কর্নাটক বিধানসভার নির্বাচন : ঘৃণার রাজনীতির পরাজয় ও ধান্দাবাজ দালাল পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের রায়

শান্তনু দত্ত চৌধুরী

গত ১৩ মে দক্ষিণ ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য কর্নাটক বিধানসভার নির্বাচনের ফল প্রকাশ হল। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি চূড়ান্ত শক্তি প্রয়োগ করেও এই নির্বাচনে বেশ স্বস্তিদায়ক ভাবেই পরাস্ত হয়েছে।কংগ্রেস দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে।২২৪ আসন বিশিষ্ট বিধানসভায় কংগ্রেস ১৩৬ টি আসনে জয়যুক্ত হয়েছে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতীয় জনতা পার্টি পেয়েছে ৬৫ টি আসন। জনতা দল ( সেকুলার ) এর প্রাপ্তি ১৯ টি আসন। নির্দলসহ অন্যান্যরা পেয়েছে ৪ টি আসন। ২০১৮ সালের কর্নাটক বিধান সভার নির্বাচনে কোনো দলই নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। সেবার কংগ্রেস জয়যুক্ত হয়েছিল ৮৭ টি আসনে।জনতা দল সেকুলার) জয়যুক্ত হয় ৩৭ টি আসনে।বিজেপি জিতেছিল ১০৪ টি আসনে।নির্বাচনের পর কংগ্রেস জে.ডি.(এস) নেতা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ.ডি. দেবগৌড়ার পুত্র এইচ ডি কুমারস্বামীকে মুখ্যমন্ত্রী পদে সমর্থন করে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করে। কিন্তু বিজেপি দল এক বছর পর দলত্যাগ করিয়ে ওই মন্ত্রীসভার পতন ঘটায়। গত প্রায় চার বছর ধরে কর্নাটকে বিজেপির নেতৃত্বে এক বিভীষিকাময় শাসন কায়েম হয়।সঙ্ঘ পরিবার কর্নাটক রাজ্যটিকে দক্ষিণ ভারতের গুজরাটে পরিণত করবার জন্য প্রকাশ্যে নিকৃষ্ট মানের সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিতে শুরু করে। সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ত শক্তি সর্বদা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য বলে চিহ্নিত করে। যেমনভাবে গত শতকের তিরিশের দশকে ইতালি ও জার্মানিতে মুসোলিনি ও হিটলারের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসি মতবাদের উত্থান হয়েছিল। তারা ইহুদি ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষমূলক প্রচার চালিয়ে বিরাট সংখ্যক মানুষকে ইহুদি বিদ্বেষী করে তোলে। হিটলারের প্রচার মন্ত্রী গোয়েবলসের তত্বই ছিল যে ‘ একটা মিথ্যাকে হাজার বার বললে তা সত্যে পরিণত হয়।’ হিটলার ও মুসোলিনির ভারতীয় অনুসরণকারী সঙ্ঘ পরিবার গত তিন দশক ধরে কর্নাটকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ( পড়ুন খ্রিস্টান ও মুসলমান)বিরুদ্ধে নিয়মিত বিভেদমুলক সাম্প্রদায়িক প্রচার চালিয়ে ওই রাজ্যে বেশ কিছু মানুষের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক মনোভাব গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।

গত চার বছরে আমরা দেখেছি কিভাবে একটার পর একটা অপ্রয়োজনীয় বিষয় উত্থাপন করে অন্য ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে আক্রমণ সংগঠিত করা হচ্ছে। যেমন ‘ হালাল ‘ করা মাংস কেউ বিক্রি করতে পারবে না ও খেতে পারবে না। সম্পূর্ণ ভাবে ব্যাক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ। কেউ ইচ্ছে হলে হালাল মাংস( মাংস কাটার এক বিশেষ পদ্ধতি )খাবেন না, কেউ তাকে বাধ্য করেনি ওই প্রক্রিয়ায় কাটা মাংস খেতে হবে বলে। এই বিষয় নিয়ে মুসলমান মাংস বিক্রেতাদের ওপর লাগাতর আক্রমণ শুরু হল কেন তারা ‘ হালাল ‘ পদ্ধতিতে মাংস কাটে বলে।

