আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ও বাংলা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস মুছে ফেলার জন্য মোদি সরকারের হীন প্রচেষ্টা

শান্তনু দত্ত চৌধুরী

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ , হিন্দু মহাসভা , মুসলিম লীগ প্রভৃতি সংগঠনের নেতৃবৃন্দের ভূমিকা কালিমালিপ্ত। এরা স্বাধীনতা সংগ্রামে কখনও অংশগ্রহণ করেননি , ফলত: এদের কোনোদিন কারাবরণ বা কৃচ্ছসাধন করতে হয়নি। এদের কাজই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে দুর্বল করা।

আমরা যেমন নিজেদের স্বাধীনতার জন্য লড়েছি , তেমনই অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকেও আমরা সমর্থন করেছি। সেই ১৯২৭ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস শহরে অনুষ্ঠিত ‘ লীগ এগেইনস্ট ইমপিরিয়ালিসম ‘ এর সম্মেলনে পন্ডিত নেহেরু কংগ্রেস থেকে যোগ দিয়েছিলেন ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেছিলেন। ওই সময় প্রতি বছর কংগ্রেস অধিবেশনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুক্তি সংগ্রামীরা যোগ সিতেন। ১৯৪৭ সালে যখন আমাদের দেশ স্বাধীন হয় তখনও পৃথিবীর বহুদেশ নির্দয় ঔপনিবেশিক শাসনের ( Colonial Rule ) অধীনে শাসিত হচ্ছিল। ওই সব দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে স্বাধীন ভারত দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে পন্ডিত নেহরুর উদ্যোগে দিল্লির পুরানা কেল্লাতে ১৯৪৭ সালের ২৩ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত ‘ এশিয়ান রিলেসন্স কনফারেন্স ‘ অনুষ্ঠিত হয়। এশিয়ার ২৮ টি দেশের প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা সকলেই ছিলেন নিজনিজ দেশের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের নেতৃবৃন্দ। মহাত্মা গান্ধি এই সম্মেলন উদ্বোধন করেন। সরোজিনী নাইডু সভাপতিত্ব করেন। তখন দেশে Care Taker সরকার চলছিল। পণ্ডিত নেহরু ছিলেন এই সরকারের Executive Vice President. কিন্তু মুসলিম লীগ সাম্রাজ্যবাদী ইন্ধনে এই সম্মেলন বয়কট করে। তারা বলে এই সম্মেলন হচ্ছে বর্ণ হিন্দু কংগ্রেসের এক কারসাজি। কিন্তু এই সম্মেলন বিপুল সাফল্য লাভ করে। এমনকি আফ্রিকার কিছু দেশ এই Conference এ দর্শক প্রতিনিধি পাঠায়। সম্মেলন থেকে সমস্ত উপনিবেশের মুক্তি , বর্ণ বৈষম্যবাদের অবসান , সকল দেশের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বর জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই এশিয়ান রিলেসন্স কনফারেন্সের হচ্ছে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সূত্রপাত।

আমরা শুধু স্বাধীনতা অর্জন করেই থেমে থাকিনি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যথা চিন, ইন্দোনেশিয়া , ভিয়েতনাম , দক্ষিণ আফ্রিকা , এঙ্গোলা , মোজামবিক , গিনি – বাসাউ প্রভৃতি প্রতিটি দেশের মুক্তি সংগ্রামের পাশে দাঁড়িয়েছি। তার অন্যতম উজ্জ্বল উদাহরণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা। নরেন্দ্র মোদি সঙ্ঘ পরিবারের লোক। নাৎসি মতবাদের সমর্থক । এদের গুরু আর.এস.এস.- এর দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক তার Bunch of Thoughts এ লিখেছিলেন , জাতি সমস্যা সমাধানে হিটলারের দেখানো পথে সমাধান হচ্ছে প্রকৃষ্ট পথ। হিটলারের প্রচার সচিব গোয়েবলস বলেছিল একটা মিথ্যা হাজার বার বললে সেটা লোকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। নরেন্দ্র ভাই তাই বাংলাদেশে গিয়ে বলে এলেন তিনি নাকি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে যোগ দিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কবে? কোথায় ?

