আদানিদের জালিয়াতি – বাঘের পিঠে মোদী

প্রনব কুমার খাঁ

আত্মনির্ভরতার লক্ষ্যে ভারতের অর্থনীতির পথনির্দেশ করতে গিয়ে পন্ডিত নেহেরুর উদ্বেগ ছিল আবার না বনিকের মানদন্ড, রাজদন্ডে পরিনত হয়। সেটা হতে পারতো দেশীয় পুঁজির অভিঘাতেও যদি সরকার কোনো নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারতো। এছাড়া এটাও ঠিক যে, দেশীয় পুঁজির জোর এখনকার মতো শক্তিশালী ছিলো না কিন্তু পুঁজিপতিদের মুনাফা শিকারের চরিত্র একই ছিল। তাই প্রশান্ত মহালোনবিশ কে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পিত অর্থনীতির সোপান তৈরী হলো। আবার মিশ্র অর্থনীতির প্রচলন করে দেশীয় পুঁজিকে উৎসাহ দেওয়া হলো। ফল পেয়েছিল ভারতের মানুষ। পরে যখন অর্থনীতি যথেষ্ট মজবুত হলো, জিডিপি বৃদ্ধির হার ১০% হয়ে রইলো বহু বছর, তখন আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণ শীথিল করে মুক্ত ও উদার অর্থনীতির পথে হাঁটা শুরু হলো। এর ফলও খুব আশাবাদী হয়, লিবারালাইজেশন এর হাত ধরে প্রথম পাঁচ বছরেই ভারতের পনেরো কোটি মানুষ নিম্ন থেকে উচ্চ আয়ের বন্ধনীতে পৌঁছে যায়।

মোদী সরকার আসার পর তাদের বল্গাহীন আদর আর প্রশ্রয়ের ছাতার তলায় দেশীয় হাতেগোনা কয়েকটা গোষ্ঠী পৃথিবীর দশ পনেরো নং এর মধ্যে চলে এলো। তাদের বদান্যতায় এই সরকারি দল নিশ্চয়ই কিছু প্রসাদ পেল কিন্তু যেটা হারালো সেটা হলো নিয়ন্ত্রণ। বাঘের পিঠে সওয়ার হলে বাঘের কথা মতোই চলতে হবে। ইচ্ছামতো নেবে যাওয়া চলবে না। দেশীয় বন্ধু উদ্যোগপতিরা কখনোই সরকারের বন্ধু নয়। যতদিন তাদের চাহিদা আর মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলতে সাহায্য পাবে ততদিনই তারা বন্ধু থাকবে। অন্যভাবে বলা যায় সরকারকে শোষণ করে নিজেদের গোষ্ঠীগত সম্পদ অবিশ্বাস্য ভাবে বাড়াবে – এটাই একচেটিয়া পুঁজির স্বরূপ। আর কাজটা করতে সরকারকেই শোষক হতে হবে। কিন্তু সেটা যেহেতু প্রকাশ্যে বলা যাবে না তাই সরকারও নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে রাখবে।

হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ তেরী হয়েছিল ২০১৭ সালে। এরা মুলতঃ ফরেন্সিক ফিনান্সিয়াল রিসার্চ করে। ব্যালান্সশিট অ্যানালিসিস করে। তার কারচুপি নির্নয় এবং মুলধন ও সম্পদের সঠিক মুল্যায়নে এরা সারা পৃথিবীর অন্যতম বিশেষজ্ঞ সংস্থা। এরা প্রকাশ করেছে যে, আদানি গোষ্ঠী রান্না করা (cooked) ব্যালান্সশিট পেশ করেছে বেশ কয়েকবছর। ব্যালান্সশিট হলো কোনো কোম্পানির দায় ও সম্পদের মুল্যায়ন। এটা সুন্দর করে দেখাবার জন্য নানাভাবে সম্পদ বর্ধিত করা হয়েছে। এরজন্য একেবারেই গোড়া থেকে হিসাব নিকাশের পদ্ধতিতে সুচারুভাবে হেরফের করা হয়। অডিটে চিরাচরিত পদ্ধতিতে কোনও খুঁত পাওয়া যায় না অথবা অডিটর দের প্রচুর টাকার বিনিময়ে কিনে নেওয়া হয়। এই যে ফরেন্সিক অ্যানালিসিস সেটা যথেষ্ট পরিশ্রম ও দক্ষতার সঙ্গে করতে হয়। তাতেই ধরা পরেছে আদানিরা ঋন-মুলধন অনুপাত, চলমান সম্পদ অনুপাত, লাভ, মোট বিক্রয়লব্ধ টাকার পরিমান ইত্যাদি সমস্ত অ্যানালিটিকাল অনুপাতগুলো তৈরি করেছে নিজেদের মতো করে যার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার ফারাক অনেক। এই অর্ডারি ব্যালান্সশিটএর দৌলতে এদের শেয়ারের দাম বেড়েছে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে, মানুষ বিশ্বাস করেছে এবং লগ্নিকারি সংস্থাগুলো ( যাদের মধ্যে LICI ও SBI প্রধান) বিনিয়োগ করেছে বা কৃত্রিমভাবে বাড়ানো দামে শেয়ার কিনেছে। ফলে যখন হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট এর পর শেয়ারের দাম ১-২০% পড়ে গেছে তখন রাতারাতি এদের বিনিয়োগ লোকশানে পরিনত হয়েছে। আাদানি গোষ্ঠীর শেয়ার মূল্যের পতনের জন্য এবং LIC ও SBI এর নিজস্ব শেয়ার মূল্যের পতনের কারনে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির বোঝা চেপেছে LIC ও SBI এর কাঁধে। সাধারণ লগ্নিকারীরা হারিয়েছেন 8.20 লক্ষ কোটি টাকা। এতে গোটা শেয়ার ও বন্ডের বাজারে মানুষের আস্থা কমেছে। আশা করা যায় এরা অদুর ভবিষ্যতে এই ধাক্কা সামলে নিতে পারবে। LIC জানিয়েছে, এই ক্ষতির পরিমাণ তাদের AUM (Asset Under Management) এর 1%। SBI এর Solvency Margin ও যথেষ্ট আশাপ্রদ। তবে এরা যে মোদী সরকারের চাপের মুখে আছে এটা স্পষ্ট হয় যখন LIC আরও 300 কোটি টাকা আদানি গোষ্ঠীতে নিয়োগের জন্যে পরিচালন বোর্ডের স্বীকৃতি পায়।

