-অশোক ভট্টাচার্য (রাজা):
আমি সমস্তরকম ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কথা বলতে চাই, তাই এই নাটক বেছে নিয়েছি। বক্তা- হাবিব তনবীর। ‘বিসর্জন’ নাটকের হিন্দি অনুবাদ ‘নয়া থিয়েটার’ যখন ‘রাজরক্ত’ নামে মঞ্চস্থ করছে সেই সময়ে এক সাক্ষাৎকারে হাবিব এমন কথাই বলেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন–হিটলার থেকে গুজরাত সবটাই তিনি এই প্রযোজনায় মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। পাশাপাশি মহাত্মা গান্ধীর অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতাও নাটকে তুলে ধরা আবশ্যক বলে তিনি মনে করেছিলেন। হাবিব তনবীরের সেই প্রযোজনার পর অনেকটা সময় গড়িয়ে গ্যাছে। গুজরাতের আগুন নেভেনিতো বটেই বরং সারা দেশে নতুন নতুন কৌশলে এবং রূপে তা রোজ সামনে চলে আসছে। সারা দেশে যদি সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বয়ে আনছে হিংসাকে ; আমার বাংলাতেও রাজনীতি বহন করে চলেছে সেই হিংসার আগুন। সেখানে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ আপনা আপনিই অভিনীত হয়ে চলেছে হয়ত আর সেখানেই রবীন্দ্র-জীবন দর্শন অক্ষয়-অমর।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় ‘বিসর্জন’ রবীন্দ্রনাথের সেই নাটক যেখানে নাটকীয় দ্বন্দ্ব বা ‘Conflict’ পরতে পরতে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। এই ঝিলিক হয়ত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মনকেও নাড়া দিয়েছিলো। না হলে প্রথম জীবনে ‘বিসর্জন’ নাটকে রঘুপতির ভূমিকায় অভিনয় করলেন আবার ৬২ বছর বয়সে এসে একই নাটকে জয়সিংহ-এর ভূমিকায় অভিনয় করলেন কেন?
‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের নাট্যযোগ্য রূপ হলো ‘বিসর্জন’। ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসে হাসির মুখে আমরা শুনি সেই কাতর উক্তি–“এত রক্ত কেন?” কিন্তু এর আগের চিত্রনাট্যটাতো জানতে হবেই, আর সেখানেই লুকিয়ে থাকে রক্তমাখা করতলকে জাস্টিফাই করার ভয়ংকর বীজমন্ত্র। যেখানে রঘুপতি জয়সিংহ-কে বলছে–“পাপপুণ্য কিছু নাই। কে বা ভ্রাতা, কে বা আত্মপর! কে বলিল হত্যাকাণ্ড পাপ!এ জগৎ মহা হত্যাশালা। জানো না কিপ্রত্যেক পলকপাতে লক্ষকোটি প্রাণীচির আঁখি মুদিতেছে! সে কাহার খেলা?”–ঠিক এখানেই চিরকালের খুনীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের ইতিবৃত্ত ‘বিসর্জন’ নাটকের সময়কালের সঙ্গে আজকের সময়কে এক বৃত্তে বেঁধে ফ্যালে। কেউ যখন “গোলি মারো শালোকো ” বুক ফুলিয়ে বলার পর বহাল তবিয়তে ভারতের আইনসভায় বসে থাকে কিম্বা কেউ ‘চড়াং চড়াং করে ঢাক বাজানো’র নিদান দিয়ে ‘ভয়ংকর খেলা হবে’ বলে যখন রাজনীতির আইকন হয়ে ওঠে; পাশাপাশি তাদের স্ব-স্ব চাঁইরা যখন কখনো চুপ থেকে, কখনোবা নানা যুক্তি দিয়ে এই হিংসাত্মক মনোভাবকে জাস্টিফাই করতে নেমে পড়ে তখন ‘রঘুপতি’দের নতুন করে খুঁজে পেতে আমাদের কষ্ট করতে হয়না।
হিংসা আসলে হিংসাই। কোন পথে আসলো, কোন রূপে আসলো সেই হিংসা-তা বড় ব্যাপার নয়। আজ সারা দেশে ধর্মের নামে কিম্বা মতাদর্শের নামে যে ঘৃণা এবং হিংসার বাতাবরণ তৈরি করা হচ্ছে, তাতে দোহাই দেওয়া হচ্ছে ‘ঈশ্বরের’! আমাদের দেশে অনায়াসে ‘রাম’ নাম উচ্চারণ করে খোলা তরবারির ঔদ্ধত্যপূর্ণ আস্ফালন কিম্বা পাশের দেশ ‘বাংলাদেশ’-এ একই পথে -একই ভাবে ‘নারায়ে তকবির’ বলে অন্য ধর্মের উৎসব অঙ্গনকে রক্তাক্ত করার ইতিবৃত্ত আজ আমাদের চোখের সামনে। ঠিক তখনই ‘বিসর্জন’ নাটকের অপর্ণা’র মুখের কথা আমাদের আরো একবার নাড়া দিয়ে যায় —“মা তাহারে নিয়েছেন? মিছে কথা! রাক্ষসী নিয়েছে তারে”। এই রাক্ষসের তত্ত্ব হলো লেলিহান আগুনের মতো; যা সবটাকে গিলে খায়। গিলে খাওয়ার উৎস সেই প্রবল ঔদ্ধত্য। সবটাকে গ্রাস করে খান্ডব দহনের পর অগ্নি যেমন পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলো তেমনই আচরণ থাকে যুগ যুগের শাসকের। ভারতের সংসদীয় রাজনীতির সংস্কৃতিতে এমন ব্র্যান্ড আইটেম আগে দ্যাখা যায়নি। কি সেটা?
