শান্তিনিকেতন থেকে চলে আসছেন ইন্দিরা। ঠিক তখন, সেই ‘শকুন্তলার পতি গৃহে যাত্রা’র মতোই কি গুরুদেব ইন্দিরাকেও সামনে রেখে আশ্রমের বৃক্ষরাজির উদ্দেশে বলেছিলেন?
” তোমাদের জল না করি দান যে আগে জল না করিত পান ;
সাধ ছিল যার সাজিতে, তবু স্নেহে পাতাটি না ছিড়িত কভু ;
তোমাদের ফুল ফুটিত যবে যে জন মাতিত মহোৎসবে ;…… তোমরা সকলে দেহ বিদায় ! “
‘ভার্সাটাইল’ শব্দ টা ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর আগে-পরে সেভাবে কারো ক্ষেত্রেই খুব একটা খাটে না।
‘রুশ বিপ্লব’ এর বছর জন্ম নেওয়া ইন্দিরার, নেতৃত্বের হাতেখড়ি ‘আনন্দ ভবন’ এ মাত্র ১২ বছর বয়সে গান্ধীজির ‘অসহযোগ আন্দোলন ‘ কারীদের সাহায্য করার জন্য ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ‘বানর সেনা’ গঠন করার মধ্যে দিয়েই।
রবীন্দ্রনাথ স্নেহভরে তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘প্রিয়দর্শিনী’। রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদী ভাবনার নির্যাস যে ‘বিশ্বময়ীর বিশ্বমায়ের আঁচল’– তার আশ্রয়েই ইন্দিরার দেশপ্রেমের ভাবনা লালিত হয়েছিলো। আর তাই তো দেশের গণ্ডির বাইরেও ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ’ এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির লড়াইকে সংগঠিত করার স্বার্থে ফিদেল কাস্ত্রোর হাত থেকে ‘জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন’ এর দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া…
ফুলের মতো কোমল আবার বজ্রের মতো কঠিন। তাই গুরুদেবের ছাতিমতলার ‘প্রিয়দর্শিনী’ অনায়াসে আমেরিকার চোখে চোখ রেখে সপ্তম নৌবহর কে ফিরে যেতে বাধ্য করে।
আবার কোটি বাঙালির গুমরে ওঠা স্বাধীনতার স্বপ্ন আর বাঙালির কান্না শুনে অনায়াসে সব প্রোটোকল ভেঙে ‘বাংলাদেশ – মুক্তিযুদ্ধে ‘ ঝাঁপিয়ে পড়া।
উত্তাল রাজনীতির আঙিনা থেকেই সাবলীল পদচারণায় ‘মা আনন্দময়ী’ র চরণ আশ্রয়ে ছুটে যেতেন; তখন তাঁকে দেখলে এক শান্ত – সমাহিত যোগিনী বলে মনে হতো।
সুনীল গাঙ্গুলি তাঁকে আক্রমণ করে কবিতা লিখলেন, কিন্তু সে কবিতার শৈলীও বোধহয় কেবলমাত্র ইন্দিরারই জন্য সৃষ্টি করেছিলেন সুনীল…
অনায়াসেই আদিবাসীদের ধামসা-মাদলের তালে নেচে উঠতো তাঁর পা। নাহ। লোকদ্যাখানো নয়, বরং তাঁর প্রাণের সুরে হয়ত তখন বেজে উঠতো সংগোপনে গুরুদেবের শান্তিনিকেতনের চরণ-মঞ্জরী।
প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দৃপ্ততা তাঁকে বিতর্কের কাঠগোড়ায় তুললেও, পরোয়া করেননি তিনি।
ভোটে পর্যদুস্ত, কারাগার যাপন…আবার দাঁতে দাঁত চেপে প্রতি ইঞ্চিতে লড়াই করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন…
“এভাবেও ফিরে আসা যায়”
মৃত্যু আঘাত হানতে পারে….তা জেনে বুঝেও কেবলমাত্র ভারতীয় বহুত্ববাদ এবং সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য কে ক্ষুন্ন হতে দেননি।
ব্যক্তিপুঁজির হাতে দেশের সম্পদ তুলে দিয়ে চমক দিচ্ছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী। আর ইন্দিরা ব্যাঙ্ক, খনি, প্রাকৃতিক গ্যাস ও তৈল খনি রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করে চমক দিয়েছিলেন।
তাঁর সমালোচকরা বলেন, ইন্দিরা নাকি চমক দিতে ভালোবাসতেন। শেষ চমকটা দিয়ে গিয়েছিলেন নিজের জীবন আত্মাহুতি দিয়েই।
তির বেঁধা কবুতরের মতো ছটফট করতে করতে নিবে গ্যালো গুরুদেবের ‘প্রিয়দর্শিনী ‘… গুরুদেব হয়ত তখনো শান্তিনিকেতনের আশ্রমে দাঁড়িয়ে বলে চলেছেন…
“শরীর সে ধীরে ধীরে যাইতেছে আগে,
অধীর হৃদয় কিন্তু যায় পিছু-বাগে –
ধ্বজা লয়ে গেলে যথা প্রতিকূল বাতে পতাকা তাহার মুখ ফিরায় পশ্চাতে ॥ “
তাঁর কথা শেষ হয় না। তাঁর সম্পর্কে আলোচনায় দাঁড়ি টানা যায় না…