ওড়িশার ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ও ভারত সরকারের

                    অমানবিক ভূমিকা 

অমিতাভ সিংহ

ভারত কা কবচ ” এইনামে কিছুদিন ধরে একটা বিজ্ঞাপন খবরের কাগজ ও বৈদুতিন মাধ্যমে দেখা গিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখের বিশাল ছবিসহ।সেই কবচ রক্ষা করতে পারল না এযাবতকালের এক ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনাকে। যেখানে একসঙ্গে তিনটি ট্রেন জড়িত ছিল।এতদিন মোদী অতি সাধারণ ব্যাপারকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে, মিথ্যার আবরণ দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে নির্বাচনে জিতে এসেছেন আর নিজের ৫৬ ইঞ্চি ছাতির বড়াই করেছেন। চিন ভারতের মাটির ২০০০ বর্গ কিমি দখল করার পরও মোদী একবারও চিনের নাম উচ্চারণ করতে ভয় পাওয়ার পর দেশের মানুষ তার ছাতির গল্পটি যে কতটা অসাড় তা কিছুটা হলেও উপলদ্ধি করতে পেরেছেন।কিন্তু প্রশ্ন বিজ্ঞাপনে তো মুখ দেখানো অনেক হল,এই দুর্ঘটনায় দায় কে নেবেন।নিয়ম অনুযায়ী তো বিজ্ঞাপনের মুখকেই তা নিতে হয়,কৃতিত্ব যখন একাই নিয়েছেন।হাততালি যেমন তার প্রাপ্য,দায়টাও তার নেওয়া উচিৎ নয় কি?

গত শুক্রবার,২ জুন ওড়িশার বালেশ্বর স্টেশনের পর অবস্থিত বাহানাগা বাজার স্টেশনে ঢোকার মুখে রেলগেটের কাছে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্করতম রেল দুর্ঘটনায় নিহত হয় প্রায় ৩০০,আহত সহস্রাধিক মানুষ।তারপর থেকে সরকারের পক্ষ থেকে যেভাবে এই দুর্ঘটনার দায় নিয়ে চাপানউতোর খেলা চলছে তাতে এটা পরিষ্কার সরকার বলির পাঁঠা খুঁজে বেড়াচ্ছে নিজেদের গাফিলতি ঢাকার জন্য,কারন একটাই, লোকসভা নির্বাচনের আর একবছরও বাকি নেই।এমনিতে কৃষক আন্দোলন,চরম বেকারত্ব,অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, আদানী কেলেঙ্কারিতে মোদীর ভুমিকা, দেশের গণতন্ত্র হত্যা ও সবে শেষ হওয়া হিমাচল প্রদেশ ও কর্নাটকের নির্বাচনে পর্যুদস্ত হওয়ার পর থেকে আত্মবিশ্বাস তলানিতে।তার সঙ্গে রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা মোদীর বেলুনে একাধিক ছিদ্র প্রকাশ করে দিয়েছে।কিন্তু মিথ্যের বিপণন ও মোড়ক নরেন্দ্র মোদীর প্রধান অস্ত্র।তাই এত সহজে দেশের সাধারণ মানুষের সর্বনাশ করার মহান দায়িত্ব থেকে তিনি সরবেন না।

বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্ক ভারতে যা বিস্তৃত ৬৭,৯৫৬ কিমি ( মার্চ ২০২০ অনুযায়ী)। এই দেশের বেশীরভাগ মানুষ সস্তার পরিবহন ব্যবস্থা রেলের ওপর নির্ভরশীল। এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে বা এর ওপর থেকে দেশের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস চলে গেলে তা দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনে এক সুদূরপ্রসারি প্রভাব পড়তে বাধ্য। পথ পরিবহন ব্যবস্থা অনেক উন্নতি করলেও দেশের গরীব ও সাধারণ মধ্যবিত্তদের কাছে তা যথেষ্ট ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। দুর্ঘটনার পর দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যেতে যেখানে বিমানভাড়া দুতিন বছর আগে হাজার চারেক লাগতো ও কয়েকদিন আগে হাজার সাতেক পড়তো সেখানে গতকাল সর্বোচ্চ ভাড়া পড়েছে পঞ্চাশ হাজার টাকা।জরুরি প্রয়োজনে মানুষ সেই টাকা দিয়েই গন্তব্যে পৌঁছতে বাধ্য হয়েছেন। একটা তথ্য জানাই। প্রায় ৬৮,০০০ কিমি রেলপথে যাত্রীট্রেন চলে দিনে মোটামুটি ২২,৫৯৮ টি। প্রতিদিন মোট যাত্রী পরিবহন করা হয় ২.৪ কোটি,অর্থাৎ ট্রেন পিছু গড়ে ১০৬২ জন।সেখানে দেশের ১৫ টি বন্দে ভারত ট্রেনে দিনে বড়জোর ১৫ হাজার যাত্রী চাপে।এই বন্দে ভারতের জন্য মোদীর যত চিন্তা।প্রতিটি বন্দেভারত ট্রেনের উদ্বোধক একা তিনিই করবেন বিভিন্ন সাজে, আর দেশের প্রতিটি সংবাদমাধ্যমে সেই ছবি ছাপা হবে বা দেখানো হবে।এমনই তার প্রচারের লোভ।এই ট্রেনটির ভাড়া বেশী,সময় লাগে কম যদিও তার কারণ মূলত কম স্টেশনে তা থামে বলে।কিন্তু যেখানে লাইনের ও সিগনালিং ব্যবস্থার এই অবস্থা সেখানে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করে ভবিষ্যতে এর ভাগ্যে যে কি আছে তা বলার মতন সময় এখনো আসে নি। তবে একথা সত্যি মোদী সরকারের একটা বড় কৃতিত্ব যে কোন তুচ্ছ বিষয়কে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে জনতার দৈনন্দিন সমস্যাগুলিকে চাপা দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার বিষয়ে তারা চ্যাম্পিয়ন। দেশের মানুষ আর কবে বুঝবেন ২২৫৯৮ টি ট্রেনের মধ্যে ২২৫৮৩ টি ট্রেনকে সরকার ‘ বন্দে ভারতে ‘ প্রমোট করতে গিয়ে অবহেলা করছে।২.৪ কোটি যাত্রীর মাত্র ১৫ হাজার জন বন্দেভারতে চাপেন, তাহলে বাকি ২,৩৯,৮৫,০০০ জন যাত্রী কি অবহেলিত থেকে যাচ্ছেন না? বেশী ভাড়া দিয়ে বন্দে ভারতের মত বিলাসবহুল ট্রেনে চাপবার মত ক্ষমতা কজন মানুষের আছে? অথচ এই বন্দেভারত ও বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন মোদীর ভ্যানিটি,তিনি আপমর জনতার কথা ভাবেন না,কয়েকটি উচ্চবিত্তই তার অগ্রাধিকার বা প্রায়োরিটি।এবার আসা যাক দুর্ঘটনার প্রসঙ্গে,এই দুর্ঘটনার কারণ জানা গেছে পয়েন্ট ও সিগন্যাল বিভ্রাট। ঘন্টায় ১২৮ কিমি গতিতে চলা করমন্ডল এক্সপ্রেসকে প্রথমে আপ মেনলাইন ধরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।গতিশীল ট্রেনকে পাস করনোর জন্য যদি অন্য কোন ট্রেন সেই লাইনে থাকে তাহলে সেই ট্রেনটিকে লুপ লাইনে সাময়িক স্থানান্তরিত করা হয়।এক্ষেত্রেও একই নিয়ম মানা হয়।সিগনাল ছিল মেন লাইনের কিন্তু পয়েন্টটি ঘোরানো ছিল লুপ লাইনের দিকে।ফলে তীব্র গতি সম্পন্ন ট্রেনটি ২৩ সেকেন্ডের মধ্যে ধাক্কা মারে মালগাড়িটিকে।২৪ টি কোচের মধ্যে ২১ টি কোচ তাসের মত দুপাশে উড়ে যায়। ৭ কিমি দূর থেকে যার শব্দ শোনা গিয়েছে। পাঁচ বর্গমিটার রেললাইন উপড়ে গেছে,ছিঁড়ে গেছে ওভারহেড লাইন,ভাঙা টিনের ডাব্বার মত অবস্থা ওয়াগানগুলোর।লুপ লাইনে ঢোকার সময় বিশেষ রুট সংকেতও জ্বলেনি।এরপর আপ মেন লাইনের ওপর এসে পড়া ডাউন যশোবন্তপুর এক্সপ্রেসের দুটি কামরাও দুমড়ে যায়।একেবারে ত্রহস্পর্শ। আপ মেন লাইনের সিগন্যাল ও পয়েন্টের অসামঞ্জস্য আচরণ এই দুর্ঘটনার কারণ বলে আধিকারিকদের মত।এটাকে ইন্টারলকিং ব্যবস্থার বিপর্যয় বলে যা কাজ না করলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।লোকসভা ভোটের আগে দেশের দুশো শহরের মধ্যে বন্দে ভারত চালাবার পরিকল্পনা মোদী সরকারের।তার জন্য ঢালাও টাকার ব্যবস্থা। উপেক্ষা করা হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস যা মনমোহন সিং সরকারের আমলে চালু হয় ও মোদী তা নতুন মোড়কে ‘ কবচ ‘ নাম দিয়ে প্রচার করে, তা বসানো হয় না। বলা হয় টাকা নেই।পুরানো সিগনালিং ব্যবস্থাও পাল্টানো হয় না।পুরানো রেলসেতু সংস্কার শিকেয় ওঠে।কামরাগুলো থাকে ভাঙাচোরা,আসনগুলোয় কাঠ ভাঙা বা স্পন্জ খুবলে নেওয়া,পাখাগুলো সব চালু নেই অথবা জানালাগুলো ঠিকমত বন্ধ করার উপায় নেই।

গতবছর Research Design and Standard Organisation বা আরডিএসও দ্বারা পুরোপুরি দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরী অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশন বা এটিপি বা কবচ ব্যবস্থা চালু করার সময় বহু দাবী করা হয়,বলা হয় এই ব্যবস্থার ফলে রেলে দুর্ঘটনার দিন শেষ কারণ এই প্রযুক্তির ফলে এক লাইনে দুটি ট্রেন চলে এলে ট্রেনের চাকা লক হয়ে যায়।মোদীর নেতৃত্বে এই যুগান্তকারী বিপ্লব! এই প্রযুক্তি ১০০০০ বারে মাত্র একবার ব্যর্থ হতে পারে। কিন্তু সংখ্যাতত্ত্ব বলে ৬৮,০০০ কিমি রেলপথের মাত্র ১০৯৮ কিমি লাইন ও ২২,৫৯৮ টি ট্রেনের মধ্যে মাত্র ৬৫ টি ট্রেনকে কবচের আওতায় আনা হয়েছে।অথচ করমন্ডল এক্সপ্রেসের মত গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন এর আওতায় নেই।সরকার সপ্তাহে দুটি বন্দেভারতের জন্য ২৩০ কোটি টাকা খরচ করতে পারে,সেখানে দেশের কোটি কোটি মানুষের সুরক্ষার জন্য টাকার সংস্থান করতে পারে না।আসলে সেন্ট্রাল ভিস্তা ,নতুন পার্লামেন্ট, বুলেট ট্রেন, বন্দেভারত এগুলি মোদীর হাই প্রোফাইল প্রোজেক্ট , যা দিয়ে তিনি নিজেকে বিশ্বগুরু বলে প্রচার করার পরিকল্পনা করবেন। এই ইগোটা নিম্নমেধাসম্পন্ন অথচ আকাশকুসুম চিন্তা করা মানুষের মধ্যে দেখা যায়।মনমোহন সিং এর মত মানুষের মধ্যে কখনও এই রোগ কেউ দেখেছে? দুর্ঘটনার পরদিনই ঘটনাস্থল ঘুরে মোদী বলেছেন দোষীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। তার একটাই অর্থ মোদী এতটাই বিশেষজ্ঞ এই ব্যাপারে যে একবার দেখেই বুঝে গেলেন যে একটা অন্তর্ঘাত হয়েছে। কোন প্রযুক্তিগত ত্রুটি নয়।প্রথম থেকে নিজেদের ঘাড় থেকে দায় ঝেড়ে ফেলে কাউকে বলির পাঁঠা করার হীন অপচেষ্টা যা অত্যন্ত লজ্জ্বার।এই দুর্ঘটনার তদন্ত তো নিয়মমত করার কথা রেলওয়ে নিরাপত্তা কমিশনারের,তার রিপোর্ট আসার আগেই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ কেন এই প্রশ্ন উঠেছে। রেলমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে ঘোষণা করলেন সিবিআই তদন্তের। অথচ আগের দিনই তিনি বলেছিলেন দুর্ঘটনার মূল কারণ জানা গেছে।এটার একটাই মানে হয়,সরকার নিজেদের গাফিলতি ঢাকতে তদন্তে সিবিআই কে ডেকে দায় অন্য কারোর ওপর চাপাতে চাইছে। কংগ্রেস সভাপতি ও প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মল্লিকার্জুন খার্গে মনে করিয়ে দিয়েছেন সিবিআই — এর কাজ অপরাধের তদন্ত করা , রেল দুর্ঘটনার নয়।তিনি এও বলেছেন যে কোনও তদন্তকারী সংস্থা প্রযুক্তিগত বা রাজনৈতিক ব্যর্থতা নির্ধারণ করে কার দায় তা নির্দিষ্ট করতে পারে না।রেলের সিগনালিং, সুরক্ষা, রক্ষনাবেক্ষণ বা প্রযুক্তিগত দিকগুলি সম্পর্কে কোন ধারণা ও দক্ষতা সিবিআই এর নেই।এই অপচেষ্টা আসলে সরকারের গাফিলতি স্বীকার করতে না চাওয়ার ফল।সরকার চেষ্টা করছে এই দুর্ঘটনাকে অন্তর্ঘাত তত্ত্বের মোড়কে পেশ করে দেশজুড়ে সহানুভূতির হাওয়া তুলে আগামী লোকসভার নির্বাচনে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে সিবিআই কে কাজে লাগাতে।যেমনটি হয়েছিল পুলওয়ামা নামক চিত্রনাট্যে।

