শুদ্ধ ব্যানার্জিঃ
কাঁচের দেওয়াল পাথরের টুকরোর আঘাতে ভেঙে পড়ল। অথবা শৈল্পিক বাঁধনের মধ্যে থেকে আবেগের অবাধ আর্তনাদ শিলং পাহাড়কে কাঁপিয়ে দিলো প্রতিধ্বনির আঘাতে। এমন উদ্বেল করা দৃশ্য সত্যজিতের ছবিতে খুব বেশি দেখা যায় না। এমনকি, নানা গ্রাম ঘুরে অপুর পিতা হরিহর যখন দেখে তার ঘরের দুর্গা আর নেই, তখনো সর্বজয়ার আকাশবিদারক কান্নাও ঢাকা পড়ে তার সানাইয়ের ধাতব তীব্রতায়।কণ্ঠস্বরে নয়।
অনেকটা এই জায়গা থেকেই রেনেসাঁর যুক্তিবাদী, তথ্য নির্ভর, নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণের ট্র্যাডিশনের অনুসারী সত্যজিত রায়ের ছবিতে রাজনীতির কথা তুলে ধরতে চাই।
বামপন্থী নির্দেশকদের অনেকেরই সত্যজিৎ রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে উনি সমকালীন রাজনীতির বিষয় নিয়ে ছবির মাধ্যমে সোচ্চার হননি।কোন নির্দিষ্ট দর্শনের উচ্চকিত স্লোগান দেননি। কিন্তু গুপি গাইন বাঘা বাইন ও হীরক রাজার দেশে র মত ছবির কথা যখন আজকে দেশের মধ্যে চাপিয়ে দেওয়া স্বৈরতন্ত্র, ব্যক্তি পূজা বা হীরক রাজার দরবারের সভাকবির মত গোদি মিডিয়ার প্রসঙ্গে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় উঠে আসে তখন বোধহয় সেসব ড্রয়িং রুমের আরাম কেদারা থেকে উঠে আসা অভিযোগ টেকে না।
একথা ঠিক, সত্যজিৎ কোনদিন শিল্পকে প্রোপাগান্ডা মনে করেননি। কোন দল বা সরকারের প্রতি শিল্প বাঁধা থাকতে পারে না। IPTA র থেকে বহু প্রতিভাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল সত্যজিতের চোখের সামনে। তাই তিনি যখন সীমাবদ্ধ, প্রতিদ্বন্দ্বী,জন অরণ্য ছবিতে সমকালের ছবি ধরার চেষ্টা করেন তখন তা দর্শককে শুধুমাত্র অসহায়তা বা তীব্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ঠেলে না দিয়ে বরং পরিস্থিতির পিছনের কারণগুলির দিকে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।তাদের চিন্তা করতে ও সমাধান খুঁজতে প্রেরিত করে।
একজন অসম্পৃক্ত স্রষ্টা ও দর্শক হিসাবে নিজেকে বিষয়ের থেকে আলাদা রেখে সমসময় ও ভবিষ্যতের কথা বলা খুব শক্ত বিষয়।সত্তরের নকশালবাদী রাজনীতি ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সহিংস স্বদেশী আন্দোলন সত্যজিতের ছবির সংলাপের বিতর্কের মধ্যে এসেছে। তিনি স্তিমিত উচ্চারণে হঠকারী, উত্তেজনা সর্বস্ব, শিথিল নৈতিকতার অসারতার কথা বলেছেন।
আবার যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির শানিত ছুরি চলতে দেখি দেবী ও গণশত্রু ছবিতে। মধ্যবিত্তের কমতে থাকা সমাজবোধের উপর কটাক্ষ দেখি শাখা প্রশাখা ও আগন্তুক ছবিতে।
অর্থাৎ স্লোগান না তুলেও সমাজ ও রাজনীতির বিবর্তনের আসল সত্যটি স্পষ্ট করে বারবার বলেছেন সত্যজিৎ। আজ কয়েক দশক পরে যখন ধর্ম নিয়ে লড়াই করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করার লড়াইয়ে দেশ সামিল তখন চেতনার অন্দরমহলে সত্যজিৎ আরো বেশি জীবন্ত ও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন।
সময়ের বাধাকে অস্বীকার করে এভাবেই তো সত্য ও সত্যজিৎ কালজয়ী।প্রাসঙ্গিক। রাজনৈতিক।
(আজ সত্যজিত রায়ের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্দোলন ডট ইন-এর জন্য কলম ধরলেন নাট্যকর্মী এবং অভিনেতা শুদ্ধ ব্যানার্জী।)