এই যে, সবটাই আমার চাই। আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না। সব রং-সব মতকে পিষে ফেলে একমাত্র একটাই রং-একটাই মত থাকবে। এই ‘নিউ ব্র্যান্ড অফ পলিটিক্স’-এর ছায়াপাতই গোধরা থেকে বগটুই-এর আগুন, গৌরি লঙ্কেশ থেকে স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু কিম্বা প্রতি মুহূর্তে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ঘৃণার লকলকে আগুনে ক্ষতবিক্ষত এদেশের মাটিতে আমরা লক্ষ করছি। ঠিক এখানেই রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ আজ বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে বারবার।
‘বিসর্জন’ নাটকের কাহিনীর বুননের মধ্যেই একটা জোর আছে। সেই জোরটা কি? এই নাটক রবীন্দ্রনাথের এক ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। এটা বোধহয় একমাত্র রবীন্দ্র-নাটক যেখানে নাট্যকার হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ‘ব্যক্তিনিরপেক্ষ’ থাকতে পেরেছেন। নাটকের অন্তর্দ্বন্দ্বের আঙ্গিক ‘সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো’ তার দিকে আপনিই ছুটে চলুক, এমনটাই নাট্যকার চেয়েছিলেন। তাই অন্যান্য রবীন্দ্র-নাটকের মতো ‘বিসর্জন’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ সরাসরি নিজের জীবন দর্শন দাগিয়ে দ্যাননি। বরং রবীন্দ্র জীবন – দর্শন এই নাটকে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়েই উত্তরণের পথে এগিয়ে চলে। ঠিক সেই দ্বান্দ্বিক সমগ্রতার ভিতর দিয়েই আর্থসামাজিক প্রেক্ষিতকে বিচার করলেই সার্বিক সত্যে উপনীত হওয়া যায়। যে সত্য সামনে আসলে আমরা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে দেখি ‘বিসর্জন’ নাটকের সব চরিত্রগুলো আশেপাশে কিলবিল করলেও, একটি চরিত্রের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। তাঁর নাম ‘গোবিন্দমাণিক্য’। এই দেশ চৈতন্য, বুদ্ধদেব থেকে গান্ধীর ভিতর গোবিন্দমাণিক্য-কে দেখতে পেয়েছিলো একদিন। যে গোবিন্দমাণিক্য এই রক্তের হোলির ভিতর দাঁড়িয়ে পরিবার, দল, গোষ্ঠী, অনুগামী, ‘আমরা-ওরা’ সবার বাধা হেলা ভরে দূরে সরিয়ে বলবেন–” ভালোবাসা দিয়ে বোঝো–আর রক্তপাত নহে…”
হিংসাকে জাস্টিফাই করার প্রবণতা ধর্মীয় মৌলবাদ এবং রাজনৈতিক মৌলবাদের গণ্ডি টপকে আজ আমাদের ব্যক্তি জীবনেও ঢুকে পড়েছে। ভয়টা সেখানেই আরো বেশি। সম্প্রতি আমাদের রাজ্যে বহরমপুরে এক যুবতীর হত্যাকে জাস্টিফাই করতে দেখলাম নেটিজনদের একটা বড় অংশকে। সুতরাং বিপদ শিয়রে, বলা ভালো বিপদ ‘বেড-রুম’, ‘ড্রইং রুম’, রান্নাঘরে ঢুকে পড়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কারণ রাষ্ট্র আমাদের ব্যক্তিজীবনে ঢুকে পড়েছে অনেকদিনই হলো।
যে প্রদেশের পটভূমিতে ‘রাজর্ষি’ কিম্বা ‘বিসর্জন’ লেখা সেই ত্রিপুরাতেও একই অবস্থা। আসলে অঙ্গুরীমালের জেতবন-কান্ড থেকে আজকের সময়, গোধরা থেকে দিল্লি, ছোট আঙারিয়া থেকে বগটুই, কুমিল্লার দুর্গাপূজা ভাঙচুর থেকে ত্রিপুরা, রামনবমীর দিন মসজিদের সামনে জান্তব উল্লাস থেকে চার্চে আগুন, রঘুপতি থেকে হিটলার হয়ে আজকের ঔদ্ধত্যে ভরা রাজা-রানিরা ; ‘বিসর্জন’ যেন সবার কথা-ই তুলে ধ’রে বারেবারে হয়ে ওঠে ‘কনটেম্পোরারি’। ‘রঘুপতি’ র কামনাকুটিল মন, যে মন একমাত্র নিজেকে, নিজের মত, নিজের রং-কে স্থাপিত করতে গিয়ে অন্যসব বিরুদ্ধতাকে পায়ে পিষে, দলিতমথিত করে প্রবল ঔদ্ধত্যে রক্তলেখায় হাত রাঙিয়ে তুলছে আজ আমাদের চারপাশে। সেখানেই আজ অদৃশ্য গোবিন্দমাণিক্য, সে যেন ঘুরেফিরে জলের মত একা কথা কয় –“এত রক্ত কেন? “
ছবি- সংগৃহীত।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
#tagore&congressidea