেনার আক্রমণে নিহত কর্নেলসহ ২২জন সেনার মৃত্যু নিয়ে মোদি নিশ্চুপ ছিলেন।চিনের নামও তিনি উচ্চারণ করেননি।প্রতিবাদ তো দূরের কথা।
এখন অগ্নিপথ নিয়ে তীব্র বিক্ষোভ প্রশমনের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিজেরা সামনে না এসে নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল তথা প্রতিরক্ষা বিভাগের এডিশনাল সেক্রেটারি অনিল পুরিকে দিয়ে ১৯জুন সাংবাদিক সম্মেলন করান। এইভাবে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে সেনাবাহিনীকে জড়ানো হল।ওই সাংবাদিক বৈঠকে অনিল পুরি বলেছেন “করোনা অতিমারী, আমাদের কাছে সাপে বর, ভগবানের দান।” শ্রী পুরির মতে এই অতিমারীর ফলে তারা দুবছরের বেশি সময় সমস্ত নিয়োগ বন্ধ রাখার সুযোগ পান।এই সময়ে তাঁরা এই ‘অগ্নিপথ’ স্কিমের পরিকল্পনা করতে পেরেছেন।এর ফলে তাঁরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর গড় বয়স কমিয়ে ২৫ এ নিয়ে আসতে পারবেন। একেই প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন ” সঙ্কটের মধ্যে সুযোগ খোঁজা।” ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির সংকটের বোঝা সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। এদিন লে.জেনারেল অনিল পুরি তাঁদের মতন বর্ষীয়ান অফিসারদের অবসর গ্রহণের বয়স কমানোর বিষয়ে অবশ্য কিছু বলেন নি। প্রাক্তন চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত , যিনি কিছুদিন আগে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন , তিনি এই ভাবে সেনাদের বয়স কমানোর তীব্র বিরোধী ছিলেন।অনিল পুরি এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকরীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন প্রত্যেকের ক্ষেত্রে পুলিস রিপোর্ট নেওয়া হবে।
এই ‘অগ্নিবীর’ দের বিরাট অংশকে (চার ভাগের তিন ভাগ )অবসর নিতে বাধ্য করা হবে। পেনসনও দেওয়া হবেনা।সরকারের বিপুল খরচ বেঁচে যাবে। ট্রেনিংও মাত্র ছয় মাসের।তাতেও ব্যায় কমবে। তাই দিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনা যাবে। এটাই অন্যতম লক্ষ। প্রধানমন্ত্রীর ” সঙ্কটে সুযোগ খোঁজা।” অস্ত্র আমদানির বরাত কোনও একজন ক্রোনি পাবে। কিন্তু ৬ মাস ট্রেনিং নেওয়া এই ‘অগ্নিবীর’ রা ওই সব অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন তো? যে সব অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে ও দক্ষ হতে অন্তত চার বছর সময় লাগে। এক সময় দেখা যাবে ভারতীয় সেনা মানেই ৬ মাসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ওই অগ্নিবীর। যারা অবসর নিতে বাধ্য হবে তাদের জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা ও আধা সামরিক বাহিনীতে সংরক্ষণ রাখা হবে বলে জানানো হয়েছে।যদিও এখন পর্যন্ত ওই সব সংস্থায় প্রাক্তন সেনাদের নিয়োগের চিত্র খুবই হতাশজনক।
ভারতীয় সেনা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম সুশৃংখল ও দক্ষ সেনা। এই ‘ অগ্নিপথ ‘ স্কিমের ফলে সেনাবাহিনী চরম ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে বহু প্রাক্তন সেনাকর্তা ও War Hero মতপ্রকাশ করেছেন। যাঁদের মধ্যে অন্যতম ১৯৮৭ সালে সফল সিয়াচেন গ্লেসিয়ার অভিযানের নায়ক একমাত্র জীবিত ‘ পরমবীর চক্র ‘ বানা সিং। তিনি কারও সঙ্গে কোনও আলোচনা না করে এই ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে চরম অগণতান্ত্রিক বলেছেন।তিনি বলেছেন “এই স্কিম ভারতীয় সেনাকে ধ্বংস করে দেবে ও উপকৃত হবে চীন ও পাকিস্তান।”
মোদি সমস্ত ক্ষেত্রে যা করেন, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় , এই রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদে ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে , একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ , এক্ষেত্রেও তাই করেছেন।
এই স্কিম অনুযায়ী অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের তাঁদের কোম্পানিতে ভবিষ্যতে নিয়োগ করবেন বলে আনন্দ মাহিন্দ্রা টুইট করেন। সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে কিছু ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট বা স্বজনতোষী পুঁজিবাদীরাও বিবৃতি দেন।এর
পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ এর War Hero প্রাক্তন নৌ প্রধান এডমিরাল অরুণ প্রকাশ টুইট করে জানতে চান ” মি. মাহিন্দ্রা আজ পর্যন্ত আপনার কোম্পানিতে আপনি কত জন প্রাক্তন সেনাকে চাকরি দিয়েছেন ? কোন পোস্টে ? কি তাদের বেতন একবার জানাবেন কি?” একই প্রশ্ন করেছেন প্রাক্তন এয়ার ভাইস মার্শাল মনমোহন বাহাদুর। এর কোনো উত্তর এই ক্রোনিরা দিতে পারেন নি।
তবে ক্ষমতাসীন দলের কৈলাশ বিজয়বর্গীও বলেছেন অগ্নিবীররা পার্টি অফিসের নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ পাবেন।মধ্য প্রদেশের একজন নেতা বলেছেন, অগ্নিবীররা চার বছর দেশ রক্ষার কাজ করে ঘরে ফিরে বিধর্মীদের হাত থেকে পরিবার রক্ষা করবেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ভাঙচুর করে সঙ্ঘ পরিবার নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধি করতে চাইছে। এই কাজই ইতালি ও জার্মানিতে মুসোলিনি ও হিটলার করেছিল। ফ্যাসিস্ট আক্রমণ সংগঠিত করতে তারা সেনাবাহিনী থেকে বার করে এনে “ব্ল্যাক শার্ট ও ব্রাউন শার্ট ” সশস্ত্র মিলিশিয়া গঠন করেছিল। তারই পুনরাবৃত্তি কি এই দেশে হতে চলেছে? এখন এই অগ্নিপথ নামক ধ্বংস থেকে ভারতীয় সেনা , গণতন্ত্র ও যুবসমাজকে রক্ষার দায়িত্ব সমগ্র দেশবাসীর।