প্রদীপ ভট্টাচার্য (সাংসদ এবং প্রাক্তন সদস্য, কেন্দ্রীয় জুট বোর্ড)
পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ সহ আরো কিছু ছোট ছোট রাজ্যে পাটসংকট ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে। এর কারণগুলি ময়নাতদন্ত করলে আমরা দেখব এই সংকটের জন্য মূলত দায়ী রাষ্ট্রের অনীহা এবং অপরিণামদর্শীতা।
পাট চাষীদের যে পরিমাণে উৎসাহ এবং সহযোগিতা দান করা রাষ্ট্রের কর্তব্য ছিলো, তা গত দশ বছরে তলানিতে এসে পৌঁছেছে। আমাদের রাজ্যেও দীর্ঘদিন ধরে সেই একই অবস্থা। পাট চাষীরা তাঁদের পাটের জন্য ব্যারেল পিছু ন্যূনতম সহায়ক মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং যে পরিমাণ টাকা পাওয়ার দরকার তা পাননা। ফলতঃ আমাদের রাজ্যে হুগলি, নদীয়া, কোচবিহারের মতো জেলাগুলিতে যেখানে পাট চাষ হতো, সেখানকার অধিকাংশ পাট চাষী পাট চাষ থেকে সরে এসে ধান চাষ করছেন। কারণ একটাই ধান চাষে বেশি লাভ এবং পাটের বাজার নেই। ঠিক এখানেই রাষ্ট্রের দায় বর্তায়। পাট কিনবে কে? এখানে সরকারকেই ক্রেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।
মোদি সরকারের আমলেই আমি যখন জুট বোর্ডের সদস্য ছিলাম তখন বারম্বার বিভিন্ন আলোচনায় পাট-চাষে আধুনিকীকরণের উপর গুরুত্ব দেওয়ার আবেদন জানিয়ে এটাও বলেছিলাম যে, সরকারের উচিত একটা সম্পূর্ণ পৃথক এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করা; পাট চাষীদের কাছ থেকে যথাযথ সহায়ক মূল্য প্রদান করে পাট কেনার কাজ সুচারু ভাবে সম্পন্ন করা এবং পাট চাষীরা যাতে সব দিক থেকে লাভবান হন তা দেখাই হবে সেই এজেন্সির মূল কাজ। এতে পাট চাষীরা উৎসাহ পাবেন এবং লাভের মুখও দেখতে পাবেন। কিন্তু মোদি সরকার সে কথায় কান দিলেন না!
পাট কেনার দায়- দায়িত্ব কাদের? আমরা লক্ষ করি যে, একদল ফোড়ে কম দামে চাষীদের কাছ থেকে পাট কিনে চড়া দামে মিল মালিকদের কাছে বিক্রি করে এবং কোথাও কোথাও মিল মালিকরা আগাম দাদনের ভিত্তিতে সরাসরি কম দামে চাষীদের কাছ থেকে পাট কিনে নেয়। অর্থাৎ এখনো সেই দাদন প্রথা থেকে কৃষকদের আমরা মুক্তি দিতে পারিনি। কেন্দ্রীয় সরকার আজও সেই দাদন প্রথা বন্ধ করার ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি।
সারা বিশ্বে কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণের উপর আজ জোর দেওয়া হচ্ছে। সেখানে পাট চাষের আধুনিকীকরণের এবং পাট জাত দ্রব্য উৎপাদনের বহুমুখীকরণের অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্র সরকার সম্পূর্ণ উদাসীন। আজকের দিনে শাড়ি, ভালো পর্দা, জামা-কাপড়, বিছানার চাদর প্রভৃতি তৈরি করতে জুট-ফাইবার সারা বিশ্বে আজ ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে জুট মিলের মালিকরা প্রধানত জুটের বস্তা উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছেন। এই ব্যাপারগুলিতে নজরদারি করে পাট চাষে অগ্রগতি আনা যাদের প্রধান কাজ, সেই জুট কমিশনার আশ্চর্যজনক ভাবে আজ নিস্ক্রিয়।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, সে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকারের জুট-মন্ত্রক হোক বা আমাদের রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী, পাট মন্ত্রী কিম্বা মুখ্যমন্ত্রী সকলেই পাট চাষ ও পাট-শিল্পকে ব্রাত্য করে রেখেছেন। অথচ পাট শিল্প হলো আমাদের দেশের একটা বৃহৎ শিল্প-ক্ষেত্র, যেখান থেকে প্রচুর আয়ের সম্ভাবনা আছে ; শুধু তাই নয় পাট চাষে আধুনিকীকরণ এবং পাট শিল্পের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে বিশ্বের বাজারে ভারতের পাটের একটা ভালো বাজার তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু এই পাটের জন্য বিশ্বের বাজারে একটা ক্ষেত্র তৈরি করার কোনো পরিকল্পনা এবং উৎসাহ আমরা অন্তত কেন্দ্রীয় সরকারের দিক থেকে দেখতে পাচ্ছি না।
বর্তমানে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ভাবে একটা অংশের মিল মালিকরা এবং উচ্চ পদস্থ আমলারা মনে করেন যে, জুট শিল্পের কোনো ভবিষ্যৎ নেই ; তাঁদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত কেবল নয়, সাথে সাথে এটাও সত্যি যে ওই সব চিন্তাভাবনার পিছনে আছে সিন্থেটিক ও প্লাস্টিক লবির একটা চক্র এবং চক্রান্ত! পাট চাষ এবং পাট শিল্পের উন্নতি সাধনের জন্যে ওই চক্র কে ভাঙার কাজ শুরু করতে হবে রাষ্ট্রকেই।