এই সিবিআই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অধীন।প্রধানমন্ত্রী যেমনভাবে চাইবেন সেভাবেই তদন্ত ও তার বিচার হবে,এটাই গত কয়েকবছরে মোদী জমানার ট্রেন্ড। তার ব্যত্যয় হলে স্বয়ং ইশ্বর অবাক হবেন।আর রেলমন্ত্রী তো নিজের পিঠ নিজেই চাপড়াচ্ছেন।মোদীর চতুর পরামর্শে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, মিডিয়াকে নিয়ে গিয়ে দেখাচ্ছেন কল থেকে জল খাচ্ছেন।অমিত মালব্যর নেতৃত্বে বিজেপির আইটি সেল প্রচার করতে আরম্ভ করল দেখ কি সংবেদনশীল রেলমন্ত্রী, ওখানে দাঁড়িয়ে তদারকি করছেন। যেন রেলমন্ত্রী না দাঁড়িয়ে থাকলে অফিসাররা বা ইন্জিনিয়াররা লাইন চালু করার কাজ করবেন না বা নিহতদের দেহ উদ্ধার বা আহতদের হাসপাতালে পাঠানো হবে না? পুরোটাই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। প্যাকেজিং ও বিপননের কারসাজি।এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন রেলমন্ত্রীরই সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে।যাদের নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু হয়েছে তাদের যেন কোন ক্ষতি হয় নি। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী বাসের ব্যবস্থা করলেন,কেন রেল কি এটা করতে পারত না? তাহলে রেলমন্ত্রী ওখানে দুদিন বসে থেকে নিজের প্রচার ছাড়া আর কি করলেন ? ভারতমাতা কি জয় আর বন্দেমাতরম স্লোগান দেওয়া ছাড়া? একটা দুর্ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে এই স্লোগান কতটা মানবিক?একজন আইআইটি ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা মানুষ কি করে বিপ্রসেনা ব্রাম্ভন পঞ্চায়েতে গিয়ে পরশুরামের ওপর বলছে ও তার নামে জিন্দাবাদ দিচ্ছে।দেশের রেলমন্ত্রীর কাছে এই সংগঠনের পোস্টার উদ্বোধনের সময় হয় কি করে? শোকের মধ্যে নিজেদের বাহবা দিয়ে এরা কি প্রমাণ করতে চাইছেন? দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ সহানুভূতি জানাচ্ছে তাই নিয়ে পোষ্ট বেরিয়ে গেল,এমনটি নাকি কোন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ঘটে নি। রেল দুর্ঘটনা কখনও যে বিদেশনীতিতে বদল আনতে পারে? এই বোধগুলো বিজেপির আইটি সেলের নেই তা বিশ্বাস করি না,আসলে দেশের মানুষকে তারা গাধা ভাবে বলেই এইসব টুইট বা পোষ্ট করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে।ভাবতে অবাক লাগে মালব্যর টুইটে কোথাও ২৮৮ জন মৃত মানুষের জন্য একটা শোকবার্তা নেই। এরই মধ্যে এই দুর্ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক মোড়কে পেশ করার পরিকল্পনা করে বিজেপির আইটি সেল। ঘটনাস্থলের অদূরে নির্মিয়মান একটি মন্দিরকে মসজিদ বলে চালাবার চেষ্টা করে বিজেপির কুখ্যাত সেলটি,তারা দুর্ঘটনার দায় সংখ্যালঘুদের ওপর চাপাতে চেয়েছিল,যেমন তারা কোভিদের সময় করোনা ছড়ানোর দায় তবলিগি জমায়েতের ঘাড়ে চাপাতে চেয়েছিল।তবে এই কুউদ্দেশ্য ফলপ্রসু হয় নি।