এরপর শুরু হল মুসলমান ছাত্রীদের ‘ হিজাব ‘ পড়া নিয়ে।সরকারি নির্দেশ বেরোলো কেউ স্কুলে বা কলেজে হিজাব পরে যেতে পারবে না বলে। অনেক মুসলমান ছাত্রী হিজাব পরে। হিজাব বোরখা নয়। হিজাবে মুখ আবৃত থাকে না। মাথার ওপর একটি আচ্ছাদন থাকে মাত্র দক্ষিণ ভারতে বা দেশের অন্য কোনও রাজ্যে হিজাব নিষিদ্ধ নয়। আমরা টিভি ‘ র পর্দায় দেখেছি কিভাবে মুসলমান ছাত্রীদের সামনে পিছনে ‘ জয় শ্রীরাম ‘ স্লোগান দিতে দিতে বজরং দলের গুন্ডারা ছাত্রীদের উত্যক্ত করছে।অনেক ছাত্রী এর জন্য স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হয়।মুসলমান ছাত্রীরা নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম পরে। কিন্তু মাথায় আচ্ছাদন ( হিজাব) দিলেই আপত্তি। মসজিদ ও চার্চের ওপর আক্রমণের অনেক ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ করলেও প্রশাসন নির্বিকার।এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে।

পাঠক্রম বিশেষ করে ইতিহাসের বিষয়বস্তুর ওপর লাগাতর আক্রমণ । আক্রোশের প্রধান লক্ষ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নায়ক ‘ টিপু সুলতান।’ প্রথিতযশা ঐতিহাসিকদের দীর্ঘ পরিশ্রম ও গবেষণালব্ধ ইতিহাসের পাঠকে পরিবর্তন করে মিথ্যা সাম্প্রদায়িক তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। এবার ভোটের আগে প্রচার করা হল, টিপু সুলতানের নাকি শ্রীরঙ্গপত্তমে যুদ্ধ হয়েছিল ‘ভোক্কালিগা ‘ দের সঙ্গে , ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নয়।তাঁকে নাকি হত্যা করে দুইজন ভোক্কালিগা বীর। এই মিথ্যা প্রচারের ফল বিজেপি হাতে নাতে পেয়েছে। ভোক্কালিগা অঞ্চলে তাদের শোচনীয় ফল হয়েছে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অসংখ্য মিটিংয়ে বলেন ‘ আপনারা কাকে ভোট দেবেন টিপুর আওলাদদের নাকি যারা ভগবান রামচন্দ্রের মন্দির নির্মাণ করছে তাদের?’ যোগী আদিত্যনাথ , হিমন্ত বিশ্ব শর্মা , স্মৃতি ইরানি ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রচারে কেউ কারো থেকে কম যান না। কংগ্রেস তাঁদের প্রচার কেন্দ্রিভুত করেছিল নিজেদের নির্বাচনী কর্মসূচি , বিজেপি’র অপশাসন, ভয়ংকর আর্থিক দুর্নীতি ও ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালোবাসার বার্তা নিয়ে। এর সঙ্গে কংগ্রেস দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছিল, কংগ্রেস ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে প্রয়োজনে পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া ও বজরং দলের মতন সাম্প্রদায়িক সংগঠনকে বেআইনি ঘোষণা করবে। ব্যাস এবার খুল্লাম খুল্লা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর প্রতিটি জনসভায় ‘ জয় বজরংবলি ‘ বলে উচ্চনাদের হুঙ্কার দিতে লাগলেন। বজরং দলের মতন একটি হিংস্র সংগঠনকে ‘ পৌরাণিক ‘ চরিত্র বজরংবলির সঙ্গে, মোদীর এক করাকে জনসাধারণ ভালো ভাবে নেয়নি। তাঁরা বজরংবলিকে পুজো করে, বজরং দলকে নয়। এই নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে রাহুল গান্ধি যে বিশ্লেষণ করেছেন তা খুবই প্রণিধানযোগ্য। রাহুল বলেছেন, ” কর্নাটক বিধানসভার নির্বাচন : ধান্দাবাজ দালাল পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের রায় ও ঘৃণার রাজনীতির পরাজয় , সাধারণ মানুষ ভালোবাসার দোকান খুলেছেন।”

এই নির্বাচনের ফলাফল আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে মহান চিন্তাবিদ এম.এস. কালবুর্গী ও গৌরী লঙ্কেশ — এঁদের কথা। যাঁরা এই ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে কর্নাটকে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *