শুভাশিস মজুমদার
বিগত চার বছর ধরে দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের অধীনে ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনায় থাকা অবস্থায় বিনা এফ আই আর – এ কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধি এবং সাংসদ রাহুল গান্ধিকে সমন পাঠিয়ে ইডি দফতরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানোর প্রতিবাদে দিল্লিতে কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সত্বেও ২৪, আকবর রোডে এ আই সি সি-র সদর দফতরে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্ত দিল্লি পুলিশ ১৫ জুন (বুধবার) মারাত্মক ভাবে হানা দিল। এর আগের দু’দিন, সোমবার ও মঙ্গলবার কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা এ এই সি সি-র সদর দফতর থেকে ইডি-র দফতরে মিছিল করে যাওয়ার চেষ্টা করলে দিল্লি পুলিশ বাধা দেয়। নেতাদের দিল্লির বিভিন্ন থানায় গভীর রাত পর্যন্ত আটক করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু বুধবার অকল্পনীয়ভাবে দিল্লি পুলিশ আক্রমণাত্মক হয়ে এ আই সি সি-র সদর দফতরেই হানা দিল, যে খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। দিল্লি পুলিশের বাহিনী এ আই সি সি-র গেট ধাক্কা দিয়ে খুলে ভিতরে ঢুকে কংগ্রেস কর্মীদের তাড়া করে ধেয়ে যায়। পুলিশ কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের উপর লাঠি চালায় বলে কংগ্রেস নেতৃত্ব জানায়। সেই সময়ে কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী, এ আই সি সি নেতা কে সি বেণুগোপাল-সহ অনেক কংগ্রেস নেতা-নেত্রী উপস্থিত ছিলেন সেখানে। বাহারআইচের (উত্তরপ্রদেশ)বরিষ্ঠ প্রাক্তন সাংসদ কমল কিশোর-সহ একাধিক নেতাকে জামার কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে দফতরের বাইরে এনে আটক করা হয়। আটক করার সময়ে কংগ্রেসের লোকসভার মহিলা সাংসদ জ্যোতিমণি-র পোশাক ছিঁড়ে দেওয়া হয় ও জুতো খুলে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ জানিয়ে তিনি নিজেই একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন, যাতে তাঁকে ছিন্ন পোশাকে ও পাদুকাবিহীন অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। যুব কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি বি ভি শ্রীনিবাসকে আটক করার সময়ে এক পুলিশকর্মী তাঁর কোমরে লাথি মারে। মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী নেৎতা ডি’সুজাকে রাস্তায় ফেলে নিগ্রহ করা হয়। এদিন দুপুরের মধ্যে মোট ৮০০ জন কংগ্রেস নেতা-কর্মীকে দিল্লি পুলিশ আটক করে। কংগ্রেসের বিভিন্ন বরিষ্ঠ এবং যুব নেতা-কর্মীদের এ আই সি সি-র সদর দফতরে যেতে দেয়নি দিল্লি পুলিশ। অনেক কংগ্রেস নেতা সংসদের গান্ধি মূর্তির সামনে প্রতিবাদে বসেন। কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম, শশী থারুর, রণদীপ সিং সূর্যেওয়ালা প্রমুখ এর তীব্র প্রতিবাদ করে একে গণতন্ত্রের উপর হামলা বলে জানিয়েছেন। একে মোদী-শাহের নেতৃত্বে কংগ্রেসের উপরে বিজেপির