রেল দুর্ঘটনার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী, মাধবরাজ সিন্ধিয়া বা নীতিশ কুমার।কখনও এদের নিজেদের নিজেরাই বাহবা দিয়েছেন ? সারা দেশের মানুষের কাছে এদের জায়গাটা নিজেরা কাজের মাধ্যমে পৃথক করে ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছেন।

এরপর আমরা কি দেখলাম? গত কয়েক বছর রেল বিভিন্নভাবে বিপুল আয় করেছে।ডায়নামিক প্রাইসিং এর নামে রেলের একটা বড় অংশের টিকিট চলে যায় বেশী দামের টিকিটের আওতায়।সাধারণ মানুষ নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশী দামে টিকিট কাটতে বাধ্য হন।প্রবীণ নাগরিকদের জন্য ভাড়ায় ছাড় যা মনমোহন সিং সরকার প্রচলন করেছিল তা বিজেপি সরকার করোনাকালে উঠিয়ে দিয়েছে।প্লাটফর্ম টিকিটের দাম তো দ্বিগুন হয়েছেই,করোনার সময় ৫০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।প্যাসেঞ্জার ট্রেনকে সুপারফ্যাস্ট নাম দিয়ে ভাড়া বাড়ানোর নজিরও কম নেই।সেই আয়ের একটা অংশ কেন খরচ করা হবে না সুরক্ষাখাতে? ‍ষ০১৭-১৮ সালে রাস্ত্রীয় রেল সুরক্ষা কোষ গঠিত হওয়ার পর রেল বাজেটে রেল ট্রাক, ক্রসিং ঠিক করা,নতুন প্রযুক্তি আনা ইত্যাদির জন্য ২০,০০০ কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথা। যার মধ্যে বাজেটের মাধ্যমে কেন্দ্র দেবে ১৫০০০ কোটি টাকা আর রেল তার নিজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে জোগাড় করবে ৫০০০ কোটি টাকা।সেই টাকার পুরোটা আসে না,যেটুকু আসে তার বেশীরভাগটাই খরচ হয়েছে রেলের সুরক্ষা খাতের বাইরে।প্রায় ২৩০০ কোটি টাকা।সিএজি বা ক্যাগের রিপোর্ট যা ২০২১ সালের মার্চ মাসে দেওয়া হয়েছিল ও এতদিন তা কেন্দ্র লুকিয়ে রেখেছিল,কংগ্রেস সাংসদ ও লোকসভায় রেলের স্থায়ী কমিটির সদস্য শক্তি সিং গোহিল সম্প্রতি একটা সাংবাদিক সম্মেলনে এই প্রসঙ্গে বেশ কিছু সুপারিশ ও তা পালন না করায় প্রশ্ন তেলেন।

★ রেললাইন খুব খারাপ বলা হয়েছে ২০১৭-২১ সাল পর্যন্ত লাইনচ্যুত হওয়ার ফলে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১১২৭ টি ক্ষেত্রে। এর প্রধান কারণ হিসাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে রেললাইনে ত্রুটি, ইন্জিনিয়ারিং ও রক্ষনাবেক্ষন ও অপারেটিং এর ত্রুটি। এই ত্রুটিগুলির কারণ হিসাবে বলা হয়েছে লাইন মেরামত ও পরিবর্তনের জন্য অর্থ মন্জুর হয় নি।যা হয়েছে তা খরচ হয় নি।বেলাইনের ২৬% ঘটেছে নতুন লাইন না বসানোর জন্য।

★ ২০১৭-১৮ সালে রাষ্ট্রীয় রেল সুরক্ষা কোষ তহবিল এক লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল বার্ষিক ২০০০০ কোটি টাকা হিসাবে।কিন্তু এযাবতকালে মাত্র ১৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে গত ছয় বছরে।

★ ৩৫০ টি ক্ষেত্রে তদন্ত হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়েছে ১৬৯ জায়গায়।১৮১ টি ক্ষেত্রে কোনও তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়ে নি।

★ বালেশ্বরে যেখানে ২ জুন দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তা দক্ষিণ পূর্ব রেলের আওতায় পড়ে।সেখানেও ৩২ টি জায়গায় দুর্ঘটনার তদন্ত প্রয়োজন থাকলেও তদন্ত হয়েছে ১৬ টি জায়গায়। পূর্ব রেলেও ৪৮ জায়গায় তদন্তের দরকার থাকলেও তা হয়েছে ২৪ টি জায়গায়।রিপোর্টে বলা হয় দেশের সব রেল মিলিয়ে ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত না হওয়ার নজির আছে।

★ শেষ চার বছরে ২১৭ টি ছোট বড় রেল দুর্ঘটনার ৭৫% ক্ষেত্রে কারণ ট্রেন বেলাইন হওয়া।এই রিপোর্টে আগেই বলা হয়েছিল গত চার বছরে দুর্ঘটনার সিগন্যাল সংক্রান্ত সমস্যা ছিল ২১১ টি ক্ষেত্রে।

★ সরকারের গাফিলতির দিকেও আঙুল তোলা হয়েছে এই রিপোর্টে।

★ প্রাণঘাতী রেল দুর্ঘটনা বাড়ছে মোদীর আমলে।রেললাইন ঠিকমত দেখভাল না হওয়া এর অন্যতম বড় কারণ। ২০২২ সালের ক্যাগের রিপোর্টে বলা হয়েছে রেললাইনের অবস্থা খতিয়ে দেখা,দুর্ঘটনার পর তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া,তা গ্রহণ করা,জরুরি প্রয়োজন মেটাতে রেল খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও ব্যবহার করা বা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কর্মী নিয়োগের গুরুতর খামতি রয়েছে।

