অমিতাভ সিংহের বিশেষ প্রতিবেদন, ১৮ অক্টোবর’২২ঃ
১৭ অক্টোবর নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচন হয়ে গেল।কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনের দিকেই সারা দেশের নজর। একই সময় কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত কংগ্রেসের ভারত জোড়ো যাত্রা চলছে। এই দুই কর্মসূচি গ্রহণ করায় কংগ্রেস এখন দেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে প্রধান আলোচ্য শক্তি বা দল। ভারত জোড়ো যাত্রা ইতিমধ্যেই ১০০০কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে। রাহুল গান্ধি এই যাত্রায় একজন পদযাত্রী।
সভাপতি পদের জন্য এই নির্বাচনে সাংসদ শশী থারুর ও রাজ্যসভায় কংগ্রেস তথা বিরোধী দলের নেতা মল্লিকার্জুন খারগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
যে গদি মিডিয়া ও বিজেপি কংগ্রেসের নির্বাচন ও তথাকথিত পরিবারবাদ নিয়ে সোচ্চার ,তারা দেশের আর কোনও রাজনৈতিক দলে আদৌ নির্বাচন হয় কিনা তা অবশ্য জানাতে পারেন নি।বিজেপি, ডি.এম.কে এ.আই.এ.ডি.এম.কে , টি.এম.সি, বি.জে.ডি, আরজেডি, জনতা দল (এস ), আপ, আকালী, অগপ, শিবসেনা,এনসিপি এর মত কত দলই তো আছে দেশে।এই দলগুলিতে কখনো নির্বাচন হয় বলে কেউ শুনেছেন? এই দলগুলি প্রায় সবকটিই এক বা দুই পুরুষের পরিবারভিত্তিক দল। এদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে বিজেপির মধুর সম্পর্ক।
এদিকে বিজেপি আর যদি মিডিয়ার চিন্তার শেষ নেই কংগ্রেসের নির্বাচনের ব্যাপারে।বি.জে.পি দলে কেউ কখনো সভাপতি পদে নির্বাচন হয়েছে শুনেছেন? এই দল গর্ব করে বলেছে তাদের দলে গত ২০ বছরে অন্তত ৭ জন সভাপতি হয়েছেন। নির্বাচনের মাধ্যমে ? অবশ্যই নয়। এরা এসেছেন নাগপুর ( আরএসএস সদর) কর্তৃক মনোনীত হয়ে। তবে এখন তো আরএসএস নয়, স্বয়ং নরেন্দ্র মোদির কথাতেই দলের সভাপতি ঠিক হয়। কর্পোরেট পুঁজির খেল। এখন সঙ্ঘপিতাদের ধামাধরা লোকজনেরা ও গোদী মিডিয়াও বড় উদ্বিগ্ন কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন নিয়ে।তারা আবার পরিবারতন্ত্র নিয়ে প্রশ্নও তুলছে।তারা তো জগমোহন বা নবীন পট্টনায়ক অথবা মায়াবতী, অখিলেশ যাদবকে নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলছে না।কেন?