প্রতিশোধমূলক রাজনীতি বলে কংগ্রেস নেতৃত্ব জানিয়েছে। অধীর রঞ্জন চৌধুরী প্রশ্ন করেছেন, “আমরা কি সন্ত্রাসবাদী? কিসের এত ভয়?” রণদীপ সিং সূর্যেওয়ালা বলেন,” যে সব পুলিশ অফিসারেরা মোদী সরকার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হাতের পুতুল হিসেবে প্রভুদের খুশি করার কাজ করছেন, তাঁরা জেনে রাখুন, আমরা মনে রাখব। প্রতিবাদ ও ফৌজদারি উপায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” এদিন রাতের মধ্যেই বরিষ্ঠ কংগ্রেস নেতাদের একটি প্রতিনিধিদল নয়াদিল্লির তুঘলক রোড থানায় গিয়ে এই বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে।
দেশের সর্বপ্রাচীন রাজনৈতিক দলের সদর দফতরে এই ধরনের পুলিশের হানা এক নজিরবিহীন ঘটনা। দেশের সমস্ত কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের কাছে ২৪,আকবর রোডের এ আই সি সি-র সদর দফতর উপাসনালয়ের মত। সম্ভ্রম ও আবেগের অনুভূতি দিয়ে তাঁরা একে দেখেন। কংগ্রেসের সঙ্গে এই অফিসের সম্পর্ক বিগত ৪৪ বছরের। ভারতের অবিস্মরণীয় নেত্রী ইন্দিরা গান্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ভারতের রূপকার রাজীব গান্ধির সময় পেরিয়ে বর্তমান কাল অবধি অনেক ঘটনার সাক্ষী এই ভবন।
৭০ এর দশকে ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস (আই) যখন গঠিত হয়, তখন দলের আসবাবপত্র, টাইপরাইটার বা নিজস্ব অফিস কিছুই ছিল না। সেই সময়ে ইন্দিরা গান্ধির বিশেষ অনুগত, অন্ধ্রপ্রদেশের সাংসদ জি ভেঙ্কটস্বামী তাঁর ২৪,আকবর রোডের এই বাসভবনটিকে কংগ্রেস (আই) এর অফিস হিসেবে ব্যবহার করতে দেন। পাঁচটি ঘর, একটি বৈঠকখানা এবং খাওয়ার ঘর এই ভবনটিতে ছিল। ১৯৭৮ সালের জানুয়ারির এক শীতের সকালে চালু হয় এই অফিস। বুটা সিং, প্রণব মুখোপাধ্যায়, এ আর আনতুলে প্রমুখ এই অফিস ব্যবহার শুরু করেন। ‘অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি (ইন্দিরা)’ লেখা একটি কাঠের বোর্ড কংগ্রেস নেতা এইচ কে এল ভগত এই অফিসে লাগিয়ে দেন। ইন্দিরা গান্ধি এবং রাজীব গান্ধি দু’জনেই এই অফিস থেকেই দলকে পরিচালিত করেন। কংগ্রেস অনুরাগীদের কাছে এর দ্বার সদা অবারিত থেকেছে। বর্তমানে সনিয়া গান্ধি, রাহুল গান্ধী-সহ অন্যান্য বিশিষ্ট নেতাদের জন্য অফিসঘর আছে এখানে। রাজীব গান্ধির সময়ে, এখান থেকে ২ কিমি দূরে অবস্থিত জহর ভবনে এই সদর দফতর স্থানান্তরের একবার কথা হয়েছিল, যা বাস্তবায়িত হয়নি।
দিল্লির দীন দয়াল উপাধ্যায় মার্গের ১.৭০ লাখ বর্গফুটের তিন তলা চোখ ধাঁধানো বিজেপির পার্টি অফিস সব অর্থেই ঐশ্বর্য্য ও দাম্ভিকতার প্রতীক। সেই অফিসের ‘অফিসারেরা’ দেশের গরিব প্রান্তিক মানুষের কল্যাণ করবেন – এটা অলীক কল্পনা !
অপরদিকে, ২৪,আকবর রোডের কংগ্রেস অফিস থেকে দেশের সাধারণ মানুষের সার্বিক উন্নয়ন ও সুরক্ষার স্বার্থে নিরন্তর কাজ করেছেন নেতা-নেত্রীরা। দেশ গঠনের কাজ, দেশের সম্পদ সৃষ্টির কাজ। দেশের সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার কাজ নয়। তাই আপামর কংগ্রেস নেতা-কর্মীর হৃদয়ে স্থান পায় এই ভবন।