তাছাড়া ট্রাক রেকর্ডিং কারের মাধ্যমে লাইনের ভৌগলিক ও গঠনগত অবস্থা খতিয়ে দেখার কাজেও ৩০-১০০% খামতি রয়েছে। ট্রাক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ওয়েব অ্যাপ যার কাজ লাইনের ওপর নজরদারির অনলাইন ব্যবস্থা তা সক্রিয় নেই।স্বাধীনতার পর রেলকে সরকারীকরণ করেন জওহরলাল নেহেরু।কারণ ছিল বেসরকারি হাতে থাকলে তারা মুনাফার দিকে বেশী নজর দেবে,যাত্রী সাচ্ছন্দ্য ও সুরক্ষার চেয়ে। টিকিটের দামও বাড়িয়ে গরীব মানুষের ওপর চাপ বাড়াবে।আজ এই সরকার রেলকে তদের পছন্দের ব্যবসায়ী আদানী আম্বানিদের কাছে বেচে দিতে চায়।রেলের বহু ক্ষেত্র ইতিমধ্যেই বেসরকারিকরণ হয়ে গেছে,তাই সুরক্ষাব্যবস্থা এতটাই অবহেলিত।এনসিআরবি বা ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ড বুরোর হিসাব অনুযায়ী বিগত দশ বছরে রেলপথে মৃত্যু আড়াই লক্ষ। স্বাধীনতার পর রেলের একাধিক কমিটি গঠিত হয়েছে।১৯৬২ সালে কুন্জরু কমিটি,১৯৬৮ সালে ওয়াঞ্চু কমিটি,১৯৭৮ সালে সিক্রি কমিটি,১৯৯৮ সালে খান্না কমিটি,২০১২ সালে কাকোদকর কমিটি।কিন্তু এদের রিপোর্ট কতটা সরকার কাজে লাগিয়েছে তা জানা যায় না।রেলে ৩১২,০০০ নন গেজেটেড পদ শূণ্য।নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কাজে ঠিকা শ্রমিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বহুক্ষেত্রে।এরপর আমরা কিভাবে আশা করবো আপাদমস্তক আত্মপ্রচারসর্বস্ব একটা মিথ্যাবাদী সরকারের আমলে রেল ঠিকমত চলবে?

একসময় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে রেলওয়ে নিরাপত্তা কমিশন অভিযোগ করেছিল যে সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই রেলের নিরাপত্তা দেখার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।রেল বোর্ড বিভিন্ন নিয়ম পাল্টাচ্ছে।রেল বোর্ড যে রেলওয়ে নিরাপত্তা কমিশনের সুপারিশ মানছে না তার সমালোচনা করা হয়েছিল সংসদীয় স্থায়ী কমিটির রিপোর্টে,এটাও জানিয়েছেন কংগ্রেস সাংসদ শক্তি সিংহ গোহিল।রেল নিরাপত্তা কমিশনকে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রকের আওতা থেকে বার করে স্বাধীন সংস্থা হিসাবে আইনের মাধ্যমে সৃষ্টি করার সুপারিশ করা হলেও তা এখন বিমানমন্ত্রকের অধীনে।মোদী বলেছেন দোষীকে আড়াল করা হবে না,দোষী তো মোদী সরকারই।২০১৮ সালেও মুখ্য রেল নিরাপত্তা কমিশনের যে ক্ষমতা ছিল তা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।যেন সরকার বলছে,আমিই চোর,আমিই কোতোয়াল,আমিই বিচারক।একসময় ক্যাগ রিপোর্ট দেখিয়ে ইউপিএ সরকারের ইস্তাফা চাওয়া হত, তাহলে এখন রেলমন্ত্রীর কি করা উচিৎ? ইস্তফা না দিয়ে নিজের পিঠ নিজে চাপড়ানো?

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *