অশোক ভট্টাচার্য ( রাজা)’র বিশেষ প্রতিবেদন, ১৩ অগাস্টঃ
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ভাবনার সূচনাটা ছিলো মূলতঃ জহরলাল নেহেরুর। পৃথিবীর তদানীন্তন দুই মেরু শক্তির কোনোটারই সাথে জোটবদ্ধতা কিম্বা জোট নিঃসঙ্গতা কোনো পথেই না হেঁটে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে নিয়ে জোট বেঁধে, নিজেদের স্বার্থ রক্ষাই ছিলো এর মূল উদ্দেশ্য।
মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদুল নাসের, যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা জোসেফ ব্রোজ টিটো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, ঘানার কাওয়ামে ক্রুমাহ এবং ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি আহমেদ সুকর্ণ মূলত এই পাঁচজন বিশ্বনেতাদের উদ্যোগে যে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ভাবনা তৈরি হয়েছিলো তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে যে দুজনের ভূমিকা ও অবস্থান অবিস্মরণীয় তাঁরা হলেন ফিদেল কাস্ত্রো এবং ইন্দিরা গান্ধী।
মেরুকরণের শ্বাসরোধী আবহের মধ্যে স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নেওয়ার আকাশ খোঁজার জন্য মুক্তির পথ সন্ধানই ছিলো জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মূল লক্ষ।
উপনিবেশবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্ত অবস্থানে বরাবরই অনড় ছিলেন নেহরু। জোট নিরপেক্ষ থাকা মানে এই নয় যে, নিজের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার প্রশ্ন যেখানে উঠবে, সেখানে নিরপেক্ষ থাকতে হবে! সেখানে পক্ষ অবলম্বন অবশ্যম্ভাবী, এমন মনোভাব স্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত করতেন নেহরু। ঠিক এখান থেকেই ফিদেল কে দ্যাখার চেষ্টা করব আমরা।সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কালে কিউবার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা স্বত্বেও সোভিয়েত সাহায্যই টিকিয়ে রেখেছিলো কিউবাকে, কিন্তু তারপরও কাস্ত্রো গভীরভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন নবগঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে। কেন?
উত্তর একটাই। মেরুকরণের নিঃশ্বাস বন্ধকারী পরিবেশের মধ্যে থেকেও বিকল্প আকাশের সন্ধান ; যেখানে নিজের অস্তিত্ব স্বাধীনভাবে বজায় থাকবে।
আজ যখন আমাদের দেশ কিম্বা সারা বিশ্বতেই নব্য জাতীয়তাবাদের নামে উগ্র মেরুকরণের প্রচেষ্টা, যখন পোস্ট ট্রুথ পিরিয়ডের মাঝে দাঁড়িয়ে অাবছা অন্ধকারে সকলকে অর্ধসত্য জানানোর রেওয়াজে সবটা গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তখন সামগ্রিকভাবে বিকল্পের খোঁজ দেওয়ার মতো কোনো মুখ নেই ফিদেল কিম্বা ইন্দিরার মতো।
ইন্দিরার পরে এই ধারাকে বজায় রেখেছিলেন রাজীব। কিন্তু ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান, সোভিয়েত পতন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনকে স্তিমিত করে ; তার আরো অনেক প্রেক্ষিত আছে যা অন্যত্র আলোচনা করে যাবে কখনো।
এই বিকল্পের ভাবনাতো আজ সময়ের দাবি, আমাদের দেশেও। এদেশেও আজ তীব্র মেরুকরণের বিষ; বলা যায় ধর্মীয় বিভাজনের রেখা গেঁথে দেওয়া হচ্ছে। হয় তুমি এ’দিকে থাকো না’হলে ওদিকে! এর বাইরেও স্বাধীন ভাবনা-বেঁচে থাকার বিকল্প ভাবনা থাকে; কিন্তু সেই ভাবনাকে ঐক্যবদ্ধ একটা নিটোল রূপ দিতে কোথাও আমরা ব্যর্থ। সমগ্র বিশ্বের দিকে তাকালেও একই ছবি।
একটা ঘটনার কথা এখানে না বললেই নয়। গত শতকের আটের দশকের শুরু এবং ন’য়ের দশকের শুরুতে গর্ভাচেভের নেতৃত্বাধীন রাশিয়া কিউবা থেকে আর চিনি কেনার ব্যাপারে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে, কিউবার অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয় ঘনিয়ে আনার কাজটা ত্বরান্বিত করে। বিকল্প ভাবনার খেসারত এভাবেই দিতে হয়, সে এখানেই হোক কিম্বা ওখানে, ছবিটা চিরকালের। তবু ফিদেলকে তাঁর দৃঢ় ‘জোট নিরপেক্ষ’ অবস্থান থেকে সরানো যায়নি। এমন খেসারত নেহরু থেকে ইন্দিরা অনেককেই দিতে হয়েছে অনেকভাবেই; কিন্তু সেই ছবিতে অসহায় আত্মসমর্পণের কোনো পর্ব ইতিহাসের পাতায় লেখা নেই।
আজ ঠান্ডা যুদ্ধ নেই ; একমুখী মেরুকরণের আগ্রাসন আরো ভয়ংকর, আরো স্পষ্ট। পাশাপাশি ট্রাম্পের পা’য়ে হাতে গোণা কতিপয় রাষ্ট্রনেতা বাদ দিয়ে অন্য সবার সাথে সাথে আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও অসহায় আত্মসমর্পণের ছবি সবাই দেখেছে।
সেদিন ট্রাম্পের আমেরিকা থেকে জিং পিং -এর চিনের পা’য়ে মোদি সাহেব আত্মসমর্পণ করে চলেছেন; বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার ভাবনা তো দূর অস্ত! কারণ, মোদি তো আর জহরলাল কিম্বা ইন্দিরা নন।
এই অবস্থায় নেহরু থেকে ইন্দিরা এবং ফিদেল স্মরণ তখনই সার্থক হবে, যখন শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ বিকল্প শক্তির ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য আমরা নিজেদের একশ শতাংশ নিয়োগ করতে পারব।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
( ছবিঃ সংগৃহীত)