কংগ্রেসের একটি সুস্পষ্ট গঠনতন্ত্র আছে। স্বাধীন নির্বাচনী ব্যবস্থা আছে। নির্বাচন কমিশন আছে । ভোটার তালিকা ও পরিচয় পত্র আছে। এসব থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেসে কেনো এতোদিন ২০ বছর নির্বাচন হয় নি? তার কারণ , কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। কংগ্রেসিরা চেয়ে এসেছে নেহরু – গান্ধি পরিবার তাদের ভোট বৈতরণী পার করাবেন। কিন্তু তা হল না।এবার রাহুল গান্ধি যদি ধনুক ভাঙা পণ না করতেন যে তিনি ও তাঁর পরিবারের কেউ কংগ্রেস সভাপতি হবেন না , তাহলে আবারও তাঁদেরই দায়িত্ব নিতে হত। এখন নির্বাচন হচ্ছে। গান্ধিরা ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চান গদি মিডিয়া ও বিজেপির এই মিথ্যা প্রোপাগান্ডাও আর চলবে না।
আর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চাওয়ার অভিযোগ ? ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধি নিহত হওয়ার পর সোনিয়া গান্ধি তো শত অনুরোধেও প্রধান মন্ত্রী হন নি।তিনি রাজনীতিতেও আসেন নি।১৯৯৮ তে কংগ্রেসের বিপর্যয়ের পর তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে আসেন ও অক্লান্ত পরিশ্রম করে ২০০৪ সালে বাজপেয়ী – আদবানির নেতৃত্বাধীন সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে হটান। কিন্তু সোনিয়াজি না হলেন প্রধানমন্ত্রী , না নিতে দিলেন রাহুলকে কোন মন্ত্রিপদ।
নেহেরু গান্ধি পরিবার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।তাঁদের পরিবার ছিল কংগ্রেস তথা জাতীয় আন্দোলনের একটা স্তম্ভবিশেষ। তাঁদের ছিল এক বিচারধারায় বিশ্বাস যা দেশের পক্ষে মানুষের পক্ষে।সঙ্ঘ পরিবারের তার এক ভগ্নাংশও নেই। নেহেরু পরিবার জাতীয়তাবাদী , অন্তর্জাতিকতাবাদী , সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী , স্বয়ম্ভর অর্থনীতির প্রবক্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষক। আর এরা অর্থাৎ আরএসএস ও হিন্দু মহাসভা জাতীয় আন্দোলনকে পেছন থেকে ছুরি মেরেছিল।জাতীয় আন্দোলনে বা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের ভূমিকা একটা বড় *শূণ্য*। জওহরলাল নেহরু ১০ বছর কারাবাস করেছেন। তাঁর পিতা মাতা দুজনেই কারাবাস করেছেন। সুভাষচন্দ্র তাঁর ‘ভারতের মুক্তি সংগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছেন জওহরলালের মা স্বরূপরাণী নেহরুকে ব্রিটিশ পুলিশ কী নির্মমভাবে এলাহাবাদের রাজপথে প্রহার করেছিল। ভগ্নিপতি রণজিৎ পন্ডিত লখনৌ জেলে বন্দী দশায় মারা যান।
তাছাড়া স্বাধীনতার পর দেশকে গড়ার কাজে নেহেরু,ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধীর ভূমিকা ও নেতৃত্বদানের কথা দেশের মানুষ জানেন। ইন্দিরা গান্ধি ও রাজীব গান্ধি দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।বি.জে.পি চায় এইসব ইতিহাস মুছে নতুন এক মিথ্যা ইতিহাস তৈরী করতে।তাদের ধারণা একদিন হয়ত এই গোয়েবলসীয় কায়দায় প্রচার চালিয়ে দেশের মানুষকে নেহেরু গান্ধি পরিবারের কথা ভোলাতে পারবে।ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে একটা মিথ্যা সব মানুষকে চিরকালের মত বিশ্বাস করানো যায় না, যায় নি, যাবেও না।
তারা জানে যতদিন এই পরিবার কংগ্রেস দলটির হাল ধরে থাকবে বা জড়িয়ে থাকবে ততদিন মিথ্যার বেসাতি বেশীদিন করে টিকে থাকা যাবে না। ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা সবে শুরু হয়েছে তাতেই ত্রাহি ত্রাহি রব শোনা যাচ্ছে। তারপর পাঁচ মাস পরে তা শেষ হওয়ার পর যখন অন্যান্য রাজ্যগুলিতে আবার নবপর্যায়ে তা শুরু হবে তখন কি অবস্থা হবে গেরুয়া শিবিরে তা নিয়ে মোদী শাহ ও তাদের দুই ব্যবসায়ী পরিবার বড়ই উদ্বেগে আছেন।
মনে রাখতে হবে দেশকে যেভাবে এই আট বছরে কর্পোরেট পুঁজির মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে , দেশে যেভাবে ঘৃণার বাতাবরণ সৃষ্টি করা হয়েছে কংগ্রেসের পুনরুত্থানই পারে তা রোধ করতে।