আদানি গোষ্ঠীর তরফ থেকে সব সংবাদপত্রে লাখ লাখ টাকা খরচ করে সাফাই দেবার চেষ্টা হচ্ছে। তারা বলছে এটা নাকি একটা চক্রান্ত। কিন্ত হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে 70 এর বেশি প্রশ্নের মধ্যে মাত্র 20টা দায়সারা জবাব দিয়েছে। বাকি প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। এখন জিগির তোলা হচ্ছে এটাও ভারতের উপর ইউরোপীয় শক্তির চক্রান্ত। আদানি গোষ্ঠীর সমাজকল্যাণ মূলক কাজের অপ্রয়োজনীয় ফিরিস্তি দিয়ে আসলে লোক ঠকাবার মানসিকতাকে চাপা দেবার একটা নিস্ফল প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। এতেও ঐ গোষ্ঠীর পতন ঠেকানো যায় নি। তাদের নিজস্ব সম্পদের পরিমাণ 12% কমে গেছে প্রথম তিন দিনেই। অর্থমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী আশ্চর্যজনক নীরবতা পালন করছেন। ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা নাগেশ্বরন একটা নির্দিষ্ট কোম্পানির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বলেছেন। এখন সরকারের দায় পড়েছে যেকোনো ভাবে ও-ই গোষ্ঠীর লগ্নির জোগান দেওয়ার এবং নানাভাবে সরকারি সাহায্যে তাদের বাঁচিয়ে রাখা। গোড়ার কথায় ফিরতে গেলে বলতে হয় মোদী সরকার বাঘের পিঠ থেকে নামতে পারছে না। প্রয়োজনে দেশ বিক্রি করেও বন্ধু গোষ্ঠীকে বাঁচাতে হবে এখন।

প্রসঙ্গত, প্রশ্ন হলো বেসরকারী উদ্যোগপতিদের সাহায্যে কেন আমাদের শিল্পায়নের এই অবস্থা ?? আমরা কি তাদের উপর ভরসা করতে পারি ?? মনে রাখতে হবে যে, ভারতে অন্তত গত এক দশকের বেশি সময়ে যে সমৃদ্ধি, সবেরই মূলে রয়েছে পরিষেবা ক্ষেত্রের আয় বৃদ্ধির ঘটনা। ভারতে একটিও শিল্পজাত বৈশ্বিক ব্র্যান্ড নেই। এখানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জিনিসপত্রের নাম বিশ্বে তেমন কেউ জানে না।এরা শুধু বানিয়া, শিল্পপতি নয়। 10 টাকায় কিনে 15 টাকায় বিক্রি করে ধনী হচ্ছেন। সুগত মারজিৎ ঠিকই দেখিয়েছিলেন শিল্প আর ব্যবসা এক জিনিস নয় – আমাদের সংজ্ঞায় গন্ডগোল আছে। এ দেশের পরিষেবা ক্ষেত্রের বড়ো নামগুলোকে বিশ্বে, বিশেষ করে ধনী দেশগুলোতে, সবাই এক ডাকে চেনে। সফটওয়্যার সম্পর্কিত ব্যবসায় ভারতের খুব নাম। কিন্তু আইফোন বা গ্যালাক্সি আমরা তৈরি করতে পারি না। নিদেনপক্ষে একটি মোটরগাড়ি।

ভারতের বেসরকারি উদ্যোগ টাকা রোজগার করতে চায়, বিনিয়োগে খরচা করতে চায় না। যেটুকু লগ্নি, তা ঐ সরকারি ব্যাঙ্কের টাকা ধার করে। প্রচুর ধারদেনা করে শোধ না দিলে সরকার বাঁচিয়ে দেবে, ব্যাঙ্কটা বিক্রি হয়ে যাবে, যাক। সুদের হার কমলে দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগ হেলদোল হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এদেশের সুদ একটু বেশি হলেই মোদীর স্নেহধন্য শিল্পপতিদের নাভিশ্বাস ওঠে। বিনিয়োগের জন্য নয়, মুনাফা কমছে বলে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *