অশোক ভট্টাচার্যঃ
এতদিন শুনছিলাম ‘হিন্দু’ না হলে এদেশে থাকা যাবে না, এখন শোনা যাচ্ছে ‘হিন্দি’ না বললে দেশ ছাড়তে হবে।
হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত কি,না এ নিয়ে দেশ জুড়ে নতুন করে শুরু হওয়া বিতর্কের মধ্যে ঝোলা থেকে বেড়াল বের করে ফেললেন উত্তর প্রদেশের যোগী মন্ত্রীসভার ক্যাবিনেট মন্ত্রী সঞ্জয় নিষাদ। সংঘ পরিবারের আদর্শে বেড়ে ওঠা সঞ্জয় নিষাদের স্পষ্ট হুমকি — যারা হিন্দিতে কথা বলবে না, ভারতবর্ষে তাদের কোনো জায়গা নেই।
কেবল ধর্ম দিয়ে দখলদারি সম্পূর্ণ করা যায় না। আসলে দখলদারেরা এ সার সত্য বুঝলেও, আমরা যারা দখল হয়ে চলেছি তারা বুঝতে দেরি করছি। আর করছি বলেই “হিন্দি হ্যায় হম/ বতন হ্যায় হিন্দুস্তাঁ হামারা” গাইতে গাইতে হিন্দু’-হিন্দি-হিন্দুস্তাঁ সবকিছুকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চোখের সামনে দেখেও চুপ করে থাকছি আমরা।
ওপার বাংলা বুঝেছিলো। বলা যায় দু’পক্ষই বুঝেছিলো; যারা দখল করতে চেয়েছিলো এবং যারা দখল- মুক্তি চেয়েছিলো সেই দুটো শিবিরই বুঝেছিলো এ সার সত্য। যেকারণে লড়াই টা সামনা সামনি এসেছিলো।
এখানে ব্যাপারটা একটু অন্য। ফোঁড়াটা পাকেনি এখনো।
ওপার বাংলার শাসকরা জানতো ধর্ম দিয়ে পুরো দখল কোনোকালেই করা যায় না,তাই ভাষার উপর দখল নিতে হবে।
ভাষা মানে তো কেবল বর্ণমালার কয়েকটা কালো হরফে খোদাই করা অক্ষর নয়। ভাষা মানে আমার সামগ্রিক সত্তা, যার সাথে আমার সংস্কৃতি-প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-অনুভূতি সবটাই এক সুতোয় গাঁথা। তাই খান সেনারা পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ওপর ‘উর্দু ‘চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলো। অর্থাৎ “এক দেশ-এক ভাষা”…
আজ আমার দেশেও খাওয়ানোর চেষ্টা চলছে ” এক দেশ-এক ভাষা”…ধর্মীয় আগ্রাসন টা ওপরের ব্যাপার মাত্র। ওদিয়ে দেশ গড়াও যায় না আবার শাসক ধর্মের অস্ত্রের দ্বারা দীর্ঘমেয়াদি শাসনও করতে পারে না।
তাই যদি পারত,তবে বাংলাদেশ তৈরি হতো না। সেখানে পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তান, দুখানেই তো মুসলিম রা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু ভাষা, ভৌগোলিক চরিত্র, খাদ্যাভাস,পোশাক, জাতিগত চরিত্র সব দিক থেকেই দুই জায়গার মানুষের মধ্যে ছিলো বিস্তর ফারাক। তাই দু ভাগ হলো পাকিস্তান ; জন্ম নিলো বাংলাদেশ।
ভারতবর্ষে ব্যাপারটা বেশ বিচিত্র। এখানে বৈচিত্র্যের ফুলগুলোই একসাথে মালা গেঁথে আছে এমনভাবে যে, একটা ফুলকেও তুমি যদি সরিয়ে নাও তবে মালার বাঁধন যাবে আলগা হয়ে। সুতরাং “এক দেশ – অথচ বহু ভাষা, বহু ধর্ম,বহু স্বর”ই হলো সেই মালার বিচিত্র সব ফুল।
শাসক কোনোদিনই বোকা হয়না, সে খান সেনাই হোক বা তাদের সহযোগী রাজাকার’রাই হোক।
কেবল ধর্মের ভিত্তি রাষ্ট্র বানালে তোমার উপর দখল নেওয়া সম্ভব নয়,তাই তোমার ভাষার ওপর দখল নিতে হবে। তা পারলেই তোমার অস্তিত্বের ওপরও চলবে নির্বিরোধ দখলদারি। তখন বন্দুক,বেয়নেট..আর কিছুটি লাগবে না শাসন করতে। যেকারণে আজ ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ”‘এর কথা শোনা যাচ্ছে।
‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’…কথাটার মধ্যেই স্পষ্ট হয় সাংস্কৃতিক দখলদারির বার্তা। আর সাংস্কৃতিক দখলদারি করতে পারলেই শাসন-শোষণের সব কাজ খুব সহজেই করা যাবে…তাই তাদের দরকার ” এক দেশ – এক ভাষা”।
এখন প্রশ্ন, আমরা কবে বুঝব? যে সার সত্যটা আমার ওপার বাংলার ভাই বোনেরা মাত্র ক’দিনেই বুঝে গিয়ে ধর্মের আফিমে না ডুবে নিজের সত্তাকে রক্তের বিনিময়ে রক্ষা করেছিলো, তা আমাদের বুঝতে আর কত দেরি? অথচ আমরাই তো পারি…
সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন… “বাঙালির চরিত্রে বিদ্রোহ বিদ্যমান।……এ বিদ্রোহ বাঙালি হিন্দুর ভিতরই সীমাবদ্ধ নয়।বাঙালি মুসলমানও এ কর্মে পরম তৎপর। ধর্ম বদলালেই জাতির চরিত্র বদলায় না।”
শাসক এটা বোঝে ও মানে। আর মানে বলেই ধর্মের মোড়কে আমাদের “এক দেশ এক ভাষা ” গেলানোটাই তার লক্ষ।
শাসক যা বোঝে, আমরা তা কবে বুঝব???