RTI Act এ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জানতে চাওয়া হয়েছিল মোদিজি কবে কোথায় বাংলাদেশের সমর্থনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ? PMO বলেছে , এ সম্পর্কে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। মোদি দেশে বা ওই দেশে ইন্দিরা গান্ধির নামও উচ্চারণ করেনি। বাঙলাদেশের পত্র পত্রিকা ধুয়ে দিয়েছে মোদিকে।তাঁরা বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন তাঁদের মুক্তি সংগ্রামে ইন্দিরা গান্ধি ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা। শ্রীমতী শেখ হাসিনা বলেছেন তাঁদের দেশের মুক্তি সংগ্রামে ইন্দিরা গান্ধির অপরিসীম অবদানের কথা। বাংলাদেশ তাঁদের দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সন্মান অর্পণ করেছেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধিকে। তাঁরা সিদ্ধান্ত করেছে ভবিষ্যতে আর কাউকে এই সন্মান দেওয়া হবে না।

বাংলাদেশের মাটিতে গিয়ে মোদির এই হীন প্রচেষ্টা ব্যার্থ হবার পর দেশের মাটিতে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগ করে মোদি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে আমাদের সেনাবাহিনীর যে বীরত্ব ও অবদান তার স্মৃতি চিন্হ অপসারণ করলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের যুদ্ধে ৯৩০০০ পাক সেনা ভারতের সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ মুক্ত হয়। অনেক ভারতীয় সেনা শহীদ হয়। তাঁদের স্মৃতিতে দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে প্রজ্জ্বলিত করা হয়েছিল ‘ অমর জওয়ান জ্যোতি।’ গত ২৬ জানুয়ারির প্রাক্কালে ইন্ডিয়া গেট থেকে ওই অনির্বান জ্যোতি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্য কোথাও তথাকথিত নবনির্মিত জাতীয় যুদ্ধ স্মারকে। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের কোনো স্মৃতি রাখা হবে না। কেননা ওই বিজয়ের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধির স্মৃতি অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত। এবার ছিল শুধু একটি উল্টো করে রাখা বেয়নেট ও তার মাথায় একটি হেলমেট ।এবার তাও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আশ্চর্য বিষয় তারা বলেছে ওখানে তারা নেতাজির মূর্তি বসাবে।অর্থাৎ নেতাজির নাম ও স্মৃতিকে এই নাৎসি অনুগামীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পুণ্য স্মৃতি অপসারণের জন্য ব্যবহার করবে। সাহসী সাংবাদিক রোবিশ কুমার একটি তালিকা প্রকাশ করে জানিয়েছেন নেতাজির নামে রাজধানী দিল্লিতে কোথায় কোথায় Statue ও কোথায় পার্ক আছে। আরো হতে পারে , কিন্তু তাঁর নাম ব্যবহার করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অমর স্মৃতি চিহ্ন অপসারণ করা হল হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ।

দেশের ইতিহাসকে বিকৃত করবার জন্য কত অমূল্য স্থাপত্য , স্মৃতিচিন্হ ও স্মারক এই কমিউনাল ফ্যাসিস্টরা ধ্বংস করবে তা শুধু দেখার অপেক্ষা। ইতিমধ্যেই জালিয়ানওয়ালাবাগের সংস্কারের নামে ওই পূণ্যস্থানের স্মারক চিহ্ন Damage করা হয়েছে। ব্রিটিশ সেনাদের অত্যাচারের সব চিন্হগুলি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন আক্রমণ শুরু হয়েছে মহাত্মা গান্ধির ‘ সবরমতি আশ্রমের ওপর। ‘ এ সম্পর্কে পরে বিস্তৃত ভাবে লেখা হবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *