সুমন রায় চৌধুরীঃ
১১ ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩, শিকাগো ধর্ম মহাসভায় তিনি যখন বক্তব্য শুরু করেন তখন বিষয়বস্তু ছিল ‘হিন্দুদের ধর্ম ভাবসমূহ’ যখন শেষ করেন তখন হিন্দুধর্মের নব জন্ম হয়েছে। বিলাস- ব্যসনে ডুবতে বসা পাশ্চাত্য কে বৈরাগ্যের অগম পারে এসে দাঁড় করালেন যিনি তিনি স্বামী বিবেকানন্দ, অ্যানি বেসান্তের ভাষায়, “আ স্ট্রাইকিং ফিগার, ক্ল্যাড ইন ইয়েলো অ্যান্ড ওরেঞ্জ, শাইনিং লাইক দ্য সান অফ ইন্ডিয়া ইন দ্য মিডস্ট অফ দ্য হেভি অ্যাটমোস্ফিয়ার অফ শিকাগো”, অভিভূত পাশ্চাত্য শিখেছিল তেনঃ তক্তেন ভুঞ্জিথাঃ, ত্যাগের সঙ্গে ভোগের গূঢ় তত্ত্ব। রোম্যা রোঁল্যার ব্যাখ্যায় “দ্য থট অফ দিস ওয়্যারিয়ার প্রফেট অফ ইন্ডিয়া লেফট আ ডিপ মার্ক আপন ইউএসএ”। সেই ৯/১১ই সম্ভবত অ্যামেরিকা কে প্রথম ধাক্কা দিয়েছিল ভারতীয় গৈরিকবাদ, বেদান্ত ও দর্শনের আধ্যাত্মিকতা । নব ভারতও সেদিন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
” লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মুচি মেথরের ঝুপরির মধ্য হইতে। মুদিওয়ালার দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে” বেরিয়ে আসুক নতুন ভারত। এই স্বপ্ন নিয়েই তিনি ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ইহলোক ত্যাগের পর বলরাম বসুর বাড়িতে এক ভক্ত সমারোহে তিনি প্রস্তাব দেন একটি ভক্ত অ্যাসোসিয়েশন গড়ার। সেই প্রস্তাব সর্বাত্মক গৃহীত হলে পরে বিবেকানন্দ, শরৎ, রাখাল, লাটু প্রমুখ সতীর্থদের নিয়ে মঠের স্থাপনায় ব্রতী হলেন। বাধ সাধল অর্থ। সেই অর্থ তারা মাধুকরীর মাধ্যমে যোগাড় করলেন। খানিক এলো ধর্ম মহাসভার পরবর্তীকালে ব্রুকলিন এথিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যবৃন্দের সহৃদয় সহযোগিতার মাধ্যমে ।
প্রথমে আলমবাজারে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে কিছু দিন মঠের কাজ চলে। এখানেই সংঘমাতা শ্রীশ্রী সারদামণি পঞ্চতপা হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ঠাকুরের এক গৃহী ভক্ত নেপালরাজের দপ্তরী বিশ্বনাথ উপাধ্যায়ের উদ্যোগে বেলুড়ে জমি নেওয়া হয় সেখানেই স্থাপিত হয় আজকের রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন । হিন্দু, ইসলাম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভারতীয় স্থাপত্য রীতি মেনে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ভক্ত স্বামী বিজ্ঞানানন্দের তত্ত্বাবধানে আধুনিক ভারতের রূপরেখা নির্নিত হওয়ার ইমারত গড়ে ওঠে।
বিবেকানন্দ মনে করতেন রাখাল “রাজ্য উদ্ধার করতে পারে” সেই রাখাল মহারাজ বা স্বামী ব্রহ্মানন্দ হলেন প্রথম প্রেসিডেন্ট । এর মূল লক্ষ্য ছিল দেশ ও বিদেশে শাশ্বত সনাতন বৈদিক আদর্শ দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়া। ধর্মীয় ভেদাভেদ ও সাম্প্রদায়িকতার বীজ কে সমূলে উৎপাটিত করা। সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানো। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে দুঃস্থ মানুষকে সেবা দান । শিক্ষার প্রসার এবং সেই সাথে নারীদের প্রতি সম্মান ও সমাজে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এখানেই বিবেকানন্দ শ্রীশ্রী মা কে দুর্গারূপে পুজা করেন।
“শিব রূপে জীব সেবা” এর প্রতিষ্ঠানের মূলমন্ত্র। আজ ১২৫ বছর অতিক্রান্ত করেও একই আদর্শে তাঁরা পথ চলছেন। হিন্দুধর্মের সংস্কার সাধনের এই পীঠের মহিলা- সন্ন্যাসী দ্বারা চালিত মঠের নাম সারদা মিশন, ভারতবর্ষের বুকে এ এক নিঃশব্দ বিপ্লব বললেও অত্যুক্তি হয় না। উল্লেখ্য এই যে দুটি সংস্থা পরস্পরের থেকে প্রয়োজনীয় দূরত্ব বজায় রাখে। এক্ষেত্রেও ঠাকুরের নির্দেশ ছিল ‘নেড়া-নেড়ির দল’ না গড়ার, যা আজও অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়। শাসন, পালন, নিয়মানুবর্তীতার মন্ত্রে দীক্ষিত এক দল সন্ন্যাসী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে হাসপাতাল, মন্দির থেকে সংগ্রহশালা দশকের পর দশক চালিয়ে যাচ্ছে সাফল্যের সাথে । যখন এই প্রতিবেদন লিখছি তখন আমার কানে বাজছে শ্রীরামকৃষ্ণ বন্দনা গীতি, “খন্ডন-ভব-বন্ধন, জগ-বন্দন বন্দি তোমায়”। রাজনীতি এর প্রাঙ্গনে ছায়া ফেলতে পারেনি…”
“উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত” যেন আজকের নির্যাতিত ভারতেরও মহামন্ত্র, “arise and awake…”